ছোটগল্পঃ সাইনবোর্ড

আল-আমিন খান সাগর
প্রকাশ: ১৭ মার্চ ২০২০ ০৯:২৪ ।
প্রচ্ছদ
পঠিত হয়েছে ৭৮৩ বার।

ভোরের আলো দরজায় পড়তে না পড়তে শানু আপার ডাকে ঘুম ভেঙ্গে যায় পরেশের। ঘুমের আড়মোরা ভেঙ্গে সে উঠে বসে। কিছু বুঝে ওঠার আগে শানু আপা একটি প্রোজেক্টের ফাইল ধরিয়ে দেয়। ফাইলটি হাতে নিয়ে পরেশ পাশে রেখে উঠে দাঁড়ায়। বেলকুনিতে কিছুক্ষণ পায়চারি করে তারপর সোজা বাথরুম। 
নাস্তা করতে বসে শানু আপা ফাইল নিয়ে পরেশকে কাজ বুঝিয়ে দেয়। পরেশ নীরব থাকে; শানু আপা বলে যায়- ফাইলে সকল পেপারস গুছিয়ে রাখা আছে। তোকে কোনো কিছু ভাবতে হবে না; কোনো কাজ করতে হবে না। শুধু সরেজমিনে উপস্থিত থাকতে হবে। ম্যানেজার করিমউদ্দিন অপেক্ষায় থাকবে এবং আজকের এ প্রোজেক্ট ভিজিটের সঙ্গি হিসেবে সহযোগিতা করবে দৃপ্তি নামের একজন মেয়ে। সে একজন আর্কিটেক্ট।

পাশের ফ্ল্যাটের ভাড়াটিয়ার বড় মেয়ে। শানু আপার সাথে তাদের ফ্যামিলি সম্পর্ক। কি কারণে পরেশের সঙ্গি হিসেবে যাচ্ছে এ নিয়ে তার মাথা ব্যাথা নেই। শুধু একবার বড় আপার মুখোপানে কিছুক্ষণ অবাক চোখে চেয়ে থেকে বের হয়ে যায়।

তিনশোফিটের রাস্তা ধরে গাড়ি ছুটে চলছে। 
দৃপ্তি আলো ছড়ায়; পরেশের হাত ধরবার, কাধে মাথা রাখার চেষ্টা করে কিন্তু পরেশের কাছ থেকে আশানুরূপ সাড়া না পেয়ে ড্রাইভার বশিরকে উদ্দেশ্য করে বলে ওঠে- ড্রাইভার গান ছেড়ে দাও।
- ম্যাডাম কোন্ গানটা ছাড়বো? 
- তোমার কোন কাণ্ড-জ্ঞান নেই দেখছি। তোমাকে মেমোরি কার্ড দিলাম যে, ওটাই ছাড়ো।
প্যারোডি বাংলা গান বেজে ওঠে। মিউজিকের তালে দৃপ্তি সিটে বসে নেচে ওঠে। সে নাচের দোল এসে পরেশের শরীরে লাগে। সে ফিরে তাকায়। অহেতুক উন্মাদনায় ভেসে যাওয়া মেয়েটিকে কিছুক্ষন দেখে একটি লেবেলে দাঁড় করিয়ে বশিরকে উদ্দেশ্য করে বলে ওঠে- বশির ভাই গানটি বদলে দাও। 
হেমন্তের কণ্ঠে বেজে ওঠে- “আমার এই পথ-চাওয়াতেই আনন্দ। খেলে যায় রৌদ্র ছায়া, বর্ষা আসে বসন্ত ॥”
গান বদলে যায়। সে সাথে গাড়ির পরিবেশটিরও বদল হয়। দৃপ্তি মনোক্ষুন্ন হয় কিন্তু তার মুখের হাসি সরে না। পরিবেশ যাই হোক মুখ থেকে হাসি সরানো যাবে না এমন অভিলাস নিয়ে সে এসেছে। 

