পাখি সংরক্ষনে রয়েছে নানা উদ্যোগ

পরিযায়ী পাখির কলতানে মুখর নওগাঁর জবই বিল

এম আর ইসলাম রতন, নওগাঁ প্রতিনিধি
প্রকাশ: ১৭ জানুয়ারী ২০২০ ১১:৩৮ ।
প্রচ্ছদ
পঠিত হয়েছে ১০৩ বার।

পরিযায়ীসহ দেশীয় পাখির কলতানে মুখর এখন নওগাঁর ঐতিহ্যবাহী সাপাহারের জবই বিল। সুদূর সাইবেরীয়াসহ শীত প্রধান বিভিন্ন দেশ থেকে প্রতিদিন হাজার হাজার পাখি আসছে জবই বিলে। গত ৫ বছর ধরে এসব পাখির অবাধ বিচরণ ক্ষেত হলেও এবছর সবচেয়ে বেশী পাখির আগমন ঘটেছে বলে স্থানীয়রা জানিয়েছেন।

উপজেলা সদর থেকে ১০ কিলোমিটার দূরে জবই বিলের মাঝ দিয়ে বয়ে যাওয়া রাস্তার দুই ধারে দাঁড়িয়ে নয়নাভিরাম মনোরম এই দৃশ্য উপভোগ করতে প্রতিদিন সেখানে ভীড় করছে ভ্রমন পিপাসুরা। তাঁদের চোখের সামনে হাজারো বালিহাঁস ঝাঁকে ঝাঁকে উড়ছে। আবার বিলের জলে পড়ে টুপ করে দিয়ে হারিয়ে যাচ্ছে।

জানা যায়, গত নভেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহ থেকে নানা জাতের পরিযায়ী পাখির কলরবে মুখর হতে থাকে বিলটি। সাইবেরিয়াসহ পৃথিবীর শীতপ্রধান এলাকা থেকে আসা বালিহাঁসের ঝাঁক উড়তে দেখা যায় আকাশজুড়ে। পাখির কলরবে মুখর চারপাশ। জলাশয়ে খাবারের খোঁজে বিচরণ করছে শত শত পাখি। জলাশয়ে তো রয়েছেই, আশপাশের কৃষিজমিতে বিভিন্ন ফসলের খেত, গাছের ডালপালা-শাখা-সর্বত্র এই পাখিদের বিচরণ।

স্থানীয়রা জানান, গত ৫ বছর ধরে জায়গাটিতে পরিযায়ী পাখি আসছে। বেশ কয়েক প্রজাতির পাখির মধ্যে হাঁসজাতীয় পাখির সংখ্যাই বেশি। পরিযায়ী পাখি ছাড়াও দেশি জাতের শামুকখোল, পানকৌড়ি, ছন্নিহাঁস, বক পাখি বিল এলাকা মুখর করে রেখেছে।

সিরাজুল আলম নামের এক শিক্ষার্থী বলেন, ‘নিজের এলাকায় পরিযায়ী পাখির অভয়াশ্রম দেখে অনেক গর্ব হয়। দূর-দূরান্তের মানুষ এখানে আসে পাখি দেখতে। সময় পেলেই ছুটে আসি। এখানে এসে হাজারো পাখির বিচরণ দেখে মন উৎফুল্ল হয়ে যায়।’

সাপাহার উপজেলা সদর থেকে প্রায় ১০ কিলোমিটার দূরে ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তঘেঁষা শিরন্টি ইউনিয়নে অবস্থিত এই বিল। জবই বিলের জলমহালের আয়তন ৪০৩ হেক্টর। জবই বিলঘেঁষা গ্রাম কলমুডাঙ্গাসহ কয়েকটি গ্রাম। এই গ্রামের বাসিন্দা কলিমুদ্দীন, আসছার আলী মন্ডলসহ কয়েকজনেরর সাথে কথা বলে জানা গেছে পাখিরা জলাশয় ছাড়াও গ্রামের গাছের ডালপালা, বাড়ির ছাদসহ বিভিন্ন জায়গায় ওড়াউড়ি করে। গাছের ফল খেয়ে ফেলে। এরপরও গ্রামের মানুষ পাখিদের কোনো সমস্যা করে না।

ওই এলাকার বাসিন্দা ও একটি সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক সোহানুর রহমান সবুজের নেতৃত্বে জবই বিল ঘিরে স্থানীয় কয়েকটি গ্রামের সচেতন কয়েকজন তরুণ-তরুনীদের নিয়ে গড়ে তোলা হয়েছে জবই বিল জীববৈচিত্র সংরক্ষন নামের একটি সংগঠন। বিলে শিকারিরা যেন পাখি শিকার করতে না পারেন, সেদিকে নজরদারি করেন ওই সংগঠনের সদস্যরা। পরবর্তীতে ওই কমিটির সদস্যরা কয়েকজন পাখি শিকারীকে হাতেনাতে ধরে প্রশাসনের হাতে তুলে দেয়। প্রশাসন ওই পাখি শিকারীদের ভ্রাম্যমান আদালতের মাধ্যমে জেল-জরিমানা করাসহ সতর্ক করে দেয়ারও ঘটনাও রয়েছে। আর এভাবে সেখানে গড়ে উঠেছে পাখির বিশাল অভয়ারন্য।

