বগুড়া আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন পাবলিক স্কুল ও কলেজ যেন এক বাতিঘর

অরূপ রতন শীল
প্রকাশ: ০৯ মে ২০১৮ ১৫:৩৫ ।
প্রচ্ছদ
পঠিত হয়েছে ৫৭০৮ বার।

আর্মড পুলিশ! নামের মধ্যে মেজাজি একটা ভাব রয়েছে। কিন্তু তাদেরই তৈরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের একাডেমিক কাঠামো গড়ে তোলা হয়েছে সৃজনশীলতা দিয়ে। বলছি বগুড়া আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন পাবলিক স্কুল ও কলেজের কথা। বগুড়াসহ উত্তরাঞ্চলের মানুষের কাছে যা ‘ব্যাটালিয়ন স্কুল’ নামে পরিচিত। ১৯৮৬ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকে পাঠদান পর্বটা শুধু ‘পড়া’ আর ‘লেখার’ মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখা হয়নি বরং শিক্ষার্থীদের সুপ্ত প্রতিভা বিকাশে নানামুখি উদ্যোগও নেওয়া হয়েছে।
শিক্ষার্থীদের যোগ্য নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার জন্য পাঠদানের বাইরে সহশিক্ষাকে সব সময় গুরুত্ব দিয়ে আসছেন কর্তৃপক্ষ। তার সফলতাও পেতে শুরু করেছে। পাবলিক পরীক্ষার পাশাপাশি জাতীয় পর্যায়ে অনুষ্ঠিত বিতর্ক প্রতিযোগিতা, ভাষা প্রতিযোগ এবং বিজ্ঞান অলিম্পিয়াডে এরই মধ্যে সাফল্যও অর্জন করেছে। সৃজনশীল এসব প্রতিযোগিতায় ধারাবাহিক সফলতা রয়েছে বলেই প্রতিষ্ঠানটি রাজশাহী বিভাগের সেরা বিদ্যাপীঠের স্বীকৃতিও অর্জন করেছে। উত্তীর্ণ অনেক শিক্ষার্থীই এখন দেশের শিক্ষা, চিকিৎসা, প্রকৌশল এবং সামরিক ও বেসামরিক প্রশাসনের বিভিন্ন পর্যায়ে বেশ দক্ষতার সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছেন। সমানতালে বিদেশেও তারা খ্যাতি ছড়িয়েছেন। কিন্তু এতকিছুর পরেও কর্তৃপক্ষের অপূর্ণতা রয়ে গেছে। তারা এখন স্বপ্ন দেখেন সব পাবলিক পরীক্ষায় শতভাগ জিপিএ-৫ প্রাপ্তি এবং সহশিক্ষার মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের প্রতিভাগুলোকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ছড়িয়ে দিতে।

পাবলিক পরীক্ষায় সফলতার পরিসংখ্যান : প্রতিষ্ঠানটি এরই মধ্যে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী (পিইসি), জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট (জেএসসি), মাধ্যমিক স্কুল সার্টিফিকেট (এসএসসি) এবং উচ্চ মাধ্যমিক সার্টিফিকেট (এইচএসসি) পরীক্ষায় শতভাগ পাশের রেকর্ড অর্জন করেছে। শুধু কি শতভাগের পাশের রেকর্ড! ২০১০ সাল থেকে টানা ছয় বার এসএসসিতে রাজশাহী শিক্ষা বোর্ডের সেরা ২০টি প্রতিষ্ঠানের তালিকায় স্থান দখল করে রাখে প্রতিষ্ঠানটি। উচ্চ মাধ্যমিকে এবং জেএসসিতেও একাধিকবার বোর্ড সেরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নাম লেখানো এই প্রতিষ্ঠান পিইসি পরীক্ষায়ও সেরাদের সেরা নির্বাচিত হয়।মোট পরীক্ষার্থী, পাশের হার এবং জিপিএ-৫ প্রাপ্তির ভিত্তিতে  সম্মিলিত মেধা তালিকায় শীর্ষ ২০টি প্রতিষ্ঠানের তালিকা ২০১৫ পর্যন্ত তৈরি করেছিল শিক্ষা বোর্ড কর্তৃপক্ষ। এরপর সেই তালিকা আর না হওয়ায় বোর্ড কিংবা বিভাগ সেরা প্রতিষ্ঠানের অবস্থান নির্ণয় করা সম্ভব হচ্ছে না। যে কারণে বর্তমানে শতভাগ পাশ এবং জিপিএ-৫ প্রাপ্তিই যেন সেরা প্রতিষ্ঠান নির্ণয়ের মাণদ- হয়ে উঠেছে। সেক্ষেত্রেও এগিয়ে রয়েছে বগুড়া আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন পাবলিক স্কুল ও কলেজ। চলতি বছর মোট পরীক্ষার্থীর ৮৫ দশমিক ৮৬ শতাংশ শিক্ষার্থী জিপিএ-৫ পেয়ে উত্তীর্ণ হয়েছে। ওই কলেজ থেকে উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীদের সিংহভাগই প্রতি বছর ঢাকাসহ একাধিক পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়, বুয়েট এবং সরকারি মেডিকেল কলেজে ভর্তির সুযোগ পাচ্ছে। শিক্ষকদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী শুধু ২০১৪ সালেই ওই প্রতিষ্ঠানের ৮ শিক্ষার্থী বুয়েটে চান্স পেয়েছে।

