একাদশ সংসদের এক বছর: ঘটেছে নানা নাটকীয়তা

পুণ্ড্রকথা ডেস্ক
প্রকাশ: ৩০ জানুয়ারী ২০২০ ০৬:০৩ ।
প্রচ্ছদ
পঠিত হয়েছে ১০০ বার।

নানা ঘটন-অঘটনে একাদশ জাতীয় সংসদ পার করেছে তার প্রথম বছর। এ সময়ে বিভিন্ন ইস্যুতে হয়েছে নানা ঘটনা। নাটকীয়তার মধ্য দিয়ে বিএনপি ও গণফোরামের সংসদ সদস্যরা শপথ নিয়েছেন। হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের মৃত্যুতে সংসদে বিরোধীদলীয় নেতা ও উপনেতা নির্বাচন নিয়েও ঘটেছে নাটকীয় ঘটনা। এদিকে সংসদীয় কমিটি গঠনে নতুন রেকর্ড করে একাদশ সংসদ। সংসদীয় কমিটির কার্যক্রমেও দশম সংসদের তুলনায় কিছুটা গতিশীল দেখা গেছে।

২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত একাদশ সংসদ নির্বাচনের পর ৩ জানুয়ারি সংসদ সদস্যরা শপথ নেন। নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে আওয়ামী লীগ ৭ জানুয়ারি সরকার গঠন করে। শেখ হাসিনা দেশের ইতিহাসে চতুর্থবারের মতো প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পান। সংসদে বিরোধী দলের স্বীকৃতি পায় জাতীয় পার্টি। পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ বিরোধীদলীয় নেতা ও তার ভাই পার্টির কো-চেয়ারম্যান জিএম কাদের হন বিরোধীদলীয় উপনেতা। একাদশ সংসদের প্রথম বৈঠক বসে ৩০ জানুয়ারি। নির্বাচনের পর কারচুপির অভিযোগ এনে শপথ থেকে বিরত থাকেন বিএনপি ও গণফোরামের নির্বাচিতরা। তারা শপথ নেবেন না বলেও ঘোষণা দেন। কিন্তু প্রায় লোকচক্ষুর আড়ালে পার্টির সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করে ৭ মার্চ শপথ নেন গণফোরাম থেকে নির্বাচিত সুলতান মোহাম্মদ মনসুর আহমেদ। এজন্য তাকে গণফোরাম থেকে বহিষ্কারও করা হয়। এর কয়েকদিন পরে শপথ নেন গণফোরামের মোকাব্বির খান এবং বিএনপির জাহিদুর রহমান জাহিদ (ঠাকুরগাঁও-৩)। এরপর জাহিদকে দল থেকে বহিষ্কারেরও সিদ্ধান্ত হয়। তবে, সব নাটক ও জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে শপথ গ্রহণের বাধ্যবাধকতার শেষ দিনে ২৯ এপ্রিল বিএনপির বাকি ৫ এমপির মধ্যে ৪ জনই শপথ নেন। এদিকে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর শপথ না নেওয়ায় তার আসন (বগুড়া-৬) শূন্য হয়। তবে ওই আসন থেকেই উপনির্বাচনে অংশ নিয়ে বিএনপির প্রার্থী নির্বাচিত হন। শপথ নেওয়ার পাশাপাশি বিএনপি সংরক্ষিত আসনের এমপিও নির্বাচিত করে।

বিরোধী দল জাতীয় পার্টিও এবারের সংসদে নাটকীয় ঘটনার জন্ম দিয়েছে। এরশাদ নিজে বিরোধীদলীয় নেতা ও ভাই জিএম কাদেরকে উপনেতা নির্বাচনের কয়েকদিন পরেই জিএম কাদেরকে উপনেতার পদ থেকে সরিয়ে দশম সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা ও স্ত্রী রওশন এরশাদকে বিরোধীদলীয় উপনেতার পদে বসান। বার্ধক্যজনিত কারণে গত বছরের ১০ জুলাই এরশাদের মৃত্যুর পর বিরোধীদলীয় নেতা ও উপনেতা নির্বাচন নিয়ে আবারও নাটকীয়তা সৃষ্টি হয়। এরশাদের মৃত্যুর পর পার্টির ‘চেয়ারম্যান’-এর দায়িত্বপ্রাপ্ত জিএম কাদের নিজেকে বিরোধীদলীয় নেতার স্বীকৃতি দিতে স্পিকারকে চিঠি দেন। এর পরপরই পাল্টা চিঠি দিয়ে জিএম কাদেরের চিঠি গ্রহণ না করার অনুরোধ করেন রওশন এরশাদ। পরে অবশ্য রওশনকে বিরোধীদলীয় নেতা ও জিএম কাদেরকে উপনেতার স্বীকৃতির মধ্য দিয়ে ওই সমস্যার সমাধান হয়। খবর বাংলা ট্রিবিউন