জবই বিল জীববৈচিত্র সংরক্ষণ কমিটির সভাপতি সোহানুর রহমান সবুজ বলেন, 'শুরুতে এলাকার কিছু মানুষ জবই বিলে আসা পাখিদের অবাধে শিকার করতেন। কিন্তু সচেতন মানুষ একজোট হয়ে এর প্রতিবাদ করায় এবং উপজেলা প্রশাসনের কঠোর পদক্ষেপের ফলে এই বিলে পাখি শিকার প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। এখন পাখিরা বিলটিতে বেশ নিরাপদে আছে। প্রায় পাঁচ-ছয় বছর ধরে এই বিলে পরিযায়ী পাখি আসছে। শীতের শুরুতে এখানে পাখিরা আসতে শুরু করেছে।'

সাপাহার উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) কল্যাণ চৌধুরী বলেন, 'জলাশয়ে আসা পরিযায়ী পাখিদের কেউ যাতে শিকার করতে না পারে, বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে নজরে রাখা হচ্ছে। পাশাপাশি স্থানীয় জনগণকেও সচেতন করা হচ্ছে বিভিন্ন সভা-সেমিনারের মাধ্যমে। পাখিদের বিচরণ যাতে কোনোভাবে ব্যাহত না হয়, সে বিষয়ে প্রশাসন অত্যন্ত কঠোর।'

তিনি আরো বলেন, 'বিলপাড়ে ঘুরতে আসা পর্যটকদের জন্য বিলের ভেতর দিয়ে যাওয়া সড়কের দুই পাশে বসার স্থান করে দেওয়া হয়েছে। স্থানীয় সাংসদ ও গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার এমপি জবই বিলকে একটি পর্যটনকেন্দ্রে রূপ দেওয়ার জন্য নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন। ভবিষ্যতে এই বিলকে আরও দৃষ্টিনন্দন করা হবে।'

বন্য প্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইন অনুযায়ী পরিযায়ী পাখি হত্যার দায়ে সর্বোচ্চ এক বছরের কারাদন্ড অথবা এক লাখ টাকা অর্থদন্ড অথবা উভয় দন্ডে দন্ডিত করার বিধান রয়েছে বলেও ইউএনও কল্যাণ চৌধুরী জানান।

এদিকে বিলে পাখি সংরক্ষনের লক্ষে বৃহস্পতিবার বিকেলে পাহাড়ীপুকুর স্মৃতিসৌধ চত্ত্বরে জবই বিল জীববৈচিত্র সংরক্ষণ ও সমাজ কল্যাণ সংস্থা আয়োজনে এবং বন্যপ্রানী অপরাধ দমন ইউনিট, বন অধিদপ্তর ও উপজেলা প্রশাসনের উদ্যোগে এলাকার সাধারণ লোকজন ও গন্যমান্র ব্যাক্তি বগেৃর উপস্থিতি আলোচনা ও মতবিনিময় সভা করা হয়েছে।

সাপাহার উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) কল্যাণ চৌধুরী সভাপতিত্বে সভায় বক্তব্য রাখেন বন্যপ্রাণী অপরাধ দমন ইউনিটের পরিচালক জহির আকন,উপজেলা চেয়ারম্যান আলহাজ্ব শাহজাহান হোসেন,থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) আব্দুল হাই, টাঙ্গাইল সরকারী এম এম আলী কলেজের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ও বিবিসিএফের সভাপতি ড.এস এম ইকবাল,জবই বিল জীববৈচিত্র সংরক্ষণ কমিটির সভাপতি সোহানুর রহমান সবুজ।

বক্তারা বলেন, 'জলাশয়ে আসা পরিযায়ী পাখিদের কেউ যাতে শিকার করতে না পারে, বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে নজরে রাখা হচ্ছে। পাশাপাশি স্থানীয় জনগণকেও সচেতন করা হচ্ছে বিভিন্ন সভা-সেমিনারের মাধ্যমে। পাখিদের বিচরণ যাতে কোনোভাবে ব্যাহত না হয়, সে বিষয়ে প্রশাসন অত্যন্ত কঠোর। বন্য প্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইন অনুযায়ী পরিযায়ী পাখি হত্যার দায়ে সর্বোচ্চ এক বছরের কারাদন্ড অথবা এক লাখ টাকা অর্থদন্ড অথবা উভয় দন্ডে দন্ডিত করার বিধান রয়েছে।'