সৃজনশীল প্রতিযোগিতায় অর্জনগুলো: খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে মেধা অন্বেষণধর্মী সৃজনশীল সব প্রতিযোগিতাতেই বগুড়া আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন পাবলিক স্কুল ও কলেজ প্রাতিষ্ঠানিকভাবে অংশ নিয়ে থাকে। আয়োজক কোন প্রতিষ্ঠানেরই আমন্ত্রণ তারা ফিরিয়ে দেন না। ‘ফলাফল নয় অংশগ্রহণই মুখ্য’-এই নীতিতে বিশ্বাসী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি সাম্প্রতিকালে অনেক সফলতাও পেয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো: দৈনিক সমকাল আয়োজিত জাতীয় স্কুল বিজ্ঞান বিতর্ক প্রতিযোগিতায় প্রতিষ্ঠানটি ২০১৬ সালে জেলা পর্যায়ে চ্যাম্পিয়ন হয়। এর আগে এবং পরে ওই একই প্রতিযোগিতায় একাধিকবার রানার আপও হয়েছে। এছাড়া দৈনিক প্রথম আলো’র ভাষা প্রতিযোগে (২০১৬) এই প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী আফিয়া আরাফ খেয়া জাতীয় পর্যায়ে দ্বিতীয় স্থান দখল করে। আরেক শিক্ষার্থী ফারহান রওনক অর্ণব আন্তর্জাতিক ফিজিক্স অলিম্পিয়াডে তৃতীয় হয়। চলতি বছর দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) আয়োজিত বিতর্ক প্রতিযোগিতায় স্কুলটি জাতীয় পর্যায়ে সেরা আট-এ উত্তীর্ণ হয়। এছাড়াও গণিত অলিম্পিয়াড, নাচ, গান এবং নাটকেও কৃতিত্ব দেখিয়ে চলেছে প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা।প্রতিষ্ঠানটিকে আজকের এই অবস্থানে তুলে আনার পেছনে যাদের অবদান সবচেয়ে বেশি তাদের একজন হলেন প্রতিষ্ঠাকালীন অধ্যক্ষ প্রয়াত তাজমিলুর রহমান। সাবেক শিক্ষার্থীদের অনেকেই পু-্রকথাকে বলেছেন সহশিক্ষা কার্যক্রমের শুরুটাই করেছিলেন তাজমিলুর রহমান। ওই স্কুলের প্রাক্তন শিক্ষার্থী বগুড়া সরকারি আজিজুল হক কলেজের সহকারী অধ্যাপক শফি মাহমুদ বলেন, ‘তাজমিলুর রহমান স্যার প্রতি বৃহস্পতিবার বিতর্ক, উপস্থিত বক্তৃতা এবং লেখালেখির ক্লাস আমাদের জন্য বাধ্যতামূলক করেছিলেন। তিনি প্রতি মাসে আমাদের লেখা নিয়ে দেওয়ালিকা প্রকাশ করতেন। সেটা প্রেস থেকে ছাপিয়ে প্রকাশ করা হতো। মুলত তাঁর হাত ধরেই স্কুলটি পরিপূর্ণ একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসেবে দাঁড়িয়ে গেছে।’

