৪৮ বছরেও সংরক্ষণ করা হয়নি

বগুড়ার প্রথম বধ্যভূমিঃবামাচরণ মজুমদারের কাচারি বাড়ি

মুক্তিযোদ্ধা মাসুদার রহমান হেলাল
প্রকাশ: ১৬ ডিসেম্বর ২০১৯ ০২:৪৪ ।
প্রচ্ছদ
পঠিত হয়েছে ৪১৬ বার।

একাত্তরে ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সবাইকে মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি গ্রহণের নির্দেশ দিয়েছিলেন। যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে তিনি ঘরে ঘরে দূর্গ গড়ে তুলতে বলেছিলেন। বঙ্গবন্ধুর সেই নির্দেশনা অনুযায়ী স্কুল-কলেজের ছাত্রদের নিয়ে যখন শহরের বিভিন্ন মহল্লায় ‘স্বেচ্ছাসেবক ব্রিগেড’ গঠনের কাজ শুরু করি তখনই খবর পেলাম আমাদের গ্রাম শিবগঞ্জের ময়দানহাটার যুবকরা পাক হানাদারদের মোকাবেলার জন্য ঐক্যবদ্ধ হচ্ছেন। তারা মজুমদারপাড়ায় জমিদার বামাচরণ মজুমদারের কাচারি বাড়িতে নিয়মিত বৈঠক করছেন। অস্ত্র বলতে জমিদার বামাচরণ মজুমদারের দু’টি বন্দুকই তাদের সম্বল। বর্বর পাকিস্তানী সেনাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য আরও অস্ত্র কিভাবে সংগ্রহ করা যায় তা নিয়েও আলোচনা চলত তাদের। 
পঁচিশে মার্চ রাতে রংপুর ক্যান্টনমেন্ট থেকে রওনা হওয়া পাকিস্তানী হায়েনার দল পরদিন সকালে বগুড়া শহরে প্রবেশের চেষ্টা করে। তবে আমাদের প্রতিরোধের মুখে তারা পিছু হটে। ওইদিন তারা শহরের বৃন্দাবনপাড়ায় সিএন্ডবি’র (বর্তমানে সড়ক ও জনপথ বিভাগ) রেস্ট হাউজে অবস্থান নেয়। তবে সেখানেও তাদের লক্ষ্য করে আক্রমণ চালানো হলে বাধ্য হয়ে তারা পরদিন ২৭ মার্চ রাতে রংপুরে ফিরে যায়।
পাকিস্তানী সেনারা যাতে আর কখনও বগুড়ায় ঢুকতে না পারে সে জন্য পরে পাশের গাইবান্ধা জেলার (তখন রংপুর জেলার মহকুমা ছিল) কাটাখালিতে বগুড়া-রংপুর মহাসড়কে নির্মিত সেতু ধ্বংস করা হয়। ওই সেতুর অবস্থান আমার গ্রামের বাড়ি ময়দানহাটা থেকে কমবেশি ১৫ কিলোমিটার দূরে। তবে গুরুত্বপূর্ণ কাটাখালি সেতু ধ্বংসের খবর হানাদার বাহিনীর কাছে পৌঁছার পর পরই তারা নদীতে বাঁশ ও কাঠ ফেলে বিকল্প যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে তোলার পরিকল্পনা করে। এজন্য তারা এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে সেখানে অবস্থান নেয়। ওই সময় সেখানকার  মুসলিম লীগ নেতৃবৃন্দ হায়েনাদের জানায় যে, ময়দানহটার জমিদার বামাচরণ মজুমদার তার বাড়িতে মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় দিয়েছেন এবং তারই নির্দেশে কাটাখালি সেতু ধ্বংস করা হয়েছে। 
