২০১৯ সালে বেশি সড়ক দুর্ঘটনা মোটরসাইকেলে

পুণ্ড্রকথা ডেস্ক
প্রকাশ: ০৫ জানুয়ারী ২০২০ ০৬:২৭ ।
প্রচ্ছদ
পঠিত হয়েছে ৬৪ বার।

সড়কে মোটরসাইকেলের সংখ্যা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বেড়েছে দুর্ঘটনাও। এর অন্যতম কারণ- সারাদেশে উঠতি বয়সীদের বেপরোয়া রেস এবং রাজধানীতে ভাড়ায় যাত্রী টানা মোটরসাইকেলের অদক্ষ চালক। বিভিন্ন সময় বিভিন্ন সংস্থা এই বিষয় নিয়ে কাজ করলেও কোনোভাবেই নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না দুর্ঘটনা। এদিকে রাজধানীতে প্রাইভেট কারের চালকরা দোষারোপ করছেন মোটরসাইকেল চালকদের ধৈর্যহীনতাকে। আর সেই দোষও অকপটে স্বীকারও করছেন মোটরসাইকেল চালকরা। খবর বাংলা ট্রিবিউন
নিরাপদ সড়ক চাই (নিসচা) শনিবার (৪ জানুয়ারি) এ বিষয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। সেখানে দেখা গেছে, ২০১৯ সালে সারাদেশে মোট মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা হয়েছে এক হাজার ৯৮টি।
প্রতিবেদনটিতে বলা হয়েছে- ২০১৯ সালে বাস, ট্রাক ও কাভার্ড ভ্যান মিলিয়ে সর্বোচ্চ যে দুর্ঘটনা ঘটেছে, তা সড়ক দুর্ঘটনার ৩৯ শতাংশ। আর শুধু মোটরসাইকেল দুর্ঘটনাই ১৯ শতাংশ। সড়ক দুর্ঘটনা সংখ্যা বৃদ্ধির এটাও একটি বড় কারণ।
মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা বেশি হওয়ার কারণ হিসেবে বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, দুই চাকার এই যান চার চাকার যানের চেয়ে ৩০ গুণ বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। এদিকে কোম্পানিগুলোও প্রণোদনা দিয়ে বাহনটির বাজারমূল্য সাধারণ মানুষের হাতের নাগালে নিয়ে আসছে। উন্নত বিশ্বে কৌশলগত কারণেই এই বাহনটির দাম বাড়িয়ে রাখা হয়। যদি আমাদের দেশে এটা এখনই নিয়ন্ত্রণ করা না হয়, তবে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার পরিমাণ আরও বাড়বে।
বিআরটিএ থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, দেশে রেজিস্ট্রেশন করা মোটরসাইকেলের সংখ্যা ২৭ লাখ ৮৬ হাজার ৯৫৪টি এবং লাইসেন্সধারী চালকের সংখ্যা ১৩ লাখ ৬০ হাজার ৭০৩ জন। সেই অনুসারে ১৪ লাখ ২৬ হাজার ২৫১ জন চালকের লাইসেন্স নেই।
নিসচা’র দাবি, লাইসেন্স ছাড়াই প্রশাসনের নাকের ডগা দিয়ে অবৈধভাবে মোটরসাইকেল চালাচ্ছে এসব অদক্ষ ও লাইসেন্সবিহীন চালকরা।
মোটরসাইকেল নিয়ে অভিযোগ রয়েছে অন্যান্য যানের চালকদের মধ্যেও। ঢাকা মহানরগরীতে যানজটের সময় বিভিন্ন যানের মধ্যে থাকা সরু জায়গা দিয়ে প্রায়ই বেরিয়ে যায় মোটরসাইকেল চালকরা। এতে অন্য যানের চালকরা কখনও কখনও সড়কের নিজ লেনে থাকতে পারেন না।
মোটরসাইকেল চালকদের সমালোচনা করে রাজধানীর এক প্রাইভেট কারের চালক নুরুল আলম চৌধুরী বলেন, ‘মোটরসাইকেল চালকরা সবসময় ওভারটেকিং করার চেষ্টা করে, করতে পারুক আর না পারুক। নিজেদের মোটরসাইকেলের মাপটা পর্যন্ত ঠিকমতো বুঝতে পারে না। মাঝে মাঝে আমাদের গাড়িতেও দাগ বসিয়ে দেয়। মূলত তারা ধৈর্যহীন হয়ে থাকে সবসময়। আর দুর্ঘটনাটা এজন্যই বেশি হয়।’
এই দোষ অকপটে স্বীকার করেন রাজধানীতে রাইড শেয়ারিং সার্ভিসের মোটরসাইকেল চালক জাহাঙ্গীর আলম। তিনি বলেন, ‘মূলত রাজধানীতে সব বাইক চালকই ধৈর্যহীন। সবাই শুধু আগে যেতে চায়। আর এজন্য অনেক সময় তারা খারাপভাবে বাইক চালায়। কখনও বাইকের মাপটা পর্যন্ত বুঝতে চায় না।’

মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার কারণ সম্পর্কে জানতে চাইলে সড়ক দুর্ঘটনা বিশেষজ্ঞ ও বুয়েটের অধ্যাপক শামসুল হক বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘মোটরসাইকেল বাহনটি একটি ঝুঁকিপূর্ণ দুই চাকার যান। চার চাকার সঙ্গে তুলনা করলে এটি ৩০ গুণ ঝুঁকিপূর্ণ। আর এজন্যই উন্নত বিশ্বে মোটরসাইকেলকে কখনও পৃষ্ঠপোষকতা দেয় না। সেই হিসেবে না বুঝে, না জেনে মোটরসাইকেল বানানোর জন্য বাণিজ্য মন্ত্রণালয় প্রণোদনা দিয়ে যেভাবে ফ্যাক্টরি বানাতে উৎসাহিত করছে, তাতে এবার পরিসংখ্যানে যা এসেছে তা এরপর আরও বেশি হবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, কম্বোডিয়া এসব দেশের পরিসংখ্যানে দেখা যায়- মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা একটি অভিশাপ। এই অভিশাপে তরুণ প্রজন্ম মারা যায় এবং যারা বেঁচে থাকে তারা পঙ্গুত্বের শেষ পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছে। আমাদের দেশে যেহেতু যানজট ও বিশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণ করা যায়নি, সেজন্য মানুষ ব্যক্তি উদ্যোগে মোটরসাইকেল কেনেন। অবশ্যই যানজটের শহরে মোটরসাইকেল গতি বাড়ায়। কিন্তু এটা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ ও বিপদজনক।’
দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘সরকার মোটরসাইকেলের উৎপাদন মূল্য কমানোর যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, সেখান থেকে তড়িৎ গতিতে বেরিয়ে আসতে হবে। এখন রিকশার বিকল্প হয়ে গেছে মোটরসাইকেল। যারই একটু টাকা বাড়ছে, তিনিই মোটরসাইকেল কিনে ফেলছেন। এজন্যই সরকারকে প্রথমেই উৎপাদন মূল্যে হাত দিতে হবে। এটাকে নিরুৎসাহিত করার জন্য ব্যাপক প্রচারণার দরকার আছে। উৎপাদন মূল্য কৌশলগতভাবে না বাড়িয়ে রাখলে, সরকার দায় এড়াতে পারবে না।’
এদিকে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার কারণ সম্পর্কে নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলনের চেয়ারম্যান ইলিয়াস কাঞ্চন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘ঢাকা মেট্রোপলিটনসহ অন্যান্য মেট্রোপলিটন শহরে মোটরসাইকেল চালকদের হেলমেট পরিধানের সুঅভ্যাস গড়ে উঠেছে। কিন্তু জেলা ও গ্রাম-গঞ্জে হেলমেট না পরার প্রবণতাই লক্ষ্য করা যাচ্ছে। একই সঙ্গে অপ্রাপ্ত বয়স্ক চালকদের মোটরসাইকেল চালনায় কঠোর নিষেধাজ্ঞা আছে। তারপরও প্রশাসনের সামনে দিয়ে লাইসেন্সবিহীন মোটরসাইকেল ও অপ্রাপ্ত বয়সের কিশোররা মোটরসাইকেল চালাচ্ছে। এছাড়াও দুয়ের অধিক আরোহী নেওয়া, বেপরোয়া গতিতে মোটরসাইকেল চালানো ও চলন্ত অবস্থায় মোবাইলে কথা বলাই দুর্ঘটনার জন্য দায়ী। এভাবে চলতে থাকলে কোনোভাবেই মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা কমানো যাবে না।’
দুর্ঘটনা কমানোর বিষয়ে তিনি বলেন, ‘মেট্রোপলিটন শহরগুলোর মতো বিভিন্ন এলাকাতেও একইভাবে পদক্ষেপ গ্রহণ করা গেলে এই দুর্ঘটনা ও মৃতের হার আরও কমানো যেত। আরও উচিত— মোটরসাইকেল চালকদের প্রাতিষ্ঠানিক প্রশিক্ষণ, ট্রাফিক আইন সম্পর্কে ব্যাপক ধারণা প্রদান, দেশের অল্প বয়স্ক যুব সমাজকে মোটরসাইকেল চালনায় বিধিনিষেধ আরোপ ও গতির ক্ষতি সম্পর্কে ধারণা প্রদান, মোটরসাইকেল বিক্রির আগে বিক্রেতার উচিত অভিভাবকদের সম্মতি গ্রহণ করা, ১৮ বছরের কম বয়সীদের কাছে মোটরসাইকেল বিক্রয় না করা।’
ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (ট্রাফিক) মো. মফিজ উদ্দিন আহম্মেদ বলেন, ‘সড়কে আমরা সব অবৈধ যান ও চালকদের বিষয়ে সচেতন। ট্রাফিক আইন অমান্য করলে কাউকে ছাড় দেওয়া হয় না। মোটরসাইকেল একসময় অনিয়ন্ত্রিত ছিল, এখন সব চালক হেলমেট পড়ছেন, কাগজপত্রও ঠিক রাখছেন। তারপরও কোথাও ব্যত্যয় ঘটলে আমরা আইনানুগ ব্যবস্থা নিচ্ছি