শিক্ষাবিদ তাজমিলুর রহমানের দেখানো পথেই হেঁটেছেন প্রাক্তন অধ্যক্ষ রেজাউন নবী মুন্সী এবং তোফাজ্জল হোসেন। এ দু’জনের মাঝে রেজাউন নবী মুন্সী পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করেছেন। তোফাজ্জল হোসেন ২০১৭ সালের গোড়ার দিকে অবসরে গেছেন। তিনি ২০০৪ সালে যোগদানের পর থেকেই বগুড়া আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন পাবলিক স্কুল ও কলেজকে আদর্শ একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তোলায় মনোযোগী হন। তাঁর মেয়াদকালেই প্রতিষ্ঠানটি পিইসি পরীক্ষায় রাজশাহী বিভাগে তৃতীয় এবং পঞ্চম স্থান দখল করে। একইভাবে জেএসসি, এসএসসি এবং এইচএসসি পরীক্ষায়ও বোর্ডের সেরা বিশ-এর তালিকায় একাধিকবার স্থান করে নেয়। এমনকি বিতর্ক প্রতিযোগিতা, ভাষা প্রতিযোগ এবং বিজ্ঞান অলিম্পিয়াডের মত সৃজনশীল সব আয়োজনে স্কুলটির ধারাবাহিক সাফল্য পায়। প্রাক্তন ছাত্র বর্তমানে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের প্রভাষক রাহাত মিনহাজ বলেন, ‘ব্যাটালিয়ন স্কুলের শিক্ষকরা আমাদের সব সময় বিনয়ী এবং সত্যবাদী হওয়ার কথা বলতেন। অধ্যক্ষ তোফাজ্জল হোসেন এবং শরীর চর্চা শিক্ষক গোপাল চন্দ্র দাস আমাদেরকে শিক্ষার প্রকৃত উদ্দেশ্য সম্পর্কে বুঝিয়ে বলতেন। তাঁদের সেই কথাগুলো আমি পরবর্তীতে উচ্চ শিক্ষা অর্জনের সময় এবং আজ কর্মজীবনেও লালন করে চলেছি।’

প্রাক্তন অধ্যক্ষ তোফাজ্জল হোসেন ব্যাটালিয়ন স্কুলে তাঁর কর্মময় জীবনের স্মৃতিচারণ করে বলেন, ‘আমি মনে করি শুধু সিলেবাস অনুযায়ী পড়লে রেজাল্টই ভাল হবে। তবে পুরো বিশ্বকে জানতে হলে, দেশ প্রেমিক এবং মানব প্রেমিক হতে হলে সহশিক্ষাকে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। আমি আমার কর্মজীবনে সেটা বাস্তবায়নের চেষ্টা করেছি। প্রথম দিকে আমাকে খুব কষ্ট করতে হয়েছে। তিনটা বছর দিন-রাত পরিশ্রম করেছি। সেই পরিশ্রমের ফলটা আজ পাওয়া যাচ্ছে। আমি বিশ্বাস করি ব্যাটালিয়ন স্কুল ও কলেজ অনেক দূর এগিয়ে যাবে।’
বর্তমান অধ্যক্ষ এটিএম মোস্তফা কামাল জানান, পাঠদান বলতে শুধু পুঁথিগত বিদ্যায় তারা বিশ্বাসী নন। পাঠ্যবইয়ের বাইরেও যে অনেক কিছু শেখার আছে, তার প্রতি শিক্ষার্থীদের আগ্রহী করে তোলা হয়। শিক্ষার্থীরা যাতে সবকিছুই আনন্দের সঙ্গে গ্রহণ করতে পারে সেই চেষ্টা তাদের থাকে। তিনি বলেন, ‘আমরা দুর্বল শিক্ষার্থীদের প্রতি সব সময়ই যতœবান। তাদের জন্য বিশেষ ক্লাসও নেওয়া হয়। আগামীতে সব পরীক্ষার্থীই যাতে জিপিএ-৫ পেয়ে উত্তীর্ণ হতে পারে সেই লক্ষ্য নিয়েই আমরা এগিয়ে যাচ্ছি। এজন্য অভিভাবকদের সহযোগিতা প্রয়োজন।’