ভৌতিক গল্পঃ অ-মানবী [শেষ পর্ব]
সাজিয়া আফরিন সোমা
আজ বেশ দেরিতে ঘুম ভাঙ্গে রুমার,জেগে দেখে চারিদিকে রোদ। সাকলে পল্লবকে রাতের ঘটনা বলতে গেলে পল্লব হেসে উড়িয়ে দেয়। এ যুগে ভূত প্রেত বলে কিছু বিশ্বাস করলে সেটা লোক হাসানো ছাড়া আর কি?! বলে পল্লব। রুমার অবশ্য দিনের বেলা একটুও ভয় করে না ,যত ঝামেলা বাধে সন্ধ্যার পর। এবার বাড়ি গেলে একটা ছোট মেয়ে আনতে হবে সাথে সাথে থাকবার জন্য - ভাবে রুমা। একা একা যত সব অদ্ভুত চিন্তা মাথায় আসে। আশপাশের কারো সাথে এখনও পরিচয় হয়নি,একা একা সময়ও কাটনো যায় না। বাড়িটার দুইটা বেডরুম আর ড্রইং রুমটা শুধুই পরে থাকে,আর সন্ধ্যার পর থেকে তো ওদিকে একা যেতেই রুমার গা ছম ছম করে কদিন থেকে। আর শেয়ালের ডাকে চারিদিক কেমন ভয়ঙ্কর হয়ে উঠে সন্ধ্যা থেকেই।
তাছাড়া সেদিন পর্দার ওই ভারী রেলটা খুলে আড়াআড়ি ভাবে বসবার ঘরের বিছানায় উপর পরে থাকাটা রুমার কাছে ঠিক মনে হয়নি। ওই রেলটা খুলে পর্দা লাগাতে গিয়ে বুঝেছিলো ওটা কত মজবুত করে লাগানো,অথচ সেদিন সকালে ঘরে গিয়ে দেখে ওটা খুলে পরে আছে। আগের রাতে পল্লব অনেক রাত ও ঘরে কম্পিউটারে কাজ করে এসে ঘুমিয়েছিলো,তখন ওটা ঠিকই ছিলো!!! এই অদ্ভুত সব ঘটনার কোন ব্যাখ্যা নাই,শুধু গা ছম ছম করা ছাড়া,মনে মনে ভাবে রুমা।
আজ সারাদিন রুমা শুয়েই কাটিয়েছে,কাজ ছিলোনা বলে। তাই রাতে রুমার চোখে ঘুম নেই,এদিক ওদিক হচ্ছে বার বার। একা জেগে থাকতেও ভয় হয় এখন,আজও ফুলের গন্ধ আসছে। গন্ধে কোন ভাবেই সে ঘুমাতে পারছে না। রুমা ভাবছে- না জানি আবার আজ সেই কান্না শুনতে হবে!
হঠাৎ ঘরের বন্ধ দরজার দিকে চোখ যায়,একটা অস্পষ্ট কিছু দেখা যাচ্ছে দরজার কাছে! রুমা দরজার দিকে স্থির ভাবে তাকিয়ে থাকে - হ্যা ওই তো খুব আলতো পায়ে,লম্বা সাদা কিছু। পুরোটা সাদা। না না সাদা না। কেমন যেনো ধোয়ার মতো হালকা,কিন্তু আবছা না,অনেকটা পরিষ্কার। আলাদা করে তার শরীরের কিছু বোঝা যাচ্ছে না,ভালো করে দেখার চেষ্টা করলো রুমা,ধোয়া কি এসব? কিন্তু সেটা তো এগিয়ে আসছে একটু একটু করে,খুবই ধীরে।
সত্যিই তো! এগিয়ে আসছে খুব ধীর পায়ে,ঠিক যেনো ভেসে ভেসে ওর কাছেই আসছে। রুমা- পল্লব? পল্লব? বলে ডাকলো কিন্তু গলা থেকে কোন আওয়াজ বেরুলো না,পাশ ফিরে ধাক্কা দিবার মতো কোন শক্তি নেই। ভয়ে নড়াচড়াও করতে পারছেনা। পুরো শরীর শক্ত হয়ে আছে। ওটা এগিয়ে আসছে,প্রায় কাছাকাছি চলে এসেছে। ঘামছে রুমা খুব,এবার সমস্ত শক্তি দিয়ে প……ল্লব?পল্লব? বলে চিৎকার করে উঠলো।এবার গলা থেকে শব্দ বের হলো। রুমার চিৎকারে পল্লব উঠে বসলো। রুমা তখনও চিৎকার করছে আর কাঁপছে। রুমার গায়ে হাত দিয়ে একটু ঝাকুনি দিয়ে - বলে কি হলো চিৎকার করছো কেনো?
