ছোটগল্পঃ অপ্রাপ্তি

সাজিয়া আফরিন সোমা
প্রকাশ: ২৪ ডিসেম্বর ২০১৯ ১০:৩৩ ।
প্রচ্ছদ
পঠিত হয়েছে ৩৮১ বার।

সকাল সকাল ঘুম ভেঙ্গে গেলো রুমকির, জানালার পর্দা সরিয়ে ফেলতেই চোখ পড়লো গ্রিলে বসে থাকা পাখি দুটির দিকে। পাশাপাশি বসে আছে, হালকা রোদের আভা এসে পড়েছে ওদের গায়ে। সারাদিনের ছোটাছুটি শুরু হবে তাই হয়তোবা জুড়িয়ে নিচ্ছে। আচ্ছা, ওদের কি মান-অভিমান হয়! ওদের অনুভূতিগুলো কেমন, ওদের ও কি কষ্টগুলো এমনই তীব্র? রুমকি এতোটায় আনমনে ছিলো যে- জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকার সময় কখন যে চোখ থেকে পানি গড়িয়ে গালে এসে পৌঁছেছে সেটা শুভ না বললে হয়তবা সে বুঝতেই পারতো না।

কি হয়েছে রুমকি, মন খারাপ? বাড়ির কথা মনে পড়েছে? অস্থির হয়ে জানতে চায় শুভ! ঠিক এভাবেই শুভ বোঝে রুমকিকে! 

সত্যিই তো খুব মনে পড়ছে বাবা-মার কথা, পুকুর পাড়ের বকুল গাছটার কথা, কতদিন দেখেনি তাদের, কতদিন হলো বকুল গাছটার নিচে একটু বসেনি রুমকি! শুভকে বলবে বলবে করেও বলা হয়নি। কিন্তু তার মন খারাপ জানার পর শুভ পরের দিন অফিস শেষ করে ঠিকই নিয়ে গিয়েছিলো বাবার বাড়ি। একসময় শুভ কথা দিয়েছিলো প্রতি সপ্তাহের শেষে ওকে বাবা- মার সাথে দেখা করাতে নিয়ে যাবে। হ্যা কথা রেখেছিলো সে।

রোজ রাতে বাড়ি ফেরার পর কথার ঝুড়ি নিয়ে বসতো শুভ। রুমকির বলতে ভাল লাগতো না, তবে ওর কথাগুলো শুনতো মন দিয়ে। সারা দিনের যত কথা সব বলতো শুভ,আর রুমকি শুধু শুনতো। ছুটির দিনে দুজন ঘুরতে বের হতো, আগে ঘুরতে রুমকির বেশ লাগতো তবে এখন আর সেভাবে মন লাগেনা কিছুতেই। আনমনে বসে ভাবনাতেই দিন চলে যায়।

ইদানিং রোজ একই স্বপ্ন দেখে রুমকি, দেখে- সাদিক হাত বাড়িয়ে আছে ওর দিকে,রুমকি হাতটা ধরার আগেই সাদিক হাতটা ফিরিয়ে নিয়ে চলে যাচ্ছে ওকে পেছনে ফেলে। কষ্টে চিৎকার করে উঠতেই ঘুমটা ভেঙ্গে যায়। তারপর সারাটা রাত নির্ঘুম কেটে যায় তার। বেশ কিছু দিন এমনই কাটছে রুমকির।

কলেজে অনেক বন্ধু ছিলো, সবার সাথে মজার সময় কাটতো। আড্ডা আর আড্ডা। একজন না এলে বাকিরাও বসে থাকতো এলে তবে আড্ডা শুরু। মাঝে মাঝে সবাই মিলে কোন একজনের বাসায় আড্ডা খাইদাই। মজার সময় পার করেছে ওরা। সবার মাঝেই ছিলো সাদিক। একসময় মনে হতে শুরু করলো ওকে না দেখলে যেনো দিনটা অনেক বড় হয়ে যেতো! কিছুই যেনো ভাল লাগতো না। সম্পর্কটা বাড়তে থাকে, পড়াটা শেষ হওয়ার আগেই দুজনের ছেলেমানুষির ফল একা রুমকিকে ভোগ করতে হলো। সাদিক কোন দায়িত্ব নিতে নারাজ, আর শেষ মুহূত্বে রুমকির সিদ্ধান্ত নেওয়ার কোন সুযোগও ছিলো না। দিনগুলি একাকী কাটতে থাকে তার। কত ভাবনা, কত মিষ্টি অনুভূতি, কত ভয়! নিজের অংশকে নিজের থেকে আলাদা করার কষ্ট সবই সে একাকী সব অনুভব করেছে! কখনও সাদিক আর তাদের খবর নেয়নি।

শুভোর সাথে রুমকির বিয়েটা ঠিক করে ফেলে বাড়ি থেকে। কিন্তু রুমকি কোন কিছু গোপন করে বিয়ে করবে না। তাই শুভকে ডেকে সব বলবে বলে সিদ্ধান্ত নেয়।

রুমকি: ভাইয়া তোমাকে কিছু কথা বলা এবং তোমার জানা খুব দরকার। শুভ থামিয়ে দেয় রুমকি কে।

শুভ: আমি সব জানি, জেনেই তোকে বিয়ে করতে চাই।

রুমকি: তুমি জানো হয়তো সাদিকের কথা, যেটে কে তুমি স্বাভাবাবিক ভাবেই নিয়েছো। কিন্তু আমার জীবনের আরও অনেকটা তুমি জানো না। যেটা তোমার জানা খুব প্রয়োজন।

শুভ : Congratulations রুমকি, মা হওয়ার জন্য! যে ভীতু সে তোকে ছেড়ে গেছে কিন্তু তুই হার মানিসনি। আমি তোর পাশে আছি সব সময়।

রুমকি: তুমি জানো? তাহলে জেনেও কেনো চুপ করে আছো? কেনো আমাকে কিছু বলোনি?