তাছাড়া রসহীন মানুষটিকে রসের সায়রে স্নান করাতে না পারলে যে, সে হেরে যাবে; হেরে যাবে শানু আপার কাছে। শানু আপা বড় বিশ্বাস করে তাকে পাঠিয়েছে; সে বিশ্বাসের অমর্যাদা হোক সে তা চায় না।

পরেশের দৃষ্টি জানালার বাইরে। অথচ পাশে বসে থাকা পুতুলের মতোন সুন্দর মেয়েটি, যেকিনা গানের ছন্দে নেচে ওঠে, প্রাণ খোলা হাসি দিয়ে পরেশের মুখে হাসি ফোটাতে চায় তার কোনো যত্নই পরেশ  নিলো না, দেখলো না; কিছু বলল না। শুধু কিছুটা সময় তাদের মধ্য থেকে যোজন যোজন দূরত্বে ছুটে চলল। 
সময় যতো দ্রুতই যাক, এ যাত্রায় তাকে হেরে যাওয়া যাবে না। পরেশের মনোরঞ্জন করতে পারলেই হলো, বাজিমাত! এ জীবনে আর কিছু চাই না। 

শানু আপার ইচ্ছে পরেশ যেন বদলে যায়। তার মুখে যেনো হাসি ফুটে ওঠে। আর, আ-র, পরেশের মুখে হাসি ফোটাতে পারলেই দৃপ্তি হবে এ বাড়ির বৌ!
শানু আপার মুখের শব্দ কটি তার কানে বাজতে থাকে। গত তিন বছরে ভাইটি তার মুখের হাসি হারিয়ে ফেলেছে। সে ভাইয়ের মুখে হাসি দেখার জন্য সাড়ে তিনশো মেয়েদের মধ্য থেকে দৃপ্তিকে পছন্দ করেছে। এটাতো কম কথা নয়; অসামান্য অনার করেছে দৃপ্তিকে। সে দৃপ্তি থেমে যেতে পারে না; হেরে যেতে পারে না। কঠিনেরে ভাঙতে সে পরীক্ষা দিচ্ছে। কিন্তু নিরামিষ পরেশকে সে কিভাবে নিজের কন্ট্রোলে নিয়ে আসবে। সে সুযোগ তৈরি করতে ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়ে।  

গান দৃপ্তির প্রিয় একটি বিষয় এটা পরেশকে বোঝাতে পারলেই হলো, ব্যাস কেল্লাফতে। নিজের ভেতর ফন্দি-ফিকির এটে বলে ওঠে- গান হচ্ছে আমার কাছে নেশার মতো। মানুষ নেশা করে অনেক কিছু দিয়ে বাট আমি আমার নেশা ধরায় শুধু মাত্র গান। গান বন্ধ হলে আমার মনে হয় আমি বুঝি মৃত্যুর খুব কাছাকাছি চলে এসেছি। ভয়, আতঙ্কে আমার প্রাণ-পাখিটা বের হয়ে যায়। একদিনতো আমি সেন্সলেস হয়ে পড়েছিলাম। বারো ঘন্টা পর আমি সুস্থ হলে আমার মা মাথায় হাত রেখে কসম দিয়েছিলেন। আমি যেন কোনদিন মন খারাপ না করি; কান্না না করি। ব্যাস সেদিন থেকে আমি কান্না ভুলে গেলাম। তারপর থেকে মা আমাকে কোন কাজে বারণ করেননি। উৎসাহ দেন; যাতে আমি সুস্থ থাকি, আনন্দে থাকি। মাঝে মধ্যে বয়ফ্রেন্ড নিয়ে কোথাও ঘুরতে গেলে মাকে বলে আসি। কোনকোনদিন, মাকে বলার সময় না পেলে ফোনে জানিয়ে দেই। ব্যাস, সারাদিন কেটে যায় মা আমাকে ফোন দিয়ে বিরক্ত করেন না। কারণ তিনি জানেন, তার মেয়ে কোন খারাপ কাজ করতে পারে না। মা আমাকে একটি কথা বারবার বলেন তা হচ্ছে, বয়ফ্রেন্ড বদল করবি বাট স্বামী বদল করবি না। স্বামী হচ্ছে জীবনের জন্য একটি সাইনবোর্ড। তোর বাবাকেই দেখ, তার পরিচয় নিয়েই তো আমরা বেঁচে আছি। আচ্ছা পরেশ, আমি এতোক্ষণ কথা বলছি আপনার একটি কথাও বলতে ইচ্ছে করছে না?

