যে হত্যাকাণ্ডে বদলে যেতে পারে আগামীর মধ্যপ্রাচ্য

পুণ্ড্রকথা ডেস্ক
প্রকাশ: ০৩ জানুয়ারী ২০২০ ১১:৫৫ ।
প্রচ্ছদ
পঠিত হয়েছে ৮১ বার।

নতুন বছরের শুরুতেই মধ্যপ্রাচ্যের জন্য বড় দুঃসংবাদ নিয়ে আসলো যুক্তরাষ্ট্র। সেটি হচ্ছে ইরানের অঘোষিত সর্বোচ্চ ক্ষমতাশালী সামরিক কর্মকর্তা মেজর জেনারেল কাসেম সোলেইমানিকে হত্যা। দীর্ঘদিন ধরে গুপ্তহত্যার মাধ্যমে তাকে সরিয়ে দেওয়ার ব্যর্থ চেষ্টার পর প্রকাশ্যে বিমান হামলা চালিয়ে এই ইরানি জেনারেলকে হত্যা করলো যুক্তরাষ্ট্র।

এই হত্যাকাণ্ড গত এক বছরে মধ্যপ্রাচ্যের কর্তৃত্ব নিয়ে ব্যাকফুটে চলে যাওয়া মার্কিন নীতির জন্য স্বস্তির ঘটনা। এ ক্ষেত্রে ইরাকে মার্কিন দূতাবাসে ইরান সমর্থিত বিক্ষোভকারীদের হামলা ওয়াশিংটনের জন্য উল্টো বড় বিজয় নিয়ে এসেছে বলতে গেলে।

তবে এখন মুখরক্ষায় ইরানের পাল্টা জবাবের মাত্রা কতটুকু হবে সেটা দেখার বিষয়। ইতোমধ্যে ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনি ‘কঠিন প্রতিশোধের’ ঘোষণা দিয়েছেন। ইরানের প্রতিশোধমূলক কর্মকাণ্ড ঘিরে বদলে যেতে পারে ‘বিশ্ব রাজনীতির ভরকেন্দ্র’ মধ্যপ্রাচ্যের আসছে দিনগুলোর চিত্র।

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ঘনিষ্ঠ সহযোগী সিনেটর লিন্ডসে গ্রাহামের মতে, যে হাতে মার্কিনিদের রক্ত ঝরেছে, তার মৃত্যু ইরানি শাসনের ওপর একটি বড় আঘাত।

সোলেইমানিকে হত্যার মধ্যে দিয়ে বদলে যেতে পারে ইরাকসহ পুরা মধ্যপ্রাচ্যের ভবিষ্যৎ। এই হামলাকে এই অঞ্চলের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ‘টার্নিং পয়েন্ট’ বলে মন্তব্য করেছেন আলজাজিরার বিশ্লেষক ওসামা বিন জাভেদ।

এই মুহূর্তে ঘনিষ্ঠ মিত্র ইরানের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সামরিক ব্যক্তির এই হত্যাকাণ্ডে ইরাক সরকার ওয়াশিংটনের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নে পিছুটান দেবে। ওসামা বিন জাভেদ বলছেন, ওয়াশিংটনের সঙ্গে বাগদাদের সম্পর্কের বড় ধরনের অবনতি ঘটবে।

গত বছরের শেষে ইরাকের সিরীয় সীমান্তে ইরান সমর্থিত মিলিশিয়া বাহিনীর ঘাঁটিতে যুক্তরাষ্ট্রের হামলার প্রতিক্রিয়ায় বাগদাদে মার্কিন দূতাবাসের সামনে মার্কিন বিরোধী ক্ষোভের চিত্র দেখা গেছে। এখন সোলেইমানিকে হত্যার ফলে স্বাভাবিকভাবেই ইরাকে যুক্তরাষ্ট্রের যে কোনো স্বার্থই বাধার মুখে পড়বে।

হোয়াইট হাউসের জাতীয় নিরাপত্তা বিষয়ক প্রাক্তন কর্মকর্তা হিলারি মান লেভেরেট বলেছেন, সোলেইমানিকে হত্যা ইরানের বিরুদ্ধে এক প্রকার যুদ্ধ ঘোষণা। সোলেইমানি হত্যা মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী বা মার্কিন সেন্ট্রাল কমান্ডের প্রধানকে হত্যার শামিল।

ওয়াশিংটনের দাবি, ভবিষ্যতে ইরানের হামলার পরিকল্পনা নস্যাৎ করতেই জেনারেল সোলেইমানিকে হত্যা করা হয়েছে। পেন্টাগনের ভাষ্য, যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের যেকোনো স্থানে তার লোকজন ও স্বার্থ রক্ষায় সব ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া অব্যাহত রাখবে।  তবে এই হত্যাকাণ্ড পরবর্তী পরিস্থিতি মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিনিদের উপস্থিতি এখন অবিশ্বাস্যভাবে বিপজ্জনক পরিস্থিতিতে পড়বে বলে মনে করছেন হিলারি মান।

