শুভ জন্মদিন ‘পাগল’ জাদুকর

পুণ্ড্রকথা ডেস্ক
প্রকাশ: ২১ মার্চ ২০২০ ০৭:০১ ।
প্রচ্ছদ
পঠিত হয়েছে ৮১ বার।

আচ্ছা, প্যারাগুয়ের জেলখানায় তাঁকে কি মোবাইল নামের ‘জাদুর বাক্স’টি ব্যবহার করতে দেওয়া হচ্ছে! অথবা মোবাইল ফোন যদি ব্যবহার করতে দেওয়া হয়ে থাকে, সেখানে কি অন্তর্জাল আছে? তা না থাকলে তো মোবাইল ফোনটি আর জাদুর বাক্স থাকে না।

প্যারাগুয়ের একটা জেলখানা নিয়ে এত খবর জানতে চাওয়ার কারণ? সেখানকার চৌকোনা একটা ঘরে যে বন্দী আছেন একজন, যিনি একটা সময় পুরো বিশ্বকে মোহিত করে রেখেছিলেন তাঁর পায়ের জাদুতে। সেই ফুটবল-জাদুকর রোনালদিনহোর আজ জন্মদিন। কিছু পাগলামির কারণে জাদুকর আজ জেলে থাকতে পারেন, তাই বলে কি ভক্তরা কি তাঁর জন্মদিন ভুলে যেতে পারে! ফেসবুক, টুইটার, ইনস্টাগ্রাম—সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের শাখায় শাখায় তাই প্রিয় তারকার জন্মদিনে ভক্তদের অঞ্জলি-গাঁথা।

‘শুভ জন্মদিন কিংবদন্তি রোনালদিনহো। ফুটবল খেলাটিকে এত সুন্দর করে তোলার জন্য ধন্যবাদ’, ‘মায়েস্ত্রোদের মায়েস্ত্রো, রাজাদের রাজা—আপনাকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা’—জন্মদিনে ভক্তদের কাছ থেকে এমন সব শ্রদ্ধাঞ্জলি পাচ্ছেন রোনালদিনহো। প্যারাগুয়ের রাজধানী আসুনসিওনের জেলে যদি অন্তর্জাল সমৃদ্ধ মোবাইল তাঁর হাতে না থাকে তাহলে এগুলো দেখবেন কী করে আর আপ্লুতই-বা হবেন কী করে!

প্যারাগুয়েতে রোনালদিনহো এক ভক্ত আবার তাঁর একটি ছবি টুইট করেছেন—বার্সেলোনার জার্সি গায়ে ব্যালন ডি’অর ট্রফিটা তাঁর হাতে। ঠোঁটের কোণে চিরাচরিত সেই মৃদু হাসি। ছবির ক্যাপশন দিয়েছেন এ রকম, ‘শুভ জন্মদিন কিংবদন্তি। এই হাসি চিরদিন অম্লান থাকবে। সুন্দর ফুটবল উপহার দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ।’

রোনালদিনহোর ফুটবলের সৌন্দর্য কেমন ছিল তা কি আর কারও অজানা! তবু কিছু উদাহরণ দেওয়ার লোভ সামলানো কঠিন। ‘নো লুক’ পাসের আবিষ্কর্তা তিনি। প্রতিপক্ষের খেলোয়াড়কে নাট-মেগে ঘোল খাওয়ানো অথবা তাঁর বাইসাইকেল কিক বা অচিন্তনীয় সব ফ্রি-কিক আর কারিকুরি দেখে মুগ্ধ হয়েছে বিশ্বের কোটি কোটি ফুটবলপ্রেমিক।

বার্সেলোনায় তাঁর শুরুর দিকে লা লিগার একটা ম্যাচে রেফারি কোনো একটা কারণে খেলা থামিয়েছিলেন। একটা বল পড়েছিল মাঠে, এর মধ্যে আরেকটা বল মাঠে চলে আসে। এমন সময়ে বেশির ভাগ খেলোয়াড়ই কি করবেন? বলটি লাথি মেরে মাঠের বাইরে পাঠিয়ে দেবেন। কিন্তু রোনালদিনহো তো আর দশজনের মতো নন। তিনি বলটির দিকে এগিয়ে গেলেন, মুখে সেই চিরপরিচিত হাসি। ডান পায়ের বুট দিয়ে বলটিকে ঘুরিয়ে ওপরে তুললেন, সেটিকে নিলেন বাঁ পায়ে। অ্যাঙ্কেল দিয়ে বলটি ওপরে তুলে ব্যাকহিল করে মাঠের বাইরে পাঠালেন বল।

