আদালতের নিষেধাজ্ঞা আরোপ

বগুড়ায় ব্যক্তিমালিকানাধীন জমি সরকারি দেখিয়ে মহাসড়কের জন্য অধিগ্রহণের চেষ্টা

পুণ্ড্রকথা রিপোর্ট
প্রকাশ: ০৮ মার্চ ২০২০ ১৩:১১ ।
প্রচ্ছদ
পঠিত হয়েছে ৩২৫ বার।

ব্যক্তি মালিকানাধীন জমিগুলোকে হাটের সরকারি জায়গা দেখিয়ে তা দখলের চেষ্টার কারণে বগুড়ার শাজাহানপুর উপজেলার নয়মাইল এলাকায় ঢাকা-রংপুর মহাসড়ক চার লেন-এ উন্নীতকরণ অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। কারণ ভূমি মালিকরা জেলা প্রশাসনের বিরুদ্ধে এরই মধ্যে আদালতের দ্বারস্থ হয়েছেন। আর বিচারকও ভূমি অধিগ্রহণ প্রক্রিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছেন। 
ফলে নয়মাইল এলাকার আগে এবং পরে  স্থাপনা উচ্ছেদের কাজ পুরোদমে চললেও ওই অংশে মহাসড়কের প্রায় ৩০০ মিটার  সম্প্রসারণের কাজ আটকে আছে। ভূমি মালিকরা জানিয়েছেন, সরকারিভাবে ভূমি অধিগ্রহণের প্রস্তাব এবং ক্ষতিপূরণের অর্থপ্রাপ্তির নিশ্চয়তা না পাওয়া পর্যন্ত তারা মামলা চালিয়ে যাবেন। এমনকি ন্যায্য দাবি আদায়ে লাগাতার আন্দোলনে যাওয়ারও হুমকি দিয়েছেন তারা। এতে করে মহাসড়কের ওই অংশে সম্প্রসারণ কাজ শুরু করা নিয়ে অনিশ্চয়তা সৃষ্টি হয়েছে।
তবে সৃষ্ট এ অচলাবস্থার জন্য স্থানীয় সচেতন নাগরিকরা বগুড়া জেলা প্রশাসনকে দায়ী করেছেন। তারা বলছেন, জেলা প্রশাসন শুরুতে হাটের ওই জায়গা ব্যক্তি মালিকানাধীন বলে স্বীকার করলেও পরবর্তীতে তা অস্বীকার করেই পরিস্থিতিকে জটিল করে তুলেছে। সচেতন নাগরিক কমিটির (সনাক) বগুড়া জেলা সভাপতি মুক্তিযোদ্ধা মাসুদার রহমান হেলাল বলেন, যেহেতু জেলা প্রশাসনই জটিলতা সৃষ্টি করেছ তাই তাদেরকেই তা সমাধানে এগিয়ে আসতে হবে।
টাঙ্গাইলের এলেঙ্গা থেকে সিরাজগঞ্জের হাটিকুমরুল হয়ে রংপুর পর্যন্ত মহাসড়ক ৪ লেনে উন্নীত করার জন্য বর্তমানে ওই মহাসড়কের দু’পাশে জমি অধিগ্রহণ এবং স্থাপনা উচ্ছেদের কাজ চলছে। বগুড়ার শাজাহানপুর উপজেলায় ৩০০ মিটার সম্প্রসারণের জন্য ঢাকা-রংপুর মহাসড়ক পূর্ব পাশে ‘নয়মাইল হাট’ হিসেবে ব্যবহৃত জামালপুর মৌজার ২ দশমিক ৭৬ একর জমি প্রয়োজন। কিন্তু ওই পরিমাণ জমির মধ্যে মাত্র সাড়ে ৬ ভাগ বা শূন্য দশমিক ১৮ একর জায়গা খাস ও দানপত্র দলিলমূলে সরকারি নিয়ন্ত্রণে। বাদবাকি ৯৩ দশমিক ৪৮ ভাগ বা ২ দশমিক ৫৮ একর জমিই ব্যক্তি মালিকানাধীন। মহাসড়ক সংলগ্ন ওই জমির মালিকরা বিভিন্ন সময় বসত-বাড়ি, বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান ও দোকান-পাট নির্মাণ করেছেন। তবে মহাসড়ক চার লেনে উন্নীত তথা সম্প্রসারণের প্রয়োজনে অধিগ্রহণের প্রয়োজনীয়তার কথা বলে প্রায় এক বছর আগে ২০১৯ সালের ৭ ফেব্রæয়ারি বগুড়া জেলা ভূমি অধিগ্রহণ কর্মকর্তার কার্যালয় থেকে ওই জমির মালিকদের নামে ৪ ধারায় চিঠি দেওয়া হয়। 
তবে ভূমি মালিকরা অভিযোগ করেছেন, পরবর্তীতে ৭ ধারায় দেওয়া চুড়ান্ত নোটিশে জায়গাগুলো শুধু নয়মাইল হাটের নামে (সরকরি নিয়ন্ত্রণে) এবং ওই জায়গাগুলোতে কোন স্থাপনা নেই বলেও উল্লেখ করা হয়েছে। ব্যক্তি মালিকানাধীন জমিগুলোকে এভাবে হাটের জায়গা এবং তাতে কোন স্থাপনা নেই উল্লেখ করে মহাসড়কের নামে নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার তৎপরতার বিরুদ্ধে জমি মালিকরা প্রথমে জেলা প্রশাসকের সঙ্গে দেখা করে মৌখিক ও লিখিতভাবে আপত্তি জানান। কিন্তু তার পরেও কোন ফল না পাওয়ায় জমি মালিকরা চলতি বছরের ফেব্রæয়ারি মাসে বগুড়ার প্রথম যুগ্ম জেলা জজ আদালতে জেলা প্রশাসককে বিবাদী করে মামলা করেন। শুনানী শেষে আদালতের বিচারক মোঃ শাহাদত হোসেন বাদী পক্ষের জমি দখলের ব্যাপারে জেলা প্রশাসনের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেন।
