আতঙ্কে মেসের শিক্ষার্থীরা: নিরাপত্তার জন্য পুলিশকে চিঠি দিয়েছে কর্তৃপক্ষ

বগুড়া সরকারি আ. হক কলেজ ক্যাম্পাসে রাতে মাদকসেবীদের আনাগোনা বাড়ে

পুণ্ড্রকথা রিপোর্ট
প্রকাশ: ১৯ জানুয়ারী ২০২০ ০১:৪৮ ।
প্রচ্ছদ
পঠিত হয়েছে ২০৬৭ বার।

বগুড়ায় সরকারি আজিজুল হক কলেজের নতুন ভবনের ক্যাম্পাসটি দিনের বেলা শিক্ষার্থীদের পদচারণায় মুখর থাকলেও সূর্যাস্তের পর পরই সন্ত্রাসী ও মাদক সেবীদের দখলে চলে যায়। এমনকি পবিত্র ওই শিক্ষাঙ্গণে অসামাজিক কর্মকাণ্ডেরও আলামত মিলেছে। পরিবেশ নিয়ে কাজ করা ওই কলেজেরই শিক্ষার্থীদের সংগঠন টিম ফর এনার্জি অ্যান্ড ইনভায়রনমেন্টাল রিসার্চের (তীর) পক্ষ থেকে ক্যাম্পাসে সম্প্রতি পরিচ্ছন্নতা অভিযান চালানোর পর পরই বিষয়টি সবার নজরে আসে।
পরিবেশবাদী ওই সংগঠনের কর্মীরা বলছেন, মূলত কলেজে সীমানা প্রাচীর না থাকার কারণেই সন্ত্রাসী ও মাদক সেবীদের অবাধ যাতায়াত বেড়েছে এবং তা দিন দিন বেড়েই চলেছে। আর তাদের আনা-গোনা বেড়ে যাওয়ায় ক্যাম্পাসে অনাকাক্সিক্ষত নানা ঘটনাও ঘটছে। সাধারণ শিক্ষার্থীরা জানিয়েছেন, কিছুদিন আগে ক্যাম্পাসের যে অংশে দশ তলা ভবন নির্মাণের কাজ চলছে তার পশ্চিমে পুকুরপাড়ের ঝোপের মধ্য থেকে থেকে বেশ কয়েকটি ধারালো চাকু উদ্ধার করা হয়। এছাড়া সন্ধ্যার পর ক্যাম্পাসে বহিরাগতদের হাতে একজন শিক্ষক লাঞ্ছণার ঘটনাও ঘটেছে। এমন পরিস্থিতিতে ক্যাম্পাস সংলগ্ন মেসগুলোতে থেকে যারা পড়ালেখা করছেন তাদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। 
ছাত্রাবাসে বসবাসকারী শিক্ষার্থীরা কলেজের চারদিকে সীমানা প্রাচীর নির্মাণের পাশাপাশি ক্যাম্পাসের পেছনের সড়কগুলোতে পর্যাপ্ত আলোর ব্যবস্থা এবং রাত্রীকালীন নিরাপত্তা নিশ্চিত করার তাগিদ দিয়েছেন। তবে কলেজ প্রশাসনের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, ক্যাম্পাসে রাত্রীকালীন নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য পুলিশ সুপারকে এরই মধ্যে চিঠি দেওয়া হয়েছে। তাছাড়া সীমানা প্রাচীরের নির্মাণ কাজও দ্রুত শেষ করার জন্য সংশ্লিষ্ট দপ্তরকে বলা হয়েছে।