ট্রাম্পের সরাসরি নির্দেশে সোলেইমানিকে হত্যা করা হয়েছে বলে নিশ্চিত করেছে পেন্টাগন ও হোয়াইট হাউস। তবে মার্কিন কংগ্রেসে কোনো ধরনের আলোচনা ছাড়াই ট্রাম্পের এমন সিদ্ধান্তের সমালোচনা করেছেন হিলারি মান। মার্কিন অভ্যন্তরীণ প্রেক্ষাপটে এই হত্যাকাণ্ডকে অবৈধ কর্মকাণ্ড বলে অভিহিত করেছেন তিনি।

সোলেইমানির হত্যাকাণ্ডে ইরাকে ইরানি হস্তক্ষেপ আরও বেশি প্রবল হতে পারে। ইরাকে শিয়াপন্থী মিলিশিয়া গ্রুপগুলোর সমন্বিত সংগঠন পপুলার মোবিলাইজেশন ফোর্সেস (পিএমএফ) গঠিত হয়েছে কুদস বাহিনীর প্রচ্ছন্ন সমর্থনে। সোলেইমানির শোকে এই সংগঠন আরও বেশি অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠার সম্ভাবনা আছে। তবে যুক্তরাষ্ট্রকে কিছুটা সন্তুষ্টি এনে দিতে পারে, সোলেইমানির সঙ্গে পিএমএফের কমান্ডার আবু মাহদি আল-মুহান্দিসের নিহতের খবরও।

মার্কিন সিনেটের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ক কমিটির সদস্য সিনেটর ক্রিস মারফি সতর্ক করেছেন, এই হত্যাকাণ্ড বিশাল একটি আঞ্চলিক যুদ্ধ ডেকে নিয়ে আসতে পারে।

১৯৮০’র দশকে ইরান-ইরাক যুদ্ধের সময় দায়িত্ব পালন করার সময় পরিচিত হয়ে ওঠেন জেনারেল সোলেইমানি। ১৯৯৮ সাল থেকে ইরানের কুদস বাহিনীর নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন তিনি। দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে মধ্যপ্রাচ্যে যে কোনো শক্তির জন্য আতঙ্ক হয়ে উঠেছিল কুদস বাহিনী।

ইরানের পররাষ্ট্র নীতি নির্ধারণ করার ক্ষেত্রেও গত কয়েক বছরে মুখ্য ভূমিকা পালন করেছেন তিনি। ইরাকে ইসলামিক স্টেট-আইএসের বিরুদ্ধে যুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন ৬২ বছর বয়সী এই সামরিক কমান্ডার।

ইরানি বাহিনীটির সঙ্গে যুক্ত আছে লেবাননের হিজবুল্লাহ, ফিলিস্তিনের হামাস ও ইসলামিক জিহাদ, পাকিস্তানে ফাতেমিয়ুন এবং আফগানিস্তানে জাইনাবিয়ুন, ইয়েমেনের হুতি গোষ্ঠী ও মিলিশিয়া বাহিনীগুলো। ফলে যুক্তরাষ্ট্র ও মিত্রদের অবস্থানে আঘাত হানতে মরিয়া হয়ে উঠবে এসব সশস্ত্র গোষ্ঠী।

সোলেইমানিকে হত্যা ইরানের চির প্রতিদ্বন্দ্বী দেশ সৌদি আরবের জন্যও আনন্দদায়ক হবে নিঃসন্দেহে। এ ঘটনাকে সৌদি আরবের সবচেয়ে বড় তেলক্ষেত্রে হামলার ঘটনার প্রতিশোধ হিসেবেই কল্পনা করে তৃপ্ত হবে তারা।

তবে হুথি গোষ্ঠী ইয়েমেন ও সীমান্ত এলাকায় সৌদি আরবকে নাস্তানাবুদ করে ছাড়ছে। তারা আরও বেশি ক্রুদ্ধ হয়ে উঠবে। ইয়েমেন যুদ্ধে মার্কিন সমর্থিত সৌদি জোটকে ব্যর্থতার মুখে ফেলতে এই হুথিদের সমর্থনে কাজ করেছে কুদস বাহিনী।

ইতোমধ্যে জেনারেল সোলেইমানিকে হত্যাকাণ্ডে তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে ইরান। যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘনের অভিযোগ তুলেছেন দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী জাভেদ জারিফ।

মধ্যপ্রাচ্যে যাবতীয় রাজনৈতিক দুর্বৃত্তপনার জন্য যুক্তরাষ্ট্রকে দায়ী করেন তিনি। এই হত্যাকাণ্ডকে আল-কায়েদা, আইএস, আল-নুসরাহর মতো জঙ্গি সংগঠনগুলোর মোকাবিলায় যুক্তরাষ্ট্রের চরম বিপজ্জনক ও বোকামিপূর্ণ অভিযান বলে মন্তব্য করেন ইরানি পররাষ্ট্রমন্ত্রী।

আলজাজিরার দোরসা জাব্বারি তেহরান থেকে জানান, সোলেইমানির হত্যাকাণ্ড শুধু ইরানে নয়, মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে বড় ধরনের ধাক্কা ও বিক্ষোভের মুখোমুখি হতে পারে যুক্তরাষ্ট্র।

এই মুহূর্তে সোলেইমানির মৃত্যু বড় ধরনের ক্ষতি ইরানের জন্য। জাব্বারি বলেন, সোলেইমানির নাম ছিল ইরানের জাতীয় গৌরবের সঙ্গে সমার্থক। তার মৃত্যুতে রেডিওগুলোতে রীতিমতো মাতম চলছে।