 সরেজমিন নয়মাইল এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, ওই এলাকার আগে এবং পরে মহাসড়ক সম্প্রসারণের জন্য স্থাপনা উচ্ছেদের কাজ এগিয়ে চলছে। শুধু নয়মাইল হাট এলাকায় সম্প্রসারণের প্রাথমিক কাজ থমকে আছে। ওই এলাকার বাসিন্দা আবুল বাশার জানান, নয়মাইল হাটের সিংহভাগ জায়গা ব্যক্তি মালিকানাধীন। পৈতৃক কিংবা ক্রয় সূত্রে তারা এসবের ভোগদখল করছেন। উপজেলা ও জেলা প্রশাসনও তা জানে। এমনকি দীর্ঘদিন ধরে ব্যক্তি মালকানাধীন ওই জায়গা হাটের নামে অধিগ্রহণের জন্য ইতিপূর্বে জেলা প্রশাসন থেকে ভূমি মন্ত্রণালয়ে অনেক লেখালেখিও হয়েছে। সর্বশেষ প্রায় ৪ বছর আগে ২০১৬ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর তৎকালীন বগুড়া জেলা প্রশাসক আশরাফ উদ্দিন ভূমি সচিবের কাছে যে চিঠি দিয়েছেন তাতে নয়মাইল হাট হিসেবে ব্যবহৃত ২ দশমিক ৫৮ একর জমি পেরিফেরীভুক্ত করার জন্য অধিগ্রহণের প্রস্তাব দেন। এজন্য ১৩ কোটি টাকা বরাদ্দও চাওয়া হয়। তিনি বলেন, ‘এখন প্রশাসনের কর্মকর্তারা ওই জায়গা হাটের বলে দাবি করছেÑযা অত্যন্ত হাস্যকর।’ 
আব্দুল হাকিম মÐল নামে অপর এক জমি মালিক জানান, এলাকাবাসীর কেনাকাটার সুবিধার্তে তিনিসহ ৪০ ব্যক্তির মালিকানাধীন জায়গায় প্রতি সোমবার ও বৃহস্পতিবার বসানো হয়। আর উপজেলা প্রশাসন ইজারা দিয়ে প্রতি বছর বিপুল পরিমান রাজস্ব পায়। তার অভিযোগ প্রশাসন এখন এতটাই একচোখা হয়ে গেছে যে, মহাসড়কের পাশে তার মালিকানাধীন পাঁচতলা ভবনকেও এখন দেখতে পাচ্ছে না। তিনি বলেন, সরকারিভাবে দেওয়া ৪ ধারার নোটিশে জায়গাগুলোকে ব্যক্তি মালিকানাধীন বলে স্বীকার করে নেওয়ার পর কোন রহস্যজনক কারণে ৭ ধারার নোটিশে সেগুলো আবার হাটের জায়গা এবং কোন স্থাপনা নেই বলা হচ্ছে সেটি আমাদের বোধগম্য নয়।’ আসাদুজ্জামান নামে অপর এক মালিক জানান, তারা সড়ক সম্প্রসারণের পক্ষে। এজন্য সরকার নির্ধারিত মূল্যে তাদের জমি অধিগ্রহণ করতে হবে। তিনি বলেন, ‘আমরা প্রশাসনের কাছে ন্যায্যতা পাচ্ছি না বলেই আদালতে গেছি। দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত আমরা মামলা চালিয়ে যাব এমনকি অনশনসহ লাগাতার আন্দোলন চালিয়ে যাব।’
সচেতন নাগরিক কমিটির (সনাক) বগুড়া জেলা শাখার সভাপতি মুক্তিযোদ্ধা মাসুদার রহমান হেলাল জানান, নয়মাইল এলাকাকায় সড়ক সম্প্রসারণ করা নিয়ে যে অচলাবস্থা তৈরি হয়েছে তার জন্য জেলা প্রশাসনই দায়ী। তিনি বলেন, জমি মালিকদের দাবিটি ন্যায্য। আমরা আশাকরি প্রশাসনের কর্মকর্তারা তাদের সেই ন্যায্য দাবি মেনে নিয়ে অতিদ্রæত জমি অধিগ্রহণের ব্যাপারে পদক্ষেপ নিবেন।
বগুড়ার জেলা প্রশাসক ফয়েজ আহাম্মদ জানান, নয়মাইল হাট সংলগ্ন এলাকার জমিগুলো অনেকে তাদের পৈতৃক বা ক্রয় সূত্রে মালিকনা দাবি করে অধিগ্রহণের জন্য ক্ষতিপূরণ পাওয়ার যোগ্য বলে দাবি করেছেন। বিষয়টি দেখার জন্য এরই মধ্যে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসকসহ (রাজস্ব) সংশ্লিষ্টদের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। তিনি বলেন, ‘তারা (ভূমি মালিক) আইনের আশ্রয় নিয়েছেন। আদালত যে আদেশ দিবেন আমরা তা মেনে চলবো। তবে ফোর লেনের কাজের কোন ক্ষতি হবে না।’