যা হোক প্রায় ৫/৭ দিন ধরে কাটাখালি এলাকায় নদীতে বাঁশ ও কাঠ ফেলে যানবাহন পারাপারের ব্যবস্থা হওয়ার পর হানাদার বাহিনী আবারও বগুড়া শহরে প্রবেশের পরিকল্পনা করে। তাদের এ পরিকল্পনার খবর বগুড়া সার্কিট হাউসে খোলা কন্ট্রোল রুমে কর্মরত তোতা মিয়া নামে এক হাবিলদারের মাধ্যমে আমরা জানতে পরি। ১৩ এপ্রিল তিনি জানান, পাকিস্তানী সেনারা দু-একদিনের মধ্যে বগুড়া শহরে ঢুকে পড়বে। তখন আমিসহ শহরে অবস্থানরত মুক্তিযোদ্ধারা ওইদিনই বিভিন্ন স্কুলের ক্যাম্পগুলোতে রাখা অস্ত্র-শস্ত্র নিরাপদ স্থানে রেখে ভারতে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিই। বগুড়া করনেশন স্কুল ক্যাম্পে আমার রাখা পাঁচটি থ্রি নট থ্রি রাইফেল, ১টি চাইনিজ রাইফেল, একটি রিভলবার, ১০টি হ্যান্ড গ্রেনেড ও বিপুল পরিমাণ গুলি (নন্দীগ্রাম থানাসহ বিভিন্ন স্থান থেকে লুট করা) নিয়ে আমি আমার গ্রামের বাড়ি ময়দানহাটার মোস্তফাপুরের উদ্দেশ্যে রওনা দিই। এরপর সেগুলো ওই গ্রামের শুকুর উদ্দিন শুকরার বাড়িতে রাখি। গ্রামে থাকতেই খবর পাই ১৬ এপ্রিল শুক্রবার হায়েনারা বগুড়া শহরে ঢুকে পড়েছে। পরদিন ১৭ এপ্রিল শনিবার বিকেলে তারা একটি জিপ এবং দু’টি ট্রাকে ভারী অস্ত্র-শস্ত্র নিয়ে ময়দানহাটায় আসে। সেদিন ছিল হাটবার। বিকেল ৪টার দিকে তারা হাটে প্রবেশের পর আমার বড় ভাই রাজুকে থামিয়ে তার মাথার চুল ধরে টানাটানি করে। তবে যেহেতু তাদের টার্গেট ছিল হাটের অদূরে বামাচরণ মজুমদারের জমিদার বাড়ি, তাই হাটে আসা লোকজনদের কোন কিছু না বলে তারা এগিয়ে যেতে থাকে। এরপর ওই বাড়িতে বর্বরোচিত হত্যাকাÐ ঘটায়। তারা বামাচরণের ছোট ছেলেসহ ১৩জনকে হত্যা করে। পরে লাশগুলো কাচারি বাড়ির পাশের জমিতে পুঁতে রাখা হয়। সেটিই বগুড়া জেলার প্রথম বধ্যভূমি। হত্যাযজ্ঞ শেষে পাকিস্তানী সেনারা প্রায় ৩ হাজার বিঘা জমির মালিক বামাচরণের বাড়িতে রাখা নগদ টাকা-পয়সা ও স্বর্ণালংকার এবং মজুদ করা ধান-চাল ও পাট লুট করার সুযোগ করে দেয়। লুটপাট শেষে তারা ওই বাড়িটিতে আগুন ধরিয়ে দেয়।  
ওইদিন বামাচরণ মজুমদারের বাড়িতে প্রায় দেড় ঘন্টা ধরে হত্যাযজ্ঞ চালানোর পর হায়েনারা যখন ফিরে যাচ্ছিল তখন আমিসহ কয়েকজন তাদের ওপর আক্রমণের জন্য পাশে মংলাসরের দিঘী এলাকায় অবস্থান নিই। কিন্তু যার বাড়িতে আমি অস্ত্র-শস্ত্র মজুদ রেখেছিলাম সেই শুকুর উদ্দিন এবং তার প্রতিবেশি এলাহী প্রামাণিকসহ প্রায় অর্ধশত মানুষ আমাদেরকে বাধা দেন। তারা বলেন- বাবা তোমরা ওদের (পাক হায়েনা) ওপর আক্রমণ করলে ওরা পুরো গ্রাম জ্বালিয়ে দিবে। মূলত গ্রামবাসীর অনুরোধেই আমরা তখন হামলার পরিকল্পনা থেকে সরি আসি এবং পরদিন ভারতের উদ্দেশ্যে রওনা হই।