পরেশ নিজের কাজে ব্যস্ত ছিল। দৃপ্তির কথা তার কান পর্যন্ত পৌছালো কিনা সে বলতে পারবে না। ল্যাপটপে অফিসের সিসি ক্যামেরা দেখছিল। এ দায়িত্বটাও শানু আপা তার উপর ছেড়ে দিয়েছে। যেখানে যে ভাবেই থাকুক না কেন প্রতিদিন তিনবার করে শানু ড্যান্স ক্লাব, শানু মহিলা হোস্টেল, রিসোর্ট, ট্যুরিজমের অফিসগুলোয় যেন চোখ বুলায়। ইদানিং শানু আপা এক এক করে অফিসের দায়ভার পরেশের উপর ছেড়ে দিচ্ছে। আজ এ অফিস কাল ও অফিস। ধিরে ধিরে সবদিক সামলানো পরেশের পক্ষে কঠিন হয়ে পড়েছে। শানু আপাকে কিছু বললে কৌশলে এড়িয়ে যান দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন, আর কত; এখন পরেশ বড় হয়েছে। ব্যবসা দেখা শোনার দায়িত্ব্ও তার।

কর্মঠ দায়িত্ব পরায়ন পরেশ বোনের উপর কোন চাপ পড়ুক সেটা চায় না। চায় না তার কারণে শানু আপা কোথাও লজ্জিত হোক। কেননা, জন্মের পর থেকে শানু আপাই তার সব। শানু আপা ব্যতিত তার জীবন একা। আত্মীয়-স্বজন বলতে ওই শানু আপা। ঝড় বাদলে তাকে বুকে আগলে রেখেছে। এমনকি জীবনে বিয়ে পর্যন্ত করেননি। সে শানু আপার জন্য পরেশ সব করতে পারে।