সংসদীয় কমিটির কার্যক্রম

জাতীয় সংসদের ইতিহাসে সব রেকর্ড ভঙ্গ করে একাদশ সংসদ সব থেকে কম সময়ের মধ্যে মন্ত্রণালয় ও সংসদবিষয়ক ৫০টি কমিটি গঠন করে। প্রথম অধিবেশনের মাত্র ১০ কার্যদিবসের মধ্যে কমিটিগুলো গঠন হয়।

কমিটিগুলো গঠন শেষ হওয়ার পর স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী বলেছিলেন, সংসদ নেতা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার শত ব্যস্ততার মাঝেও সংসদের বৈঠক চলাকালীন সংসদ কক্ষে উপস্থিত থেকে অত্যন্ত ধৈর্যসহকারে অনেক সময় দিয়ে নিজের হাতে লিখে কমিটি গঠনের কার্যক্রম সম্পন্ন করেছেন।

কমিটি গঠনের পাশাপাশি শুরুর দিকে কমিটিগুলো নিয়মিত বৈঠক অনুষ্ঠানসহ ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে শুরু করে। অবশ্য পরবর্তী সময়ে এই কার্যক্রমে খানিকটা ভাটা পড়ে। কোরাম সংকটের কারণেও কিছু কিছু কমিটির বৈঠক বাতিল করার ঘটনাও ঘটে।

সংসদ সচিবালয় সূত্রে জানা গেছে, গত এক বছরে কয়েকটি সংসদীয় কমিটি নিয়মিত বৈঠক করলেও বেশিরভাগের ক্ষেত্রে ছন্দপতন ঘটেছে। সংসদীয় কমিটির মধ্যে সরকারি হিসাব ২২টি, নৌ পরিবহন ১৬টি, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ ১২টি, পররাষ্ট্র ১০টি, সরকারি প্রতিশ্রুতি ১০টি, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক ১০টি, মহিলা ও শিশু ১০টি, পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক ১০টি, গৃহায়ন ও গণপূর্ত ৯টি, স্বরাষ্ট্র ৯টি, আইন ৯টি,  বেসামরিক বিমান ৯টি, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ ৯টি, পানিসম্পদ ৯টি, কৃষি ৯টি, শিক্ষা ৮টি,  প্রবাসী কল্যাণ ৮টি, বাণিজ্য ৮টি,  দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ ৮টি, সংস্কৃতি ৮টি, রেলপথ ৮টি, সমাজ কল্যাণ ৭টি, বস্ত্র ও পাট ৭টি, শ্রম ও কর্মসংস্থান ৭টি, প্রতিরক্ষা ৭টি, সরকারি প্রতিষ্ঠান ৭টি, অনুমিত হিসাব ৬টি, সংসদ কমিটি ৬টি, শিল্প ৬টি, যুব ও ক্রীড়া ৬টি, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা ৬টি, জনপ্রশাসন ৫টি, পার্বত্য ৫টি, পরিকল্পনা ৫টি, ধর্ম ৫টি, ডাক ও টেলি যোগাযোগ ৫টি, তথ্য ৫টি, ভূমি ৫টি, খাদ্য ৪টি, সড়ক পরিবহন ও সেতু ৪টি, স্থানীয় সরকার পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের ৪টি, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ৪টি, স্বাস্থ্য ৪টি এবং অর্থ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির ৩টি বৈঠক হয়েছে।

