রাজধানীতে গণধর্ষণ: অনিরাপদ ঢাকা, অনিরাপদ দেশ!

পুণ্ড্রকথা ডেস্ক
প্রকাশ: ০৬ জানুয়ারী ২০২০ ০৯:৪৯ ।
প্রচ্ছদ
পঠিত হয়েছে ১০৭ বার।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি মেয়েকে বাস থেকে নামার পর উঠিয়ে নিয়ে গণধর্ষণ করা হয়েছে। মেয়েটি সাংস্কৃতিক কর্মী এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বলেই হয়তো প্রতিবাদটা হয়েছে তাৎক্ষণিক। কিন্তু এমন ঘটনা কি আর নেই? আছে। সারাদেশে এমন অসংখ্য ঘটনা ঘটছে। তারমধ্যে কিছু ঘটনা ‘ক্লিক’ করে অন্যগুলো আড়ালে থেকে যায়। খবর যুগান্তর অনল

আজ যখন লিখছি, তখনও মনিটরে শায়েস্তাগঞ্জের একটি খবর চোখ আঁকড়ে রয়েছে। ধর্ষণে ব্যর্থ হয়ে এক স্কুলছাত্রীর ওপর নির্যাতন চালিয়েছে এক যুবক। মেয়েটির স্পর্শকাতর অঙ্গে আঘাতের চিহ্নের কথা ফলাও করে বর্ণিত হয়েছে খবরে।

কেন হয়েছে, অনুচ্চারিত জবাব একটাই, মানুষ এতে আকর্ষিত হয়। অর্থাৎ এমন খবরও ধর্ষকামীতার ‘সহমত’ পোষণকারী। শায়েস্তাগঞ্জের এই স্কুলছাত্রীটিকে নিয়ে কোনো প্রতিবাদের কথা নেই সেই খবরে। নেই মানববন্ধন, অবরোধ কিংবা অন্য কিছু। শুধু পরিবারের লোকজন বিচার ও শাস্তি চেয়েছেন। আর সেই চাওয়ার ভাষাও অসহায়ত্বের।

অনিরাপদ ঢাকা এবং সারাদেশে আমরা সবাই অসহায়। আমার সন্তান ধর্ষিতা হবে, খুন হবে এটাই যেন এই জনপদে স্বাভাবিক। মানুষজন গণমাধ্যমে ধর্ষিতা হওয়ার বিবরণ পড়বে। বিবরণ রগরগে হলে পাঠক বেশি, ছবি হলে তো কথাই নেই।

খুনের ক্ষেত্রেও একই কথা। বিবরণে থ্রিল থাকা চাই। পড়ে-টড়ে দুদিন আলোচনা, তারপর শেষ। আর বিশেষ কিছু ক্ষেত্রে যেমন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই ছাত্রীটির ঘটনার মতন প্রতিবাদ শুরু হয়, তখন মানুষেরা জেগে ওঠে। যে জেগে ওঠা ‘হুজুগে’ জেগে ওঠা। জানি ‘হুজুগ’ শব্দটায় অনেকে আপত্তি করবেন। তাই ছোট করে ব্যাখ্যা করি। নুসরাতের ঘটনার পর সারাদেশে প্রতিবাদ হয়েছে। জেলায় জেলায় মানববন্ধন, বিক্ষোভ, প্রতিবাদ সমাবেশ হয়েছে। খুব ভালো, কিন্তু তারপর? থেমেছে কি এসব ঘটনা?

