‘একটি ‘ত’-এর জন্যও হয়তো দেশছাড়া হতে হবে’

পুণ্ড্রকথা ডেস্ক
প্রকাশ: ৩১ ডিসেম্বর ২০১৯ ০৫:৫১ ।
প্রচ্ছদ
পঠিত হয়েছে ৭৭ বার।

কনকনে শীতের সকাল। ঘড়িতে সাতটা বাজে। কিন্তু ততক্ষণে ডাকঘরে তৈরি হয়ে গিয়েছে প্রায় আড়াইশো জনের লাইন। ভারতের জলপাইগুড়ি শহরে প্রধান ডাকঘরের চিত্র এটি। এ নিয়ে বিশেষ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে পশ্চিমবঙ্গের প্রভাবশালী সংবাদ মাধ্যম আনন্দবাজার পত্রিকা।

লাইনে দাঁড়ানো একজ নারীর নাম লুতফা। ভোটার কার্ডে তার নামের বানান ভুল এসেছে। নামের বানানে ‘ৎ’ ছাপা হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে তা হবে ‘ত।’ বানান ঠিক করতে বাড়ি থেকে বের হতে হয়েছে ভোর পাঁচটায়।

সোমবার প্রায় ৩৫ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে লুতফা যখন জলপাইগুড়ি শহরে প্রধান ডাকঘরে পৌঁছলেন তখন প্রধান ডাকঘরের লাইন উপচে বেরিয়ে এসেছিল রাস্তায়।

ডাকঘর সূত্রের বরাত দিয়ে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, ওইদিনের লাইনে জলপাইগুড়ি শহরের প্রধান ডাকঘরে প্রায় হাজার মানুষ লাইনে দাঁড়িয়েছেন।

ডাকঘরে নতুন কার্ড বানানোর বা সংশোধন করার জন্য টোকেন দেওয়া হয়। আগের রাত থেকে অপেক্ষা করে সবাই টোকেন নেন। টোকেনের সঙ্গে একটি তারিখ দেওয়া হয়। সেই তারিখে এসে কার্ডের কাজ করতে হয়। ওই দিন মাত্র ৫০০ জনকে টোকেন দেওয়া হয়েছে। বাকিদের ফিরতে হয়েছে খালি হাতেই।

ময়নাগুড়ির ভোটপট্টির বাসিন্দা লুতফা বেগম জানালেন, তাঁর ভোটার কার্ডে বানান লেখা রয়েছে ‘লুতফা’ কিন্তু আধার কার্ডে সেটাই হয়ে গিয়েছে ‘লুৎফা। আধারের বানান সংশোধন করতে শীতের ভোরে বাড়ি থেকে বেরতে হয়েছে তাঁকে। এত তাড়াহুড়োর কী রয়েছে?

কৃষক পরিবারের সদস্য লুতফার উত্তর, ‘‘এতদিন তো এমনই ছিল, চিন্তা করিনি। এখন দিনকাল ভাল না। হয়তো ওই ‘ৎ’-এর জন্য দেশছাড়া হতে হবে। আবার কী সব ক্যাম্পও আছে শুনছি।’’

এমনই নানা ভয় নিয়ে জেলার নানা জায়গা থেকে আসা বাসিন্দারা ভোর থেকে লাইন দিয়েছেন জলপাইগুড়ির প্রধান ডাকঘরে। কেউ এসেছেন সংশোধন করাতে, কেউ বা নতুন আধার কার্ড করাতে।

মাথাভাঙার ইচ্ছাগঞ্জ থেকে জলপাইগুড়িতে নাতির আধার কার্ড বানাতে এসেছিলেন মুকুন্দ বর্মণ। জমিতে ধানের পর আলু চাষ করছেন তিনি। একদিকে ক্ষেতে চাষাবাদের লাইন করতে হবে, কীটনাশক ছেটাতে হবে।

ষাটোর্ধ্ব মুকুন্দ বলেন, ‘জমির কাজ মাথায় উঠেছে। পেটের কথা এখন ভাবছি না। নাতির কোনও কার্ড নাই। এনআরসিতে যদি নাম বাদ দেয়।’

প্রথমে তিনি কোচবিহারে গিয়েছিলেন সেখানে লাইন দিয়ে হয়নি। কারও কাছে শুনেছেন জলপাইগুড়িতে হচ্ছে, প্রথমে একদিন এসে খোঁজ নিয়ে গিয়েছেন। তারপর রোববার রাতে পৌঁছে লাইন দিয়েছেন।

এদিকে জনগণের ভোগান্তির আরও কারণ যথাযথ তথ্য জানতে না পারা। এ নিয়ে নানা অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে পোস্ট অফিসের কর্মীদের বিরুদ্ধে।

জল্পেশের বাসিন্দা ১৯ বছরের তরুণী রুবি বেগম নতুন কার্ড করাতে এসেছিলেন। তাকে ডাকঘর কর্মীরা বলেছে, জন্মনিবন্ধন না থাকলে কার্ড হবে না। অথচ নিয়ম অনুযায়ী জন্মনিবন্ধনের বিকল্প আরও তিনটি প্রমাণের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। কার্ড হবে না শুনে পোস্ট অফিসের সিঁড়িতে বসেই কাঁদছিলেন রুবি। তাঁকে কয়েকজন সান্ত্বনা দিলেন। সঙ্গে থাকা লুনা খাতুনের কথায়, ‘যে দেশে জন্মগ্রহণ করলাম। যে দেশের নেতাদের ভোট দিয়ে জিতালাম। তারাই এখন আমাদের তাড়িয়ে দিতে চাইছে।’