দুই প্রকৌশলীর আয়োজনে ভারতীয় সড়কে অভূতপূর্ব বিক্ষোভ

পুণ্ড্রকথা ডেস্ক
প্রকাশ: ২৫ ডিসেম্বর ২০১৯ ০৯:৪২ ।
প্রচ্ছদ
পঠিত হয়েছে ৭৮ বার।

দক্ষিণ দিল্লির একটি ছোট্ট কোণে কর্মজীবী মানুষের বসবাস। বিস্তারে এটি আধামাইল হবে। রাজধানীর কাছের একটি উপশহরের পাশেই ছয় লেনের মহাসড়ক। গত ১০ দিন ধরে এই সড়কটি অবরোধ করে রেখেছেন স্থানীয়রা।

রাস্তাজুড়ে অবস্থান করে আছেন কয়েকশ নারী-পুরুষ। নারীদের পরনে বোরকা। সঙ্গে শিশুরাও। বর্ণবাদী নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনের বিরুদ্ধে শাহিনবাগের রাস্তা দখল করে বসে আছেন তারা।

এ আইন বাতিলের দাবিতে ভারতজুড়ে বিক্ষোভ অব্যাহত রয়েছে। গত ১২ ডিসেম্বরে শুরু হয় এই ক্ষোভ প্রদর্শন।

মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রতিবেশী বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও আফগানিস্তান থেকে অমুসলিমদের নাগরিকত্ব দেয়ার কথা রয়েছে ওই আইনে।

বিক্ষোভ কখনও কখনও সহিংসতায়ও রূপ নিচ্ছে। এখন পর্যন্ত ২৫ জন নিহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। কিন্তু শাহিনবাগের বিক্ষোভ একেবারেই শান্তিপূর্ণ।

জটিল নেটওয়ার্কের মতোই শতাধিক লোকের একটি স্বেচ্ছাসেবী দল পালাক্রমে এতে কাজ করেন। বিক্ষোভ নিয়ন্ত্রণ, খাদ্য, বিছানা ও ওষুধসহ সবকিছু সরবরাহ করছেন তারা।

মুসলমান অধ্যুষিত অঞ্চলটির একপাশে বিশাল মহাসড়ক। এই সড়কেই বিক্ষোভে অংশ নিয়েছেন একাধিক দল ও উপদল।

তাবিশ কামার নামে একজন ব্যাংকার চারজনের একটি নিরাপত্তা দল চালান। দিনে অফিসে থাকেন, রাতে বিক্ষোভে কাটান।

আর প্রকৌশল বিদ্যার শিক্ষার্থী ওয়াহিদ রেজা দুই থেকে তিনশতাধিক লোকের দায়িত্বে। বিক্ষোভকারীদের দুপুর ও রাতের খাবারের আয়োজন করেন তিনি। খাবারের তালিকায় রয়েছে প্লেটভর্তি গোশত ও বিরিয়ানি।

পড়াশোনা থেকে বর্তমানে এই শিক্ষার্থী ছুটিতে রয়েছেন। তিনি বলেন, কেউ যাতে ক্ষুধার্ত না থাকেন, সেটি নিশ্চিত করাই আমার কাজ।

কাছের একটি ক্লিনিক ও ঔষধালয়ে কাজ করেন ১৯ বছর বয়সী উমাইর খান। বিক্ষোভকারীদের তিনি চিকিৎসাসেবা দেয়ার ব্যবস্থা করেন। কিন্তু সহিংসতা না থাকায় এখানে তেমন কোনো চিকিৎসাসেবার দরকার পড়ে না।

দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রাণিবিদ্যা বিভাগের শিক্ষার্থী হুমাইরা সাইয়েদ। তার দায়িত্বে ৩০ নারীর একটি স্বেচ্ছাসেবী দল। নারী বিক্ষোভকারীরা যাতে খাবার, চিকিৎসা ও বিশ্রাম নিতে পারেন, সেই দায়িত্ব এই ছাত্রীর।

হুমাইরা বলেন, নারীদের কাছে প্রথমে আমি আবেদন জানিয়েছিলাম, যাতে রাত ১০টার পর তারা এখানে অবস্থান না করেন।

মাথা তার গোলাপি রঙের হিজাবে ঢাকা। বললেন, রাত ১০টার পর বাসায় চলে যেতে বললেও তারা যান না। নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন বাতিল না করা পর্যন্ত তারা বিক্ষোভ চালিয়ে যাওয়ার কথা বলেন।

পুলিশের উপকমিশনার চিন্ময় বিসওয়াল বলেন, তিনি বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে আলোচনা করেছেন। শিগগিরই ওই রাস্তা খালি হয়ে যাবে। বিক্ষোভে স্থানীয়দের সমর্থন কমে গেলেই তারা চলে যাবেন।

কিন্তু বিক্ষোভ বন্ধ হওয়ার আভাস খুব একটা দেখা যাচ্ছে না। জায়গাটির মাঝখানে একটি অস্থায়ী মঞ্চ রয়েছে। একটি নীল ত্রিপলের নিচে এটির অবস্থান। ভারতীয় জাতীয় পতাকার সঙ্গে ফেস্টুনও রয়েছে। এ ছাড়া লাউডস্পিকার ও সিসিটিভিও বসিয়েছেন বিক্ষোভকারীরা।

এই জটিল সাংগঠনিক অভিযানের মূলে রয়েছেন দুই প্রকৌশলী আসিফ মুজতবা ও শার্জিল। তারা ভারতের অভিজাত ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি (আইআইটি) থেকে প্রশিক্ষিত।

মুজতবা বলেন, তিনি ও শার্জিল স্বেচ্ছাসেবীদের শনাক্ত করেন। বাইরের এলাকা থেকে স্পিকার ভাড়া করে নিয়ে আসেন। প্রতিনিধিদের কাজ বুঝিয়ে দেন। বিক্ষোভকারীরা যাতে পুলিশের সঙ্গে কোনো সংঘর্ষে না যান, তা নিশ্চিত করেন।

এতে তহবিলদাতাদের মধ্যে রয়েছেন হিন্দু পরিবার থেকে আসা সিদ্ধার্থ সাক্সেনা নামের একজন হিসাবরক্ষক। স্থানীয় বাসিন্দারা তার কাছে ১০ হাজার রুপি গচ্ছিত রেখেছেন। এসব অর্থের অধিকাংশই ব্যানার, ফেস্টুন ও অন্যান্য সরঞ্জামক্রমে খরচ করেন।

কিন্তু অধিকাংশ অর্থই এসেছে বিভিন্ন মানুষের দান থেকে, যা জাজিম, সরঞ্জামাদি ও অসংখ্য চায়ের কাপের জন্য ব্যয় করা হচ্ছে। তীব্র শীতে শরীর গরম রাখতে চা এখানে অপরিহার্য একটি উপাদান।

যখন এমন একটি বিক্ষোভের পরিকল্পনা করা হয়, মুজতবা ও শার্জিল সেখানে বিভিন্ন ঝুঁকি-অনিশ্চয়তা নিয়েও সজাগ ছিলেন। তারা আইনি জটিলতার ফাঁদে কিংবা নিজেদের ক্যারিয়ারও হুমকিতে পড়তে পারে।

কিন্তু পরিণতি যা-ই আসুক না কেন, তার তা মেনে নেয়ার সিদ্ধান্ত নেন। মুজতবা বলেন, গতকাল পর্যন্ত আমাদের মনে হয়নি, আমি আমার অধিকারের পক্ষে সরব হতে পেরেছি। কালকে যা ঘটবে, অন্তত আমি খুশি হব, আমরা কিছু একটা করতে পেরেছি।