উহানে স্বেচ্ছায় থেকে যাওয়া বাংলাদেশি পরিবারের গল্প

পুণ্ড্রকথা ডেস্ক
প্রকাশ: ০৯ মার্চ ২০২০ ১৩:৪৭ ।
প্রচ্ছদ
পঠিত হয়েছে ২৪৪ বার।

পড়ালেখার উদ্দেশ্যে ২০১৪ সালের ৩১ অগাস্ট চীনের উহান শহরে আসি। ২০১৮ সালের মাঝামাঝি পড়াশোনা শেষ করার পর থেকে উহান বিশ্ববিদ্যালয়ে পোস্ট ডক্টরাল রিসার্চ ফেলো হিসেবে কর্মরত আছি।

করোনাভাইরাস সংক্রমণ শুরু হওয়ার পর আমি, আমার স্ত্রী ও আমাদের ৩ বছরের ছেলে সবাই উহানেই থেকে যাই। এখন পর্যন্ত প্রাণঘাতী এ ভাইরাসে প্রায় ৯০টিরও বেশি দেশের মানুষ সংক্রমিত হয়েছেন। তবে আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা বিশ্বের মধ্যে চীনেই সর্বাধিক। চীনের মধ্যে উহান শহরের অবস্থা বেশি নাজুক। সৃষ্টিকর্তার ইচ্ছায় আমরা সেই উহান শহরে এখনও সুস্থ ও খুব ভাল আছি। খবর বিডিনিউজ২৪ 

এ সংকটময় পরিস্থিতিতে অন্য সবার মতো আমরাও খুবই সামান্য সময়ের জন্য কিছুটা সমস্যার সম্মুখীন হয়েছিলাম। কারণ, গত ২৩ জানুয়ারি ২০২০ থেকে উহানের সব সাধারণ নাগরিকদের তাদের নিজেদের বাসস্থানে অবস্থান করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

শুধু নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি কেনার জন্য আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিতরের সুপারশপে যেতে পারি। এ সুপারশপে এখন মাছ ও হালাল গোস্ত পাওয়া যায় না। তাই আমরা একটু চিন্তিত আমাদের ৩ বছরের বাচ্চার পুষ্টির ভারসাম্য নিয়ে। ঠিক সেই সময়েই আমার বন্ধু চীনা মুসলিম সোলায়মান তার সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন। আমি তাকে জানালাম এ মহামারীর কারণে আমাদের দেশের যারা উহানে ছিল তার প্রায় ৯০ ভাগই বিশেষ ফ্লাইটে দেশে ফিরে গেছে। কিন্তু ধর্মীয় নির্দেশ অনুযায়ী, আমরা পরিবারসহ উহানেই থেকে গেছি শুনে তিনি খুবই খুশি হলেন এবং জানালেন উনি ও উনার পরিবার একই কারণে উহান ছেড়ে যাননি।

সোলায়মান ভাইয়ের সাথে আমার পরিচয় তাবলীগের কাজ করার সূত্রে। উনি মূলত চীনের নিংশিয়া প্রদেশের উজহং শহর থেকে উহানে ব্যবসার উদ্দেশ্যে এসেছেন। এখানে সোলায়মান ভাই খাওয়ার হোটেল ও হালাল মাংসের ব্যবসা করেন। যে কথা বলছিলাম, বর্তমানে উহানে মাছের কিছুটা সংকট দেখা দিয়েছে। তাই বিশ্ববিদ্যালয়ের সুপারশপে মাছ পাওয়া যাচ্ছে না। কিন্তু উনাকে আমার ছোট ছেলের কথা বলায় উনি অনেক খুঁজে প্রায় ৫-৬ কেজি কিনে বিশ্ববিদ্যালয়ের গেইটে দিয়ে যান।

শুধু মাছই নয়, সঙ্গে দুধ ও অন্যান্য খাবারসামগ্রী তিনি নিজে এসে পৌঁছে দিয়ে যান। এ সংকটময় পরিস্থিতিতে উনার এই সাহায্যে আমরা খুবই অভিভূত হই। আরও অবাক করা বিষয় হল, এ সমস্ত খাদ্য-দ্রব্যাদির জন্য উনি কোন অর্থ নেননি। যদিও আমি তাকে উইচ্যাটের মাধ্যমে অর্থ দিয়েছিলাম, কিন্তু উনি ওই অর্থ আমাকে ফিরিয়ে দেন এবং বলেন তুমি যদি এগুলোর বিনিময়ে আমাকে অর্থ দাও তাহলে তোমার সঙ্গে আমি আর যোগাযোগ রাখব না।

সোলায়মান ভাই ও উনার পরিবার বর্তমানে উহানে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করছেন। করোনাভাইরাসে সংক্রমিত ব্যক্তিদের সেবা দেওয়ার জন্য অন্যদের মতো চীনের অন্যান্য প্রদেশ ও শহর থেকে বেশ কিছু মুসলিম চিকিৎসা কর্মী উহানে এসেছেন। মূলত তাদের হালাল খাবারের ব্যবস্থা করেন আমাদের সোলায়মান ভাই।আমাদের ঘরে আগে থেকেই মুরগি ও ছাগলের মাংস আগের থেকে কেনা ছিল। কিন্তু আমরা প্রায় দেড় মাস হালাল মাংস কেনার জন্য বাইরে যেতে পারছি না। যদিও আমার বাসায় এখনও তিন থেকে সাড়ে তিন কেজি মুরগি ও ছাগলের মাংস আছে। তারপরও ভবিষ্যতের নিরাপত্তার জন্য ও অন্যান্য ভাইদের মাংস শেষ হয়ে যাওয়ায় সোলায়মান ভাইকে মাংস সরবরাহের কথা জানাই। কারণ উনি আমাকে বলেন আমার ও অন্যান্য মুসলিমদের (উহানের অন্য যে কোন বিশ্ববিদ্যালয়) যদি কিছু প্রয়োজন হয় তাহলে উনাকে যেন অবশ্যই জানাই।

উনি জানান, গরুর মাংস পর্যাপ্ত পরিমানে উনার কাছে মজুত আছে। তাই আমরা কয়েকজন মিলে সোলায়মান ভাইয়ের কাছ থেকে আমাদের চাহিদা অনুযায়ী গরুর মাংস কিনি। যদিও বর্তমানে উহানে সবকিছুরই দাম একটু বেশি, তারপরও উনি বলেন- মুসলিম বলে দাম বেশি নেবেন না। আগের বারের মতো এবারও বিশ্ববিদ্যালয়ের গেইটে গোস্ত আনতে গিয়ে দেখি আমার মতো অন্য আরও একজন মুসলিম ভাই সোলায়মান ভাইয়ের কাছ থেকে প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি সংগ্রহ করার জন্য ওখানে উপস্থিত হয়েছেন। গতবারের মতো এবারও মাংসের সঙ্গে সোলায়মান ভাই ডিম, আলু, টোমাটো ও বাঁধাকপি নিয়ে হাজির।

আমার মনে হয় মহান সৃষ্টিকর্তা উনাদের মতো মানুষদের জন্যই এ পৃথিবী এখনও টিকিয়ে রেখেছেন। সোলায়মান ভাইসহ সমস্ত মুসলিমকে এবং পাশাপাশি যে সমস্ত অমুসলিম এ সংকটময় পরিস্থিতিতে মানুষের সেবা করছেন আল্লাহর কাছে তাদের জন্য দোয়া করছি।

 

লেখক: পোস্ট ডক্টরাল রিসার্চ ফেলো, উহান বিশ্ববিদ্যালয়, হুবেই, চীন