থামেনি যে খোদ জনবহুল রাজধানীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া ছাত্রীকে গণধর্ষণ তারই প্রমাণ। তাহলে, আপনাদের প্রতিবাদ কী ছিল, কতটুকু ছিল, একটু ভেবে দেখুন তো। আর সঙ্গে ভেবে দেখুন প্রতিবাদটা ‘কেন’ ছিল। প্রতিবাদটা ‘কেন’ ছিল, এটাই মূল বিষয়। প্রতিবাদটা কি শুধু নুসরাতের জন্য ছিল, নাকি ছিল এমন কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে? শুধু নুসরাত হত্যার বিচারই কি শেষ? না ‘এরপর’ আরও কিছু রয়েছে? এই ‘এরপর’ শব্দটির উপর প্রতিবাদীদের কোন চিন্তা ছিল না বলেই আজকে আবার প্রতিবাদে দাঁড়াতে হয়েছে।

নুসরাত কিংবা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই ছাত্রীটি ভেঙে পড়া সমাজের এক একটি ‘সিম্বল’, প্রতীক। আমাদের সমাজ যে ভেঙে পড়েছে, আমাদের সামাজিক কাঠামো যে এমন দুর্বৃত্তপনা রুখতে অক্ষম, তারই জানান দিচ্ছে এমনসব ঘটনা। সুতরাং এসব প্রতিবাদের এবং প্রতিরোধের লক্ষ্য শুধু বিচার নয়, কাঠামো পরিবর্তন করা।

অচল কাঠামোর পরিবর্তে সচল একটি কাঠামো প্রতিস্থাপন করা। অতএব প্রতিবাদ বা বিচারই শেষ কথা নয়। বিষবৃক্ষের গোঁড়া না কেটে কাণ্ড কাটলে, নতুন কাণ্ড গজাবে। মূল উৎপাটনই মূল লক্ষ্য হতে হবে। মনোযোগ কেন্দ্রীভূত করতে হবে মূল কাঠামো পরিবর্তনের দিকে। ক্রমবর্ধমান ধর্ষণ বা খুনের পেছনের কারণগুলো কী, এগুলো ভাবতে হবে, নির্ধারণ করতে হবে। অপরাধ বিজ্ঞানের মতে, যখন শাস্তি থেকে বাঁচার উপায় থাকে, কিংবা বিচার হয় সংশয়িত, তখন মানুষের ভেতর অপরাধ প্রবণতা বেড়ে যায়। মানুষ ক্রমেই অপরাধ প্রবণ হয়ে ওঠে।

আরেকটা কারণ হলো, ‘সিলেক্টিভ জাস্টিস’। অমুক করলে শাস্তি হবে, অমুক করলে হবে না- এমন ধারণা থেকেও সমাজে বাড়ে অপরাধ প্রবণতা। শুধুমাত্র নুসরাত বা ঢাকা ভার্সিটির মেয়েটির প্রতি সংঘটিত দুর্বৃত্তপনার বিচারই শেষ কথা নয়।

তাই যদি হয় তবে যেসব ঘটনা ‘ক্লিক’ করেনি, সেসব ঘটনায় নির্যাতিত বা নিহতরা বিচার পাবে না, কারণ তাদের জন্য কোনো প্রতিবাদ হয়নি। দেশব্যাপী না হোক নিদেনপক্ষে রাজধানীতে বা এলাকাতেও কোনো মানববন্ধন, বিক্ষোভ হয়নি।

আর এই না হওয়ায় তাদের বিচার হবে না, এমনটাই ধারণা দাঁড়াবে মানুষের মনে। এটাও এক ধরণের সিলেক্টিভ জাস্টিস। প্রতিবাদ হলে বিচার হবে, না হলে হবে না। আমাদের এমন বিচারের ধারণা থেকে বেরুতে হবে।

এমন সামাজিক কাঠামো ভাঙতে হবে, নতুন করে গড়তে হবে এমন সমাজের নিয়ন্ত্রক রাষ্ট্রকাঠামোকেও। আর আন্দোলনটাও হবে এমন লক্ষ্যকে সামনে রেখেই। তবেই যদি দেশে বিচারের ন্যায়তা তথা সব মানুষের জন্য বিচার এবং সব মানুষকে রক্ষার প্রতিরক্ষা কাঠামো গড়ে ওঠে।