শুভ : চুপ করে নেই তো, তোকে বিয়ে করবো বলেছিতো। আর ছেলেকে আমাদের মতো করে আমরা বড় করবো।

রুমকি সেদিন আর কিছু বলতে পারেনি। কি হতে পারে এর উত্তর সেটা রুমকির জানা নেই। কদিনের মধ্যেই ওদের বিয়ে হয়ে যায়। এবার ছেলেকে নিজের কাছে নিবার সব ব্যাবস্থা করতে হবে। বেশ কিছুদিন হয় ছেলেটাকে দেখেনি রুমকি। এবার আর লুকিয়ে লুকিয়ে দেখতে যাবে না, এবার একেবারে নিতে যাবে ওকে। খুব মনটা ভাল তাই রুমকির। মনে মনে ছেলেকে কত কিছু বলে চলেছে সারাদিন!! "জানিস বাবা তুই যখন তোর মা’র শরীরে তখন কত কিছু ভাবতাম, কার মতো হবে দেখতে, হাত পা গুলো কেমন হবে। তোর প্রথম নড়া আমাকে আনন্দে আত্মহারা করে দিয়েছিলো। তোকে নিয়ে কত স্বপ্ন বুনেছিলাম, কত সুন্দর সুন্দর নাম ভেবেছিলাম তোর জন্য। কিন্তু পুরণ হয়নি কত কিছু,তোকে ছুঁয়ে দেখতে পারিনি, বুকে নিতে পারিনি। এবার দেখিস তোকে নিয়ে সব স্বপ্ন পুরন করবো, আর কটাদিন একটু কষ্ট কর মা'কে ছাড়া, তারপর তোর আর আমার মনে কোন কষ্ট থাকবেনা"- মনে মনে বলে রুমকি! 

রুমকি পানিতে হাত দিয়ে পানি সহ পোনা গুলোকে তুলছে আবার ছাড়ছে, আবার তুলছে। এতো এতো মাছের পোনা একসাথে ঘুরছে দেখতেই ভাললাগছে তার। বর্ষার পানিতে ভরে গেছে পুকুরটা। শুভ যাবার সময় দেখে রুমকি এসব নিয়ে ব্যস্ত। রুমকি শুভকে দেখেই চিৎকার করে উঠলো। ভাইয়া দেখো কত্তো মাছের পোনা! শুভ মুখ বাঁকিয়ে বলে ছি: এগুলা তো ব্যাঙ্গের ছা । ওয়াক!!! বলে এক লাফে উপরে উঠে আসে রুমকি। কি বলো ভাইয়া? ঠিকই তো, আরে দেখ কেমন পেট মোটা আর নিচের দিকে কেমন! এবার দেখ তোর হাতে কি হয়, ছি:! বলেই সে হাটতে শুরু করে। খুব রাগ হয় রুমকির! রুমকি রাগ নিয়েই শুভ'র চলে যাওয়া দেখতে থাকে। রাতে সবাই মিলে বসে গল্প করছে, ভূতের গল্প।

যখনই খালার বাসায় বেড়াতে আসে তখন চিন্তা থাকে এত্তো এত্তো ভূতের গল্প শুনবে। সেসব গল্প শুনে ভয় পেয়ে একা ঘুরতে সাহস হয়না তবুও শুনবে। আর শুভ ভাইয়ার চেষ্টা থাকে সবাইকে আরো কি করে ভয় দেখানো যায়! জানিস বাবা আজ তোকে দেখতে এসে হঠাৎ মনে পড়ে গেলো আমাদের সেই ছেলেবেলার দিন গুলি- মনে মনে ভাবে রুমকি!

রুমকি সপ্তাহে একদিন দেখতে আসে,আসতে ইচ্ছে করে, নিজের ভূল তাকে এখানে টেনে আনে! কত না বলা কথা এখানে এসে বলে যায় সে! ঘর ভরা খেলনা, পোষাক সব গুছিয়ে রাখা, কত কথা বলবে ভেবেছিলো রুমকি তার ছেলের সাথে, কিন্তু কোন কথা তাকে বলতে পারেনি রুমকি!

যখন তোকে নিতে গেলাম, তখন তো তুই তোর মার উপর অভিমান করে চলে গেছিস। তোকে নিয়ে ঠিকই এসেছি, তবে তোর জন্য খেলনায় সাজানো ঘরে নয়, সেই পুরোনো পুকুর পাড়ে শুভর লাগানো প্রিয় বকুল গাছটার নিচে- ছেলের কবরের পাশে দাড়িয়ে মনে মনে বলে রুমকি!