বামাচরণ মজুমদার মুক্তিযুদ্ধকালে শিবগঞ্জ থানা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি ছিলেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ৭ই মার্চের ভাষণের মাধ্যমে দেশবাসীকে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে বললে তাদের গ্রামের তরুণ ও যুবকরা তাতে উদ্বুদ্ধ হন। কিভাবে যুদ্ধের প্রস্তুতি নেওয়া যায় সে ব্যাপারে পরামর্শের জন্য অনেকে তাদের বাড়িতে যেতেন এবং বামাচরণ মজুমদারের সঙ্গে পরামর্শ করতেন। পাকিস্তানি সেনারা ১৭ এপ্রিল বিকেলে ভারী অস্ত্র-শস্ত্র নিয়ে বামাচরণ মজুমদারের বাড়ির সামনে এসে এলোপাথারি গুলি চালানো শুরু করে। তখন তার ছোট ছেলে তুষার কান্তি মজুমদার টবলুও ভেতর থেকে পাল্টা গুলি চালাতে শুরু করে। তবে ঝাঁকে ঝাঁকে গুলির মুখে সে বেশিক্ষণ টিকে থাকতে পারেনি। মুহুর্তের মধ্যেই তার দেহ লুটিয়ে পড়ে। প্রাণ হারান তাদের বাড়ির নেপালি প্রহরী চন্দ্র বাহাদুরও। ওই পরিস্থিতিতে বামাচরণ মজুমদার তার বড় ছেলে পীযুষ কুমার মজুমদারসহ পরিবারের অপরাপর সদস্যদের নিয়ে কৌশলে বাড়ির পেছন দিক দিয়ে অন্যগ্রামে আশ্রয় নেন। পরবর্তীতে তারা ভারতে চলে যান। যে ১৩জনকে হত্যা করা হয় তাদের মধ্যে ১২জনের নাম জানা গেছে। তারা হলেন-বামাচরণ মজুমদারের ছোট ছেলে তুষার কান্তি মজুমদার, তাদের স্বজন কালিপদ মজুমদার, অরুণ কান্তি মজুমদার, অনিল কুমার মজুমদার, সুরেশ ঘোষ, পাঁচ কড়ি ঘোষ, চেরু ঘোষ, বিষু ঘোষ, দীপু ঘোষ, ললিত সোনার, ক্যাম্প কমাÐার (ইপিআর সদস্য) আব্দুস সাত্তার ও প্রহরী চন্দ্র বাহাদুর (নেপালি)।
স্বাধীনতার পর আমরা শুনেছি ১৭ এপ্রিল জমিদার বামাচরণের কাচারি বাড়িতে হত্যাকাÐের পর পাকিস্তানী বর্বর সেনারা গ্রামের লোকজনকে তাদের বাড়িতে লুটপাট চালাতে বলে এবং পরে আগুন ধরিয়ে দেয়। এমনকি জমিদারি স্টেটের সব দলিল ও নথিপত্রও জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। বামাচরণ মজুমদারের পরিবারের পক্ষ থেকে পরবর্তীতে বলা হয়েছে, ওই বাড়ি থেকে সেদিন প্রায় ৫০০ ভরি স্বর্ণালংকার, নগদ পাঁচ লাখ টাকা, চারটি গোলায় রাখা ৪ হাজার মণ ধান, ২০০ মণ চাল, দেড় হাজার মণ পাট, ২৫০ বান্ডিল ঢেউ টিন, ৮মণ আখের গুড়, দু’টি বাস, একটি জিপগাড়ি, একটি প্রাইভেট কার, পাঁচটি মোটর সাইকেল এবং ১৫টি বাই-সাইকেল এবং নতুন বাড়ি নির্মাণের জন্য রাখা বিপুল সংখ্যক মজুদ করা ইট লুট করা হয়।
দুঃখের বিষয় হলো-বামাচরণ মজুমদারের বাড়ি সংলগ্ন স্থানটি বগুড়ার প্রথম বধ্যভূমি হলেও সেটি সংরক্ষণ এবং সেখানে আজ পর্যন্ত কোন সৌধ নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। বরং সেখানে এখন ফসল চাষ করা হচ্ছে। স্বাধীনতার পর তৎকালীন রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী ১৯৭২ সালের ২১ জুলাই বগুড়ার মহাস্থান মাজার জিয়ারত করতে আসলে স্থানীয় গ্রামবাসীর পক্ষ থেকে বামাচরণ মজুমদারের বাড়ির সামনের ওই বধ্যভূমিটিকে সংরক্ষণ এবং তাতে একটি সৌধ নির্মাণের দাবি জানানো হয়েছিল। তখন রাষ্ট্রপতি আবু সাঈদ চৌধুরী আশ্বাসও দিয়েছিলেন। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সেটি এখন পর্যন্ত বাস্তবায়ন হয়নি।