অবশ্য, সরকারি হিসাব সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির বেশি সংখ্যক বৈঠক অনুষ্ঠানের নেপথ্যের কাহিনিও ভিন্ন। এই কমিটি বৈঠকের সংখ্যা বাড়াতে অন্তত ৪টি বৈঠকে দুটি করে সভা করেছে। সংসদ সচিবালয়ের কর্মকর্তারা জানান, দশম সংসদেও এই কমিটি এই প্রক্রিয়ায় বৈঠকের সংখ্যা বাড়িয়েছিল। ওই কমিটি ৫ বছরে শতাধিক বৈঠক করে রেকর্ড করেছিল। তারই পথ ধরে হাঁটছে এবারের সরকারি হিসাব সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটি।

বিএনপির ওয়াক আউট

চলতি সংসদের বিরোধী দল জাতীয় পার্টি সংসদ থেকে এখনও একবারও ওয়াক আউট করেনি। তবে, ওয়াক আউট করছে বিএনপি। বিএনপি সংসদের স্বীকৃত বিরোধী দল না হলেও তারা নিজেদের প্রকৃত বিরোধী দল দাবি করে থাকে। দলটি সরকারি দল আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে অপ্রসাঙ্গিক বক্তব্য দেওয়ার অভিযোগ তোলে এবং ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন দাবি করে গত ১৪ জানুয়ারি ওয়াক আউট করে। এটি ছিল প্রথম বছরের একমাত্র ওয়াক আউটের ঘটনা।

মারা গেছেন সাত এমপি

সংসদের প্রথম বছরে সাত জন সংসদ সদস্য মারা গেছেন। এদের মধ্যে শপথ নেওয়ার আগেই মারা যান আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম। একাদশ সংসদের এমপিরা যেদিন শপথ নেন, ঠিক সেদিনই (৩ জানুয়ারি) ব্যাংককে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান। অবশ্য শপথ নেওয়ার আগেই মারা যাওয়ায় তাকে সংসদ সদস্য হিসেবে গণ্য করা হয়নি। সংসদে তার আসনও  শূন্য ঘোষণার দরকার পড়েনি। গত বছরের ১৪ জুলাই মারা যান সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। ৭ নভেম্বর মারা গেছেন বাংলাদেশ জাসদের কার্যকরী সভাপতি মইন উদ্দীন খান বাদল। গত ২৭ ডিসেম্বর মারা যান গাইবান্ধা-৩ আসনের সংসদ সদস্য মো. ইউনুস আলী সরকার।  ১০ জানুয়ারি মারা যান বাগেরহাট-৪  আসনের ডা. মোজাম্মেল হোসেন। ১৮ জানুয়ারি মারা যান বগুড়া-১ আসনের আবদুল মান্নান এবং সর্বশেষ ২১ জানুয়ারি যশোর-৬ আসনের এমপি ও সাবেক জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ইসমাত আরা সাদেক মারা গেছেন।

যা বললেন স্পিকার

সংসদের প্রথম বছরের কার্যক্রম সম্পর্কে স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘প্রথম বছর সংসদ খুবই ভালো চলেছে। সংসদ যাত্রা করার পর ৫টি অধিবেশন শেষ করে ষষ্ঠ অধিবেশন শুরু করেছে। অনেক গুরুত্বপূর্ণ আইন এবছর পাস হয়েছে। প্রস্তাব সাধারণের ওপর আলোচনা হয়েছে। প্ল্যানেটারি ইমার্জেন্সির মতো গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়েছে।’

স্থায়ী কমিটিগুলো ভালো চলছে দাবি করে স্পিকার বলেন, ‘কিছু কমিটি আছে যাদের নিয়মিত বৈঠক করার দরকার নেই। মন্ত্রণালয়ভিত্তিক কমিটিগুলোর প্রতিমাসে বৈঠক করার কথা বলা আছে। আমার মনে হয়, তাদের বেশিরভাগই রেগুলার বৈঠক করছে।’

সংসদে বিএনপির যোগদানের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘সংসদে বিএনপির ভূমিকাও ভালো ছিল। তারা যথেষ্ট কথা বলার সুযোগ পাচ্ছেন। যেকোনও বিষয়ে তারা অন্য যেকোনও সংসদ সদস্যের মতো অংশগ্রহণের সুযোগ পাচ্ছেন। সংসদীয় কার্যক্রমে বিধি অনুযায়ী অংশগ্রহণের সুযোগ পাচ্ছেন।’