- আপনি কেমন পুরুষ মানুষ; এমন সুন্দরী একটি নারী আপনাকে সময় দিচ্ছে আর আপনি কিনা তার পাত্তাই দিচ্ছেন না। অবাক করে দিলেন মশাই। 
দৃপ্তির কথা বলার ধরণ শুনে দুজনেই চমকে ওঠে। বশির হার্ড ব্রেক করে পেছন ফিরে তাকায়- স্যার চা খাবেন?
জরুরী ফোন বলে দৃপ্তি কফি নিয়ে আড়ালে চলে যায়। বশির বিনয়ের সাথে কাছে এসে পরেশকে উদ্দেশ্য করে কিছু বলার সাহস প্রার্থনা করে। পরেশ ইশারা করে পাশে বসার জন্য। নিরিবিলি পরিবেশে কিছু বলার সাহস পেয়ে বশির আবেগে আপ্লুত হয়ে বলে ওঠে- স্যার, কিভাবে বলবো, ভেবে পাচ্ছি না। 
- বশির ভাই, আপনি বলুন। 
- না মানে; আমার বলা উচিৎ হবে কিনা, সেটাই ভাবছি। 
- বশির ভাই আপনাকে আমি অন্যভাবে দেখি। আমার অমঙ্গল হোক এটা আপনি কখনোই চাইবেন না। কিছু শুনে থাকলে বা ঘটে থাকলে আমাকে বলুন প্লিজ। 
- স্যার দৃপ্তি নামের এ মেয়েটি পাশের ফ্ল্যাটের কেউ না। সে একজন ভারাটে মেয়ে।
- মানে?
- হ্যা স্যার, ফ্ল্যাট ভাড়া নেয়ার সময় দুই মেয়েকে দেখিয়ে ভাড়া নিয়েছিল কিন্তু তাদের কোন মেয়ে নেই। তারা আদৌ স্বামী-স্ত্রী কিনা সন্দিহান। 
- কিন্তু আমিতো শুনেছি তাদের দুটি মেয়ে।
- শুধু আপনে কেনো সবাই শুনেছে। কিন্তু কোন দুটি মেয়ে?
- মানে? 
-স্যার, মেয়ে দুটি প্রতিনিয়ত বদল হয়।
- বদল হয়! কোথায় যায় তারা? 
- সেসব বলতে পারবো না স্যার। মা-মেয়ের সম্পর্ক তাদের সাইনবোর্ড। তবে, এটুকু বলতে পারি আজ যেমন আপনার সাথে এসেছে; কাল সে অন্যের সাথেও যেতে পারে।
- বশির ভাই যা বলছেন; তার যুক্তিসঙ্গত কারণ বলতে পারবেন। 
- যুক্তিসঙ্গত কারণ হবে কিনা, বলতে পারবো না। তবে, একটি বিষয় অনেকদিন থেকে আমার বুকের ভেতর খুব নাড়া দিয়ে যাচ্ছে, সেটাই বলবো বলবো করে বলা হয়নি। 
- আজ বলো; এক্ষুনি বলো। 
- একদিন রাত এগারটায় শানু ম্যাডামের ফোন পেয়ে; গাড়ি নিয়ে গেটের বাইরে অপেক্ষায় ছিলাম। হঠাৎ একটি মেয়ে প্রাণপণে ছুটে এসে  আমার গাড়ির সামনে পড়ে গেল। আমার হাত-পা ধরে অনুনয় বিনয় করে তার বাসায় পৌছে দিতে বললো। আমি তাকে চিনে ফেললাম কিন্তু সে আমাকে চিনতে পারলো না। সে আপনারও পরিচিত। 
- আমার পরিচিত? 
- হ্যা স্যার। সে এমন ভাবে কাঁদছিল যে, কোন কথা বলতে পারেনি। সেদিনের পর থেকে ধিরে ধিরে আমি অনেক কিছু জানতে সক্ষম হয়েছি। জেনেছি, প্রুভ করেছি; আপনার পাশের ভাড়াটে মহিলাটি শহরের বিভিন্ন মহলে কোমলমতি মেয়েদের দিয়ে স্টেজ শো করে থাকে। এমন কি ইভেন্ট ম্যানেজমেন্টের কথা বলে...! স্যার আর কিছু বলতে পারবো না। 
- মেয়েটি কে?
- বলতে নিষেধ আছে স্যার। 
- তোমাকে আদেশ করছি। বলো, মেয়েটি কে? 
- বাবলি ম্যাডাম। 
- বাবলি!
মুহুর্তে সবকিছু পরিবর্তন হয়ে যায়। পরেশের মুখোমণ্ডলে বাবলির মুখোচ্ছবি ভেসে ওঠে। হাস্যোজ্জ্বল মুখটি কি এক নীরব বেদনায় মলিন হয়ে আছে, পরেশ জানে না। কী কারণে তাদের সম্পর্কের ব্রেকআপ হয়েছে সে আজও আবিস্কার করতে পারেনি, বুঝতেও পারেনি বাবলির আত্মদোহন কি ছিল। তবে, আন্দাজ করে বলতে পারে একটি দাবানল তাকে অনবরত তুষের অনলে দিবানিশী পুড়িয়ে যাচ্ছে। কল্পনার ক্যানভাসে সেসব দিনের স্মৃতিচারণ ঘটতে থাকে। 
বাবলির সাথে পরেশের বিরহ খুব বেশি দিনের না। গুণে-গুণে তিনটি বছর একাকিত্বের যন্ত্রণা বুকের কোণে সযতনে আগলে রেখেছে। আত্মার কষ্টে জ্বলেছে, পুড়েছে কাউকে বুঝতে দেয়নি।