বলটি ঠিক গিয়ে পড়েছিল বলবয়ের হাতে। বলবয় বলটি হাতে নিয়ে হাসছিলেন, ভাবখানা এমন ছিল যেন মুহূর্তটা তাঁর। ন্যু ক্যাম্পের পুরো গ্যালারি তখন মুখরিত হাততালিতে। রোনালদিনহোর মুখে সেই হাসি। তখন আসলে হাসছিল পুরো বিশ্বের ফুটবলপ্রেমীরাই। মুহূর্তটি যে ফুটবল ভালোবাসা সব মানুষদের জন্যই ছিল অবিস্মরণীয়।

ফুটবল নামের গোলক দিয়ে বিশ্বকে মোহিত করা রোনালদিনহোর গল্পের শুরু ১৯৮০ সালের ২১ মার্চ। এই দিনে পোর্তো আলেগ্রেতে জন্ম তাঁর। সেই সময়ে ব্রাজিল ডুবে ছিল দুর্নীতি আর অপরাধের জালে। তবে রোনালদিনহোদের দিন ভালোই কাটছিল। কিন্তু হঠাৎই সুখী পরিবারটিতে নেমে আসে অন্ধকার। রোনালদিনহোর বাবা জোয়াও একদিন পারিবারিক সুইমিংপুলে হৃদ্‌যন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মারা যান। রোনালদিনহোর সেবিকা মায়ের জন্য সংসার বয়ে বেড়ানোটা কঠিন হয়ে পড়ে।

রোনালদিনহোর বয়স তখন আট বছর। তাঁর বড় ভাই রবার্তোর ১৭। মায়ের কষ্ট লাঘব করতে রবার্তো স্কুল ছেড়ে আয়ের পথে নামেন। আর আয়ের জন্য একটা পথই রবার্তোর জানা ছিল, সেটি ফুটবল খেলা। আক্রমণাত্মক মিডফিল্ডার রবার্তোই ছিলেন রোনালদিনহোর ফুটবল-গুরু। ভাই-ই রোনালদিনহোর কানে পুঁতে দিয়েছিলেন একটি মন্ত্র—ফুটবল শুধু খেলার জন্য খেলো না, ফুটবল একটা বিনোদন। মানুষকে বিনোদিত করতে পারলেই খেলাটা খেলতে এসো!

ভাইয়ের সেই কথা কখনোই ভোলেননি রোনালদিনহো। যত দিন খেলেছেন, ফুটবল বিশ্বকে বিনোদন দিয়ে গেছেন। এই বিনোদন দিতে দিতেই জিতেছেন একটি বিশ্বকাপ, একটি চ্যাম্পিয়নস লিগ আর দুটি লা লিগা শিরোপা। এসি মিলানের হয়ে জিতেছেন সিরি ‘আ’। পিএসজি, বার্সেলোনা, এসি মিলান পর্ব শেষ করে ২০১১ সালে নাম লিখিয়েছিলেন ফ্ল্যামেঙ্গোতে, পরের বছরই চলে যান অ্যাটলেটিকো মিনেইরোতে। তাঁর কারিশমাতেই ২০১৩ সালে ক্লাবটি জিতেছিল কোপা লিবার্তোদোরেস। ব্যক্তিগত অর্জনের ডালিটাও কম পূর্ণ নয় রোনালদিনহোর—জিতেছেন ব্যালন ডি’অর ও ফিফা বর্ষসেরা ট্রফি।

আলোকিত এই রোনালদিনহো এখন প্যারাগুয়ের জেলে, সঙ্গে তাঁর ভাই আর ফুটবল-গুরু রবার্তোও। কারণ, দুই ভাইয়ের কাছে প্যারাগুয়ের জাল পাসপোর্ট পেয়েছে সেখানকার পুলিশ। তাঁদের বিরুদ্ধে নাকি আরও অভিযোগ আনা হবে। কমপক্ষে ছয় মাস জেলে থাকতে হতে পারে। তাতে কী? রোনালদিনহোর মুখের চিরপরিচিত সেই হাসি ম্লান হয়নি। খসে পড়েনি তাঁর ফুটবল জাদুও। আসুনসিওনের জেলে ফুটসাল খেলেছেন সম্প্রতি। ফাইনাল ম্যাচে নিজের দলকে জেতাতে ৫ গোল করার পাশাপাশি সতীর্থদের দিয়ে করিয়েছেন ৬ গোল!

জাল পাসপোর্ট নিয়ে প্যারাগুয়েতে গেছেন, জেলে গেছেন। তবু রোনালদিনহো তো রোনালদিনহো-ই। জাল পাসপোর্ট, জেল, তাঁর একটু পাগলামি—এসব কে পাত্তা দেয়! রোনালদিনহো নামটি শুনলেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে সুন্দর ফুটবল, অসাধারণ পায়ের জাদু আর সদা হাস্যোজ্জ্বল ওই মুখ। প্রিয় তারকা, প্রিয় ‘পাগল’ জাদুকর ওই হাসি যেন কোনো দিন ম্লান না হয়—শুভ জন্মদিন!