বগুড়ায় ১৯৩৯ সালে প্রতিষ্ঠিত সরকারি আজিজুল হক কলেজের দু’টি ভবন রয়েছে। শহরের ফুলবাড়ি এলাকায় অবস্থিত পুরাতন ভবনে কেবলমাত্র উচ্চ মাধ্যমিকের শিক্ষার্থীদের পাঠদান করানো হয়। আর স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ে পাঠদানের জন্য ১৯৬২ সালে শহরের কামারগাড়ি এলাকায় ৫৫ একর জায়গা নিয়ে নতুন ভবন নির্মান করা হয়। বর্তমানে সেখানে ২৩টি বিসয়ে অনার্স ও মাস্টার্স কোর্স চালু রয়েছে। নতুন ভবনে প্রায় ৩০ হাজার শিক্ষার্থী রয়েছে। এর চারপাশে গড়ে উঠেছে ব্যক্তিমালিকানাধীন শত শত মেস। তবে ৫৮ বছর আগে প্রতিষ্ঠিত নতুন ভবনের ক্যাম্পাসটির পশ্চিমে এবং উত্তর অংশে সীমানা প্রাচীর দেওয়া হলেও বাকি দু’দিক এখনও ফাঁকা। ক্যাম্পাসের অভ্যন্তরে এবং পেছনে সড়কগুলোর পাশে বৈদ্যুতিক খুঁটি থাকলেও সবগুলোতে সড়ক বাতি নেই। ফলে সন্ধ্যার পর পুরো ক্যাম্পাস এবং সংলগ্ন এলাকা অন্ধকারে ডুবে থাকে।
পরিবেশবাদী সংগঠন ‘তীর’-এর সভাপতি আরাফাত রহমান জানান, সরকারি আজিজুল হক কলেজের নতুন ভবনের ক্যাম্পাসকে পরিচ্ছন্ন রাখার জন্য তারা সব কর্মীকে নিয়ে গত ১২ জানুয়ারি পরিচ্ছন্নতা অভিযান পরিচালনা করেন। এ সময় ক্যাম্পাসের পশ্চিমে কমার্স ভবনের দক্ষিণে সীমানা প্রাচীর সংলগ্ন ফাঁকা জায়গা, উত্তর-পশ্চিমে সীমানা প্রাচীর সংলগ্ন এলাকা এবং খেলার মাঠ থেকে নেমে যাওয়া সরু সড়কের ধারে, নির্মাণাধীন দশতলা একাডেমিক ভবনের অদূরে পুকুর পাড় এবং সংলগ্ন এলাকাতে মাদক সেবনের কাজে ব্যবহৃত নানা ধরনের সরঞ্জাম পড়ে থাকতে দেখা গেছে। এর মধ্যে ফেন্সিডিলসহ কাশির নানা ধরনের সিরাপের শিশি, মদের বোতল, ইয়াবা সেবনের কাজে ব্যবহৃত সিগারেটের প্যাকেটের ভেতরের কাগজ এবং ইঞ্জেকশনের সিরিঞ্জিও রয়েছে। এছাড়া বিভিন্ন স্থানে ব্যবহৃত কনডমও পড়ে থাকতে দেখা গেছে। এসব দেখে তাদের ধারণা হয়েছে, মাদক সেবনের পাশাপাশি সেখানে অসামাজিক কাজও হয়ে থাকে পবিত্র ওই ক্যাম্পাসে। 
গত ১৫ জানুয়ারি বুধবার তিনি এ প্রতিবেদককে ওইসব এলাকা ঘুরিয়ে দেখান। এ সময় ক্যাম্পাসের পশ্চিমে কমার্স ভবনের উত্তরে সীমানা প্রাচীরের পাশে একাধিক ফেন্সিডিলের বোতল ও কয়েকটি ব্যবহৃত কনডম পড়ে থাকতে দেখা গেছে। আরাফাত রহমান বলেন, সন্ধ্যার পর পরই মাদক সেবীরা ক্যাম্পাসের ভেতরে ঢুকে পড়ে। গত ১২ জানুয়ারি পরিচ্ছন্নতা অভিযানকালে তারা ওইসব এলাকা থেকে মদ এবং নানা ধরনের মাদক দ্রব্য সেবন করা হয়েছে বিভিন্ন আকারের ৩৪টি বোতল তারা কুড়িয়ে পেয়েছেন। এছাড়া কয়েকটি ইঞ্জেশকনে সিরিঞ্জও পাওয়া গেছে। আমরা সেগুলো সরিয়ে ফেলেছি এবং কলেজ কর্তৃপক্ষকেও জানিয়েছি। তিনি বলেন, মূলত সীমানা প্রাচীর না থাকার কারণেই মাদক সেবীরা অবাধে ক্যাম্পাসে ঢুকে পড়ছে।
