বগুড়ায় প্রতিরোধ যুদ্ধ

আব্দুর রাজ্জাক
প্রকাশ: ১০ অক্টোবর ২০১৯ ০৭:২৫ ।
প্রচ্ছদ
পঠিত হয়েছে ৪৫৯ বার।

[বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা প্রবীণ রাজনীতিবিদ আব্দুর রাজ্জাক আর নেই।১৯৭১ সালের পঁচিশে মার্চ রাতে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী রংপুর থেকে বগুড়ার উদ্দেশ্যে  রওনা হওয়ার খবরে নিজ জেলাকে মুক্ত রাখতে যেসব তরুণ প্রতিরোধ যুদ্ধের শপথ নিয়েছিলেন তৎকালীন ছাত্র ইউনিয়ন নেতা আব্দুর রাজ্জাক ছিলেন তাদের অন্যতম। সেই প্র্রতিরোধ যুদ্ধের পটভূমি এবং পরবর্তীতে মুক্তিযুদ্ধকালীন নানা ঘটনাবলী নিয়ে ২০১৪ সালে জাতীয় দৈনিক সমকাল-এ  স্বাধীনতা দিবস সংখ্যায় তিনি লিখেছিলেন। তাঁর সেই লেখাটি পুণ্ড্রকথার পাঠকদের উদ্দেশ্যে তুলে ধরা হলো]

বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের পূর্বেই তদানিন্তন পূর্ব পাকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টি (মস্কোপন্থি) একটি গোপন সার্কুলার বাহক মারফত বগুড়া জেলা পার্টি নেতৃবৃন্দের কাছে আসে। সেই সময়ে ছাত্র ইউনিয়নের (মতিয়া গ্রুপ) অভ্যন্তরে কর্মরত পার্টি কমরেড যথাক্রমে- মাহফুজার রহমান মান্না, আব্দুর রাজ্জাক, এস এম রফিকুল ইসলাম লাল, নুরুল আনোয়ার বাদশা, দৌলতুজ্জামান, তরিকুল আলম ধলু এবং মঞ্জুরুল হক খান মঞ্জুকে নিয়ে পার্টির নেতৃবৃন্দ বসেন। উল্লেখিত সার্কুলারে বলা ছিল দেশ সশস্ত্র সংগ্রামের দিকে অগ্রসর হচ্ছে কাজেই অতি দ্রুত ছাত্র ইউনিয়নের নেতা-কর্মীদের নিয়ে ডেমি রাইফেলের মাধ্যমে ট্রেনিং শুরু করতে হবে এবং জনগণের দৃষ্টি যাতে সশস্ত্র সংগ্রামের দিকে অগ্রসর হয় সে ব্যাপারে ব্যাপক প্রচার প্রচারণা চালাতে হবে। উক্ত সভায় ছাত্র ইউনিয়নের নব নির্বাচিত জেলা সভাপতি মাহফুজার রহমান মান্নাকে প্রধান করে ৫ সদস্যের কমাণ্ড কাউন্সিল গঠন করা হয়। কমাণ্ড কাউন্সিলের অপর চারজন সদস্য যথাক্রমে এস এম রফিকুল ইসলাম লাল, আব্দুর রাজ্জাক, নুরুল আনোয়ার বাদশা এবং বদিউল আলম পলক। আরও সিদ্ধান্ত হয় মাসুদুর রহমান হেলালকে কমাণ্ডার এবং মোজাম্মেল হক লালুকে সহকারী কমাণ্ডার করে প্রতিদিনের ট্রেনিং কার্যক্রম পরিচালিত হবে। তারপর থেকেই ব্রিগেড গঠনের কাজ চলতে থাকে। সেই সময় উল্লেখযোগ্য যারা ব্রিগেড গঠনে যুক্ত ছিলেন তাদের মধ্যে নজমল বারী, তরিকুল আলম ধলু, আক্তার হোসেন তারা, খাজা সামিউল হক, একরামুল হক স্বপন, মঞ্জুরুল মঞ্জু, জিন্নাতুল ইসলাম জিন্নাহ, ফজলুল হক, মাহমুদুল আমিন, সৈয়দ আহম্মেদ অটল, আলতাব আলী হাসু, টি এম মুসা পেস্তা, আক্তাবুল আলম দোল, আব্দুস সোবহান, মোফাজ্জল হোসেন মোফা, মোস্তাফিজার রহমা মোস্তা, আব্দুল জলিল, জগলুর রশিদ জগলু, লাবলু, আব্দুল মজিদ (দত্তবাড়ি), আব্দুল মজিদ (ফুলবাড়ি), আব্দুল মজিদ সরকার, মাহফুজার রহমান গোলাম, আবুল হোসেন (ডাকুরচক), জয়নাল আবেদীন কেনেডি, নুরুল রসুল, মোজাম, কাদের, এ কে রেজাউল হক রাজু, দৌলতুজ্জামান প্রমুখ। মেয়েদের মধ্যে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে জেব-উন-নাহার, তাহমিনা খাতুন বুলবুল, নুরুন নাহার নূর, ডলি, রোজি ও ময়না।