হঠাৎ বশিরের মুখে বাবলি নামটি শুনে মগজে মননে সব বদলে যেতে থাকে। ভেতরের অক্ষত দগদগে ঘা জ্বলে ওঠে! 
পরেশের স্মৃতিতে বাবলির মুখোমণ্ডল পলকে পলকে বদল হতে থাকে। সেসব অতীত দৃশ্যের মোহময় দৃশ্যগুলো আর কেউ না দেখুক নিজের ভেতর ক্রিয়া হতে থাকে। তাহলে কি সেদিন বাবলিই সঠিক ছিল? পরেশ নিজের কাছে প্রশ্নের জাল ফেলে দেয়। সেসব প্রশ্নের কাছে নিজেকে খুব ছোট হতে দেখে সে হাহাকার করে ওঠে। শেষ বিকেলের বাবলি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। 
- পরেশ তোমার সাথে জীবন বদল করে কোন লাভ হলো না আমার।
- মানে?
- তোমাকে আমি বিয়ে করতে পারবো না; আমাকে ক্ষমা করো।
- আমার অপরাধ? 
- তোমার কোন অপরাধ নেই পরেশ। অনেক ভেবে দেখলাম; তোমার জীবনের সাথে আমি বড় বেশি বেমানান। তাই এ সিদ্ধান্ত নিয়েছি; ভালো থেকো। 
- একটি সুযোগ দিয়ে যাও; কি হলে আমি তোমাকে পাবো?
- তোমার শানু আপার সাথে সম্পর্ক ত্যাগ করতে পারবে? 
- একি বলছো বাবলি? 
প্রেম-ভালবাসা বুঝি ছেলে খেলা। ইচ্ছে হলো খেললাম ইচ্ছে হলোনা খেললাম না। এ ছেলে খেলায় পরেশের ভেতরটা হুহু করে কেঁদে ওঠে। মা সমতুল্য বড় বোনকে সে কি করে পর করে দেবে। মা-বাবা হারানো পরেশ জন্মের পর থেকে শানু আপার কোলে পিঠে বড় হয়েছে। যে বোন জীবনের সকল চাওয়া বিসর্জন দিয়ে ছোট ভাইটিকে আগলে রেখেছে। সে বোনকে কি করে ভুলে যাবে! একটা সময়ে বাবলির সাথে শানু আপার যোগাযোগ প্রতিদিনই হতো; কে কি খাবে ফোনালাপে সব ডিসাইড করে নিতো। সে বাবলি তার ভালবাসায় হঠাৎ এমন শর্ত দাঁড় করালো কেন? দুজনের মধ্যে কী এমন ঘটনা ঘটে গেছে যে, আকাশ পাতালের ব্যবধান সৃষ্টি হয়ে আছে!

এতোদিনের রিলেশন চোখের পলকে ব্রেকআপ হয়ে গেলো। সেদিনের আহত পরেশকে বশির পাজাকোলে বাসায় নিয়ে গেছে। বশিরই তো তাদের স্বাক্ষী। সেও অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে ছিল কিন্তু মুখ খুলে কিছু বলতে পারেনি। বাবলির সাথে শেষ কথা হয়েছিল ফোনে। পরেশের কানে সে কথাগুলো বাজতে থাকে- “তোমার বোন শানু ইজ এ ফ্লোটিং ব্রোথেলস ব্রোকার”।