ওই কলেজের মাস্টার্স ইংরেজি বিভাগের ছাত্র অরূপ রতন শীল জানান, ২০১৭ সালে ১৪ ফেব্রুয়ারি রাতে কলেজের বিজ্ঞান ভবনের পেছনে ছিনতাইকারীরা একটি মোবাইল ফোনের জন্য আব্দুল কুদ্দুস নামে এক ব্যক্তিকে খুন করে। এরপর আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকালী বাাহিনীর তৎপরতায় পরিস্থিতি কিছুদিন শান্ত ছিল। কিন্তু কলেজের যে স্থানে দশ তলা ভবনের নির্মাণ কাজ শুরু হয়েছে তার পাশে পুকুরপাড়ে ঝোপের মধ্য থেকে গত ১৯ অক্টোবর ৩টি ধারালো চাকু উদ্ধার এবং তার প্রায় আড়াই মাস পর তীরের পরিচ্ছন্নতা অভিযানে ক্যাম্পাস থেকে মাদক সেবনের সরঞ্জাম ও কনডম পাওয়া গেল। এর মাঝে সন্ধ্যার পর বহিরাগত একজন এক শিক্ষককেও নাজেহাল করেছে। এসব দেখে আমাদের কাছে মনে হয়েছে রাতে ক্যাম্পাসে সন্ত্রাসী ও মাদক সেবীদের আনাগোনা আবারও বেড়ে গেছে।
সরকারি আজিজুল হক কলেজের ব্যবস্থাপনা বিভাগের শিক্ষার্থী আহসান হাবিব বলেন, ক্যাম্পাসে রাতে মাদক সেবীদের তৎপরতা আমাদের শঙ্কিত করে তুলেছে। অবিলম্বে সীমানা প্রাচীর নির্মাণ এবং ক্যাম্পাসে নিরপত্তা বাড়ানো প্রয়োজন। একই বিভাগের শিক্ষার্থী রুনা আকতার বলেন, ‘যতক্ষণ পর্যন্ত না নিরাপত্তা নিশ্চিত না হবে ততক্ষণ পর্যন্ত আমাদের মধ্যে যে ভীতি কাজ করছে তা দূর হবে না।’
ছাত্রলীগ সরকারি আজিজুল হক কলেজ শাখার সাধারণ সম্পাদক আব্দুর রউফ সাধারণ শিক্ষার্থীদের এসব দাবির প্রতি সমর্থন জানিয়ে বলেন, ‘রাতে ক্যাম্পাসটিকে আলোকিত রাখার জন্য সবগুলো বৈদ্যুতিক খুঁটিতে বাতি লাগানো হয়েছিল। কিন্তু তার অনেকগুলো দুর্বৃত্তরা খুলে নিয়ে গেছে। আমরাও মনে করি কলেজে রাত্রীকালীন নিরাপত্তা নিশ্চিত করা প্রয়োজন।’
যোগাযোগ করা হলে সরকারি আজিজুল হক কলেজের অধ্যক্ষ প্রফেসর মোঃ শাহজাহান আলী বলেন, দিনের বেলা কোন সমস্যা নেই। তবে রাতে যাতে কোন দুর্বৃত্ত ক্যাম্পাসে প্রবেশ করতে না পারে সেজন্য প্রয়োজনীয় ফোর্স মোতায়েনে ব্যবস্থা নিতে পুলিশ সুপারকে চিঠি দেওয়া হয়েছে। তিনি বলেন, ‘গত ১৫ জানুয়ারি পুলিশ সুপারকে লেখা চিঠিতে প্রতিদিন রাত ৮টা থেকে পরদিন সকাল ৬টা পর্যন্ত ক্যাম্পাসে ৫জন পুলিশ মোতায়েতনের জন্য অনুরোধ জানানো হয়েছে। এর পাশাপাশি অসমাপ্ত সীমানা প্রচীরের নির্মাণ কাজ দ্রুত শেষ করতে শিক্ষা প্রকৌশল বিভাগকেও অনুরোধ জানানো হয়েছে।