১৯৭১ সালের ১২ মার্চ থেকে বগুড়া জিলা স্কুল মাঠে ছাত্র ইউনিয়নের ব্রিগেডের কর্মকাণ্ড শুরু হয়। প্রতিদিন বিকেল বেলায় প্যারেড এবং মার্চ পার্চ চলতে থাকে। ইতিমধ্যে ছাত্র ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় কমিটির পক্ষ থেকে ১২ মার্চ কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের সমাবেশে পূর্ব পাকিস্তানকে স্বাধীন করার কথা ঘোষণা দেয়। ২৩ মার্চ জিলা স্কুলের মাঠে একটি চৌকির উপর দাঁড়িয়ে কমাণ্ড কাউন্সিলের প্রধান মাহফুজার রহমান মান্না এবং অপর চারজনের উপস্থিতিতে মাসুদুর রহমান হেলাল ও মোজাম্মেল হক লালুর কমাণ্ডে পরিচালিত প্যারেডের সালাম গ্রহণ করেন। তার জগলুদের একটি পুরাতন গাড়ি হুড বিহীন অবস্থায় যে গাড়ীটি জগলু নিজে চালাচ্ছিলেন কমাণ্ড কাউন্সিলের ৫জন ঐ গাড়িতে উঠে এবং পিছনে হেলাল ও লালুর নেতৃত্বে ব্রিগেডের মেয়ে ও ছেলেদের সমন্বয়ে ডেমি রাইফেলসহ বিভিন্ন প্লাটুনে একটি বিশাল র‌্যালী শহর প্রদক্ষিণ করে জিলা স্কুল মাঠে একটি সংক্ষিপ্ত সমাবেশের মাধ্যমে শেষ হয়।
২৫ মার্চ পাকিস্তান আর্মি রংপুর থেকে বগুড়ার দিকে অগ্রসর হতে থাকলে মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষে বগুড়ার আপামর জনগণ গাছ, বৈদুতিক পিলার এবং নানাভাবে রাস্তায় প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করতে থাকে। বাঘোপাড়ায় পাকিস্তান আর্মি প্রথম প্রতিরোধের সম্মুখীন হলে তোতা নামে একজন শহীদ হন। তারপর পাক আর্মি সামনের দিকে অগ্রসর হয়ে প্রথমে আজিজুল হক কলেজ পুরাতন ভবন এবং মহিলা কলেজে আশ্রয় গ্রহণ করলে মহিলা কলেজের বিপরীতে সুবিলের দক্ষিণ পাশে অবস্থানকালে আমাদের কিছু তরুণ সমাজ তাদেরকে লক্ষ্য করে গুলি করার এক পর্যায়ে ছুনু হিটলু এবং বিহারী কাবুল পাক বাহিনীর হাতে ধরা পড়ে। পরে তাদেরকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। তারপর পাক বাহিনী শহরের দিকে অগ্রসর হওয়া অবস্থায় কালিতলা হাটে এক রিকশা চালককে গুলি করে হত্যা করে। হানাদাররা আরও উত্তরের দিকে অগ্রসর হতে থাকলে বড়গোলার মোড়ে তদানিন্তন জনতা ব্যাংকের উপরতলা থেকে যুদ্ধরত অবস্থায় ছাত্র ইউনিয়ন শহর শাখার প্রচার সম্পাদক টিটু শহীদ হয়। পাক বাহিনীর সামনের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। ২নং রেল ঘুমটির উত্তর পাশে একটি দোতলা থেকে পাক আর্মিকে লক্ষ্য করে গুলি করতে যেয়ে আজাদ শহীদ হন। এক ক্যাপ্টেনের নেতৃত্বে