রুমার মুখ থেকে কোন কথা বেরুলো না,শুধু আঙ্গুল উঠিয়ে দেখালো কিছু একটা। ততক্ষনে ধীর পায়ে ওটা রুমার পাশদিয়ে জানালার দিকে এগিয়ে গেছে। পল্লব চিৎকার করে উঠে কে? কে ? কোন পরিবর্তন নেই ভেসে যাওয়া সাদা জিনিসটার। সে তার গতিতে জানালা দিয়ে বেরিয়ে গেলো। বেরিয়ে যাওয়ার সময় শুধু ওয়ারড্রব এর উপর থেকে রুমার ব্যাগটা পরে গেলো।
ঠিক তখনই যেনোদৌড়াদৌড়ি শুরু হয়ে গেলো পুরো বাড়িতে,যেনো দৌড় প্রতিযোগিতা হচ্ছে বাড়ির ওদিকটায়। কয়েকজন মিলে দৌড়াচ্ছে এদিক থেকে ওদিক। পল্লব উঠে পরে বিছানা থেকে। দৌড়ানোর শব্দ কেনো বাড়িতে? দরজা খুলে ডাইনিং এ চলে আসে,সাথে রুমাও। চারদিক বন্ধ। এদিকে কোন শব্দ নাই। এখন শব্দটা হচ্ছে বসবার ঘরে,যেনো দৌড়িয়ে গিয়ে ঘরের একদিকের দেয়ালে কয়েকজন ধাক্কা দিয়ে আবার আর একদিকে দৌড়াচ্ছে! দুজন বসার ঘরে গিয়ে আলো জালালো,না সেখানে আর কোন শব্দ নেই। এখন ওদের বেডরুম থেকে আসছে ছোটাছুটির শব্দ,আর সাথে কোন মেয়ের কন্ঠের মিষ্টি হাসি। যেনো কেউ কারো সাথে খুনসুটি করছে! মাঝ রাতে এমন মিষ্টি হাঁসিও যে কত ভয়ঙ্কর হতে পারে!! ভয়ে গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠে।
ওরা ওদিকে যাবে দেখতে ঠিক তখনই বলটা ছুটে এসে রুমার পায়ে লাগলো,রুমা ভয় পেয়ে চিৎকার করে পল্লবের পেছনে লুকালো। এটা পল্লবের বল,ও খেলতো। বাড়ি বদলানোর সময় বলটা তোলা ছিলো যে প্যাকেটে সেটা এখনও খোলা হয়নি,কিন্তু সেটা বাইরে এলো কি করে? আর বন্ধ চারিদিকে বল এভাবে গড়িয়ে আসলো কি ভাবে?
পল্লব রুমার হাতটা ধরে আছে শক্ত করে,এবার হঠাৎ সব নিস্তব্ধ,কেউ নেই চারপাশে যেনো। কোন হাসির শব্দও নেই,নেই দৌড়াদৌড়ি। কান মাথা ঝাঁ ঝাঁ করছে রুমার। কি করবে? ঘরে যাবে কি না ভাবছে,ঠিক তখনই করুন গলায় কান্নার শব্দ। একটু একটু করে বাড়ছে সেটা,খুব কষ্টের কান্না ওটা। একটা মেয়ে কাঁদছে খুব,কি এক কষ্ট পেয়ে কাঁদছে সে! কান্নার শব্দ ভয়ঙ্কর একটা পরিবেশ তৈরী করেছে। ভয়ে দুজনই কোন কথা বলতে পারলো না। রুমা আর পল্লব বাকি রাত পাশাপাশি বসেই কান্না শুনে কাটালো।
সকালে ঝলমলে রোদ এসে ঢুকছে জানালা দিয়ে, রাতের সব অশুভ শক্তি যেনো কোথায় হারিয়ে গেছে। তবে আর না,আর একটা দিনও না এ বাড়িতে। রুমা- পল্লব দুজনই ভাবে- আজই ওরা এ বাড়ি থেকে চলে যাবে। সকাল সকাল ব্যাগ গুছিয়ে নিলো রুমা।
দরজার বাইরে এসে রুমা বার বার পিছনে ফিরে দেখছে,কেমন যেনো গুমোট একটা পরিবেশ,আর সিঁড়ি ঘর। গা ছমছম করছে সিড়ির দিকে তাকিয়ে,মনে হচ্ছে কেউ তাকিয়ে আছে ওদের দিকে। কেউ কি আসছে ওদের সাথে? এমন সময় কানের পাশে কেউ ফিস ফিস করে কিছু বলতে চাইলো। শুধু ফিসফিস করে কিছু,কিন্তু সবই বাতাসে ভেসে গেলো দূরে। কোথা থেকে যেনো……. চুড়ির রিন রিন শব্দ রুমার মাথায় ভিতরে ঢুকে আঘাত করছে। কাঁচের চুড়ির শব্দ! কেউ কি কাঁদছে নাকি হাসছে রুমাদের চলে যাওয়ার খুশিতে,ঠিক পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে না? নাহ্ আর দেরি করলে রুমার মাথা পুরোটায় এলোমেলো হয়ে যাবে। রুমা দ্রুত সিঁড়ি দিয়ে নেমে এসে পল্লবের পাশে রিক্সায় উঠে বসে। ওরা চলে যাচ্ছে,আর চুড়ির রিন রিন শব্দও আস্তে আস্তে দূরে সরে যাচ্ছে….. আর দূর বারান্দায় দাড়িয়ে তাদের দিকে তাকিয়ে আছে একটা ছায়া,রুমা পিছনে না তাকিয়েই যেনো বুঝতে পারলো দু-হাত ভরা চুড়ি পরে এক অপরুপ সুন্দরী বারান্দায় দাঁড়িয়ে তাদের চলে যাওয়া দেখছে!