তারপর থেকে অনেক দিন কেটে গেছে। অনেক কিছু ভুলে গেছে। অনেক অনেক পরিবর্তন ঘটেছে জীবনে তার। আজ হঠাৎ বাবলি নাম শুনে বুকটা হাহাকার করে ওঠে পরেশের। বুকটা শূন্য হয়ে যায়; সে শূন্যতায় তার প্রাপ্তি অসামান্য ছিল না তবু তাকে ভুলে যেতে হয়েছে। 
- স্যার আপনার খারাপ লাগছে? প্রেসারটা একবার চেক করাবেন? 
- আমি ঠিক আছি। আচ্ছা বশির ভাই বাবলির সেদিন কী এমন ঘটেছিল যে, কান্না করে বাসা থেকে বের হতে হয়েছে?
- স্যার ছোট চাকরি করি; মনিবের নামে কিছু বলা সেতো অন্যায়।
- নির্ভয়ে বলো বশির ভাই; নয়তো আমার বড় ক্ষতি হয়ে যাবে। 
- স্যার এখন কিছু বলতে পারবো না। শুধু এটুকু জানুন দৃপ্তি মেয়েটি শানু ম্যাডামের ইনফরমার। প্রতিনিয়ত আমাদের তথ্য ম্যাডামের কাছে চলে যাচ্ছে। আপনার চোখে জল এসেছে; ধুয়ে ফেলুন, দৃপ্তি এদিকে আসছে।

শরীর খারাপের কথা বলে প্রোজেক্ট পরিদর্শন বাতিল করে পরেশ ফিরে যায়। দৃপ্তিকে বাসায় নামিয়ে দিয়ে বশিরকে নিয়ে পরেশ বেড়ীবাঁধ চলে যায়। দুজনে এখন আর ড্রাইভার মনিব থাকে না; তারা বন্ধু হয়ে যায়। প্রাণখোলা বলতে পেরে বশিরের ভাল লাগে। সে নির্ভয়ে বলে যায়- সেদিন বাবলি ম্যাডামের কাছ থেকে কিছু জানতে পারিনি, সে বারবার অনুরোধ করছিল আমি যেন আপনাকে কিছু না বলি কিন্তু চোখের সামনে দুটি প্রাণের বলিদান হবে, এটা কি করে মেনে নেই। তাই গোপনে বাবলি ম্যাডামের বৃদ্ধা মায়ের কাছে ছুটে গেলাম। সেখানেও কোন লাভ হলো না। পরবর্তীতে জানলাম, শানু ম্যাডাম ড্যান্স শেখানোর নাম করে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া কোমলমতি মেয়েদের দিয়ে ফাঁদ তৈরি করেন। ড্যান্সের পাশাপাশি জিম করান আর সেই সময় গোপন ক্যামেরায় মেয়েদের ভিডিও ধারণ করেন। পরবর্তীতে সেসব ভিডিও দেখিয়ে ব্ল্যাকমেল করেন। বাধ্য করেন বিভিন্ন হোটেল, বাসায়, ডিজে পার্টিতে নাচতে। শানু ম্যাডামের ছত্রছায়ায় এ শহরে তিনশরও উপরে মেয়ে আছে। যারা শানু ম্যাডামের একটি ফোন পেয়ে চলে আসতে পারে; যেকোন মুহুর্তে অঘটন ঘটাতে পারে। এরা খুবই সাহসী স্যার। 
- বশির ভাই থাক এসব। বাবলির খোঁজ তোমার জানা আছে?   
- আপনার বন্ধু সালাউদ্দিন সাহেবের অফিসে জব করেন। চীপ একাউন্টেন্ট।
জব হচ্ছে মানুষের জীবনের একটি সাইনবোর্ড, ব্যানার; পরিচিতির নামফলক। যা ঝুলিয়ে রেখে নিঃসন্দেহে জীবিকা নির্বাহ করা যায়। সেসব সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে জীবনের কিছু কিছু অংশে মানুষ জয়ী হয়, পরিচিতি লাভ করে; সমাজ-সংসারে সামাজিক জীব হিসেবে বেঁচে থাকা যায় কিন্তু সেসব সাইনবোর্ডের আড়ালে লুকিয়ে থাকা বিভৎস্য, কুৎসিত,  নস্টালজির মোড়কে মোড়ানো কিছু বিপরীত বিকৃত মানুষের কৃষ্টিকর্ম ইতিহাস বদলে দেয়।
এমন কৃষ্টিকর্মের ধ্বংস হোক! এমন সাইনবোর্ডের কোন প্রয়োজন পরেশের কাছে; সে ঘুড়ে দাঁড়ায়।