পাক আর্মিরা রেলওয়ে ওয়াগনের পাশ দিয়ে থানার দিকে অগ্রসর হওয়ার সময় নিউ মার্কেটে অবস্থিত আজাদ গেস্ট হাউজ থেকে ইপিআর ও পুলিশ বাহিনীর কিছু সদস্যের গুলিতে ক্যাপ্টেনসহ তিনজন পাক আর্মি নিহত হলে পাকিস্তান আর্মি তাদের লাশসহ পিছু হটে এবং মহিলা কলেজ ও পুরাতন ভবনে আশ্রয় নেয়। ওইদিন সন্ধ্যার পর শহীদ টিটু ও আজাদের লাশ আমরা স্টাফ কোয়ার্টারের পূর্ব পাশে একটি গোরস্থানে দাফন করি।
ইতিমধ্যে ন্যাপ, ছাত্র ইউনিয়ন এবং গোপন কমিউনিস্ট পার্টির উদ্যোগে বগুড়া করনেশন স্কুল, সেন্ট্রাল হাইস্কুল এবং মালতিনগর হাইস্কুলে মুক্তিযোদ্ধাদের ৩টি ক্যাম্প স্থাপিত হয়। ঐক্যবদ্ধভাবে মুক্তিযুদ্ধকে পরিচালনার জন্য তদানিন্তন ছাত্রলীগ নেতা শোক রানার চক সুত্রাপুরের পৈত্রিক বাড়িরর দোতলায় জেলা আওয়ামী লীগ, ন্যাপ (মোজাফফর), ন্যাপ (মোজাফফর), ন্যাপ (ভাসানি) এবং কমিউনিস্ট পার্টির সমন্বয়ে ৯ সদস্য বিশিষ্ট একটি কমাণ্ড কাউন্সিল গঠিত হয়। কমিটির সদস্যরা হলেন আওয়ামী লীগ থেকে ড. জাহিদুর রহমান, জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি মাহমুদুল হাসান খান এবং সাধারণ সম্পাদক এ কে মজিবর রহমান। ন্যাপ (মোজাফফর) থেকে মোশাররফ হোসেন মণ্ডল, শেখ হারুণ-উর-রশিদ, অ্যাড. মীর ইকবাল হোসেন, ন্যাপ (ভাসানি) থেকে অ্যাড. গাজীউল হক এবং কমিউনিস্ট পার্টি থেকে কমরেড মোকলেছুর রহমান ও কমরেড আব্দুল লতিফ। পরদিন থেকে ২৭ মার্চ পর্যন্ত বগুড়ার বাঙালি ইপিআর, পুলিশ বাহিনী এবং মুক্তিযোদ্ধাসহ আপামর জনগণের তীব্র প্রতিবাদের মুখে পাক বাহিনীর পিছু হটে আবার রংপুর ক্যান্টনমেন্টে ফেরত যায়।
মাঝে তরিকুল আলম ধলু, খাজা সামিউল হকসহ কতিপয় ছাত্র মুক্তিযোদ্ধা কাটাখালি ব্রীজ ডিনামাইট দিয়ে ধ্বংস করে। খবর আসে যে, নগরবাড়ি হয়ে পাক আর্মি বগুড়ার দিকে অগ্রসর হচ্ছে। ইপিআর ও পুলিশ বাহিনীর বাঙালি সদস্য মাসুদুর রহমান হেলাল, সোবহান, আফতাবুল দোল প্রমুখের নেতৃত্বে একদল মুক্তিযোদ্ধা বাঘাবাড়ি ঘাটে যায় এবং প্রতিরোধ গড়ে তোলে। বগুড়ার দক্ষিণে আড়িয়া বাজারে পাকিস্তান আর্মির একটি ক্যাম্প ও অস্ত্রের ডিপো ছিল। তদানিন্তন ছাত্রলীগ নেতা শোকরানা, মাসুদের নেতৃত্বে একদল মুক্তিযোদ্ধা আড়িয়া বাজার ক্যাম্প আক্রমণ করে এবং পাক বাহিনীর আত্মসমর্পণের ঠিক মুহুর্তে একজন পাকক আর্মির সর্বশেষ ছোড়া গুলিতে মাসুদ শহীদ হন।
২২ এপ্রিল রাতে ৯ সদস্য বিশিষ্ট কমা- কাউন্সিলে মাহমুদুল হাসান খান, এ কে মজিবুর রহমান, মোশাররফ হোসেন ম-ল, কমরেড মোকলেছুর রহমান ও কমরেড আব্দুল লতিফ বগুড়া শহরতলীর হরিগারি গ্রামের তদানিন্তন ছাত্রনেতা আব্দুস সোবহানের বাড়িতে আশ্রয় নেয়। পরদিন ছোট বেলাইল গ্রামের ন্যাপ নেতা মোকছেদ আলীর বাড়িতে নেতৃবৃন্দের সভা হয় এবং সিদ্ধান্ত হয় নেতৃবৃন্দ যত দ্রুত সম্ভব নিজ নিজ উদ্যোগে ভারতে যাবেন। ওই সভায় ছাত্র ইউনিয়নের পক্ষ থেকে আমি এবং মাহফুজার রহমান মান্না উপস্থিত ছিলাম। আমার বাড়ি ওই গ্রামেই। কমিউনিস্ট পার্টির পক্ষ থেকে সিদ্ধান্ত হয় ছাত্র ব্রিগেডে কমা- কাউন্সিলের ৫ জনের সভা এবং সম্ভব হলে বর্ধিত আকারে ২৬ এপ্রিল সন্ধ্যায় আমার বাড়িতে অনুষ্ঠিত হবে। ২৬ এপ্রিল শুক্রবার সন্ধ্যার পূর্ব মুহুর্তে পাক বাহিনী বগুড়া দখল করে নেয়। বগুড়ায় অবস্থিত বিহারী এবং মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী শক্তি বিজয় মিছিল বের করে। স্বাভাবিক কারণে আমাদের সভা অনুষ্ঠিত হয় নি। আমরা একে অপর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ি।
তৎকালীন স্টেট ব্যাংক অব পাকিস্তান বগুড়া শাখার টাকা ভারতে নিয়ে যাওয়া এবং বাংলাদেশ সরকারের নিকট প্রদানের সিদ্ধান্ত ভুলভাবে নির্দেশ আসায় আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে দুই দলের সৃষ্টি হয় এবং করনেশন ক্যাম্প বেলাইল প্রাইমারী স্কুলে (দোগাড়ীয়া প্রাইমারী স্কুল) স্থানান্তরিত হয়। পরদিন সেখান থেকে উক্ত ক্যাম্পের সকল মুক্তিযোদ্ধা ভারতের উদ্দেশ্যে যাত্রা করে।
২৬ এপ্রিল সন্ধ্যায় আমি আমার বাড়িতে ছিলাম, মান্না ভাই তার ভগ্নিপতির বাড়ি শাবরুল থেকে হরিগাড়ি পর্যন্ত এসে বগুড়া শহরের পতনের খবর শুনে আমার সঙ্গে যোগাযোগ না করে ফেরত চলে যায়। আমি রাতে আমার বৈমাত্রেয় নানর বাড়ি ধওয়া চাঙ্গুইর যাই। ওইদিন রাতে নানাকে মান্নান ভাইয়ের খোঁজে তার ভগ্নিপতির বাড়ি শাবরুল পাঠাই। নানা এসে খবর দেয় সে শাবরুল থেকেও অনেক দূরে দক্ষিণে চলে গেছে। আমি পরদিন সকালে অজানার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হই কাহালু থানার হাটুরপাড়া গ্রামে রাত্রি যাপন করি। পরদিন সকালে আবার রওয়ানা হয়ে নন্দীগ্রাম থানার গুলকৃষ্টপুর গ্রামে আমার বন্ধু এক সময়ের ছাত্র ইউনিয়নের নেতা হবিবর রহমানের বাড়িতে আশ্রয় নেই। ইতিমধ্যেই খবর পাই ওই এলাকায় কিছু মুক্তিযোদ্ধা অস্ত্রসহ বিভিন্ন গ্রামে আশ্রয় গ্রহণ করেছে। আমি তাদেরকে সংগঠিত করার উদ্যোগ গ্রহণ করি। ২৯ এপ্রিল দুপুর বেলা আমার উল্লেখিত বন্ধুর বাড়ির মাটির দোতলায় বসে রেডিওতে স্বাধীন বাংলা বেতার শুনছিলাম। ইতিমধ্যে আমার বন্ধু এসে বলে আলতাব আলী হাসু এসেছে দেখা করবি কি’না? আমি বলি অবশ্যই। সে ভারতে গিয়েছিল, নিশ্চয় কোন বার্তা নিয়ে এসেছে। আলতাবের সঙ্গে দেখা হয় এবং সে বলে যে, আমি, মান্না ভাই এবং লাল ব্যতিত প্রায় সকল ছাত্রনেতা বালুরঘাট ক্যাম্পে আছে। কমরেড সুবোধ লাহিড়ী এবং মোকলেছ ভাই আমাদেরকে দ্রুত ভারতে যেতে বলেছে। আমি প্রথমে রাজি হইনি। সে কিছুতেই আমাকে ছাড়া ভারতে যাবে না। রাত ১২টার পরে সিদ্ধান্ত হয় ভোর বেলা আমরা রওয়ানা হবো। রাত ৪টায় অর্থাৎ ফজরের নামাজের কিছু পূর্বে আমরা নাগর নদ পার হয়ে অপর পাড়ে পৌঁছার কিছুক্ষণের মধ্যে গ্রাম থেকে চিৎকার ও লোকজনের ছোটাছুটি দেখতে পাই। লোকজনের চিৎকারে জানতে পারি উল্লেখিত গ্রাম পাক আর্মির দ্বারা ঘেরাও হয়েছে। আমি এবং হাসু ভারতের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করি একটানা যাত্রা করে সন্ধ্যায় নওগাঁ মহাদেবপুর থানার গয়েশপুর গ্রামে ফিজু ভাইয়ের বাসায় হাজির হই। সে সময় বাসায় ফিজু ভাই ছিলেন না। ভাবি এসে আমাদের নিয়ে যান। আমরা নদীতে গোসল সেরে রাতের বেলা খাবারের পর ফিজু ভাই আসেন। তার সঙ্গে আলোচনা হয়। সে জানায় কয়েকদিন এখানে থাকো পরবর্তীতে এক সঙ্গে যাওয়া যাবে। কিন্তু হাসু কিছুতেই থাকতে রাজি না। পরদিন ভোরে অর্থাৎ ১৯৭১ সালের ১ মে সেখান থেকে ভারতের উদ্দেশ্যে যাত্রা। চেংগিসপুরে বর্ডার পার হয়ে চেংগিসপুর বাজারে গিয়ে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিআই) থানা শাখার কার্যালয় থেকেক দেখে সম্পাদককে খুঁজে বের করি। তার নিকট জানতে পারি আমাদের কামারপাড়া ক্যাম্পে তদানিন্তন ক্যাপ্টেন আনোয়ার এবং ছাত্রলীগ নেতা সামাদের নেতৃত্বে হামলা হয়েছে এবং ক্যাম্প অন্যত্র স্থানান্তরিত হয়েছে। তিনি আমাদেরকে সরাসরি বালুরঘাট সিপিআই অফিসে যাওয়ার জন্য বলেন। বালুরঘাট যাওয়ার পথে হিলি-বালুরঘাট সড়কের ত্রিমোহনী এলাকায় ছাত্রলীগ নেতা খোকনের সঙ্গে দেখা হয়। খোকন বলে রাজ্জাক ভাই কোন ভাবেই কামারপাড়া সরকারী ক্যাম্পে আপনার যাওয়া চলবে না। আপনি সরাসরি বালুরঘাট যান এবং কমিউনিস্ট অফিসের সঙ্গে যোগাযোগ করুন। আমি এবং হাসু বালুরঘাট সিপিআই অফিসে যাই এবং সেখানে কমরেড সুবোধ লাহিড়ী এবং মোকলেছ ভাইয়ের সঙ্গে দেখা হয়। মোকলেছ ভাইয়ের সঙ্গে ওই দিনই বালুরঘাট এয়ারপোর্টের সন্নিকটে দাঙ্গা বিজয়াশ্রি প্রাইমারী স্কুলের স্থাপিত ন্যাপ, ছাত্র ইউনিয়ন, কমিউনিস্ট পার্টির ক্যাম্পে অবস্থান গ্রহণ করি।
২৫ মার্চের পরপরই ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের অন্যতম নেতা আন্দামান বন্দী বগুড়া জেলার কমিউনিস্ট পার্টির নেতা ডা. আব্দুল কাদের চৌধুরী তার বাড়ি পাঁচবিবি থেকে ভারতীয় হিলিতে যান এবং সে সময় সেখানকার পশ্চিম বাংলার পার্লামেন্ট সদস্য এবং সিপিআই নেতৃবৃন্দ ডাক্তার দা কে নিয়ে কলকাতায় যান। সর্ব প্রথম তিনি আকাশবাণী কলকাতা কেন্দ্র থেকে তদানিন্তন পূর্ব পাকিস্তানবাসীকে মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করার জন্য আহবান জানান এবং সোভিয়েত ইউনিয়নসহ বিশ্বের প্রগতিশীল দেশ সমূহকে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সহযোগিতার জন্য আবেদন জানান।
  লেখক: মুক্তিযোদ্ধা। সিনিয়র আইনজীবী বগুড়া এবং সদস্য, ওয়ার্কার্স পার্টি পলিট ব্যুরো।