পরেশ প্রথমে শানু ড্যান্স ক্লাবে তালা ঝুলিয়ে দেয়, সাইনবোর্ডটি খুলে ফেলে। ড্যান্স ক্লাবটি অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করে। ফটকে সাময়িক অসুবিধার জন্য আমরা দুঃখিত একটি ব্যানার ঝুলিয়ে দেয়। রাতারাতি শহরের কয়েকটি শানু বিউটি পার্লারে তালা ঝুলিয়ে দেয়। ছুড়ে ফেলে দেয় সাইনবোর্ড। তিনটি মহিলা হোস্টেলের সিট ছেড়ে দেয়ার জন্য সকলের প্রতি সাধারণ নোটিশ টাঙিয়ে দেয়। এক রাতের এমন পরিবর্তন দেখে-শুনে শানু ম্যাডাম অগ্নিশর্মা। এ নিয়ে পরেশের সাথে এক চোট বাক-যুদ্ধ হয়ে যায়।

বড় বোনের সম্মানের জন্য পরেশ এসব করেছে। তাছাড়া মহল্লায় মানুষ ভালোও বলছে না। তাই বাধ্য হয়ে পরেশ এসব করেছে। সব শুনে শানু আপা শান্ত হলেও ভেতরের ক্ষোভ নীরবে চেপে রাখে।

সুন্দর সকালে পরেশ একা বের হয়। বশিরের কাছ থেকে জেনেছে বন্ধু সালাউদ্দিনের সিএ ফার্মে বাবলি জব করে। তাকে সেখানে যেতে হবে; বাবলির ভুল ভাঙাতে হবে। বাবলি ছাড়া পরেশ একা বড়ই একা। সে বাবলিকে আপন করে পেতে চায়। সে ভাবনার করিডোরে বাবলিকে নিয়ে স্বপ্নের সাম্রাজ্য গড়ে তোলে। প্রতি মুহুর্তে তার অনুভূতির ছোঁয়া পেতে চায়। সে খুব দ্রুত ছুটে চলে।

সালাউদ্দিনের সিএ ফার্মটি চমৎকার। পার্টিশন দিয়ে ইমপ্লোয়িদের জন্য আলাদা আলাদা ডেস্ক করে দিয়েছে। পরেশের উপস্থিতি পেয়ে সকলে অবাক চোখ তাকিয়ে থাকে। পরেশ সোজা বাবলির ডেস্কে এসে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ে। হাত জোড় করে বলে ওঠে- আমি এসেছি; তোমার হয়ে এসেছি...!

বাবলির চোখ জলে ভরে যায়। আবছা চোখের দৃষ্টি পরেশের উপর পড়তে কোকড়া চুলের ভেতর আঙুলের পরশ দিয়ে সে স্থির হয়ে যায়। স্থির হয়ে যায় সিএ ফার্মের সকল ইমপ্লোয়ি। একজোড়া জীবনের পরিণয় দেখে আনন্দে করতালি দিয়ে অভিবাদন জানায় সকলে।

                                                                                                                                                   সহকারী প্রোগ্রামার কৃষি মন্ত্রণালয়, বাংলাদশে সচবিালয়