করোনা মোকাবেলায় সমন্বয়হীনতাঃ একটি প্রাসঙ্গিক ভাবনা

ড. হাছানাত আলী
প্রকাশ: ০৭ এপ্রিল ২০২০ ১০:৩৬ ।
প্রচ্ছদ
পঠিত হয়েছে ৪৮৩ বার।

গত ১৯ মার্চ থেকে বাসায়। মাঝে দু'বার অসুস্হতা জনিত কারণে একবার ডাক্তার দেখাতে রাজশাহী পপুলারে। আরেকবার প্রেসার চেক করার জন্য কাজলায়। পুরোটা সময় বাসায় নামাজ কালাম পড়া,করোনা নিয়ে টিভিতে দেশ বিদেশের খবর দেখা ফেসবুকের কল্যানে নানামুখী উপদেশ পরামর্শ পড়া, এসব করেই সময় কাটছে। গ্রামেরে দিনআনা দিন খাওয়া মানুষগুলোর নিয়মিত খবর রাখা। বর্তমান ও সাবেক ছাত্রদের সাথে যোগাযোগ করা'র মধ্যদিয়ে এক রকম অলস সময় ই কাটাচ্ছি। মৃত্য ভয় এত প্রকট হতে পারে তা করোনা আমার মত সারা বিশ্ববাসীকে বুঝিয়ে দিয়ে যাচ্ছে। রাতে খুব একটা ঘুম আসতে চায়না। ভয়ে, আতংকে আর অনিশ্চয়তায়। গতকাল রাত ১ টা পর ফেসবুকে দেখলাম আমার নিজ জেলা বগুড়া সহ বেশ কয়েকজায়গায় জনপ্রতিনিধির বাসা বা তাদের নিজস্ব গোডাউন থেকে ত্রানের সামগ্রী উদ্ধার করা হয়েছে। এরা কি মানুষ? জাতির এদূর্দিনে যারা রিলিফের চাল আত্নসাৎ করতে পারে তারা তো পশুর চেয়েও অধম। এর মাঝেই আবার কিছু এলিট গ্রুপ সারকারের প্রনোদনা প্যাকেজের ভাগবাটোয়ারা নিয়ে ব্যস্ত। দেশের প্রাইভেট ক্লিনিক গুলোর চিকিৎসা সেবা এখনও স্বাভাবিক হয়নি। চারিদিকে সমন্বয় হীনতা প্রকট। গ্রামের খেটে খাওয়া মানুষগুলো কেমন আছে, রিকসা চালকের সংসার কি করে চলছে, পথশিশুদের অবস্হাই বা কি? তাদের খবর না নিয়ে একশ্রেনীর এলিটরা গ্রামে না গিয়ে এসি রুমে বসে প্রনোদনা আর বীমার টাকার হিস্যা নিয়ে গলদঘর্ম করছে। আর দেরিতে হলেও সরকার চিকিৎকদের নিরাপত্তা ও তাদের পরিবারের নিরাপত্তার কথা ভেবে একটা সুচিন্তিত সিদ্ধান্ত নেয়ায় সরকারকে সাধুবাদ জানাই। এতে করে চিকিৎকদের আত্নবিশ্বাসটা বাড়লেও বাড়তে পারে। সরকার প্রধান বারবার বললেন পিপিই শুধু মাত্র করোনা চিকিৎসায় জড়িত চিকিৎসক ও স্বাস্হ্য কর্মীরাই ব্যবহার করবেন। বাস্তবে চারিদিকে যা দেখি তাতে লজ্জাি পাই। ত্রানের কোন অভাব আছে তা কিন্তু এখন পর্যন্ত আমার দৃষ্ট্রিতে আসেনি। তবে যেটার অভাব তা হলো প্রকট সমন্বয়হীনতা। পত্রিকায় দেখলাম একই ব্যক্তি একাধিক উৎস থেকে ত্রান পাচ্ছেন। আবার কেউ মোটেই পাচ্ছেন না। অথচ আমাদের সবার ন্যাশনাল আইডি কার্ড আছে। সহজেই বিক্যাশ বা ব্যাংক হিসেবের মাধ্যমে সাহায্যের টাকা সরাসরি তাদের ব্যাংক হিসেবে প্রদান করতে পারি। এতে একদিকে যেমন লুটপাট বন্ধ হবে অন্যদিকে সমন্বয়হীনতা দূরিভুত হবে। করোনা নিয়ে শহুরে মানুষের মধ্যে একটা বিরাট আতংক বিরাজ করলেও গ্রামের চিত্র একেবারেই ভিন্ন। তাদের মধ্যে সেই অর্থে এখনও সচেতনতা বৃদ্ধি পায়নি। সচেতন করতে হবে। ভিন্ন কোন পথ তো খোলা নেই। সামাজিক দুরত্ব অবশ্যই নিশ্চিত করতে হবে। গতকাল লক্ষ করলাম কিছু সংগঠন ও ব্যাক্তি ত্রান বিতরণ করছেন। খুবই ভাল। কিন্তু একটা বিষয় লক্ষ করলাম গ্রহীতার চেয়ে দাতার সংখ্যা অনেক বেশী। এক্ষেত্রে সেনাবাহিনীর পদ্ধতিটা অনুসরণ করা যেতে পারে। ফটোশেসন আইন করে বন্ধ করা উচিত। আর যাদের বিরুদ্ধে ত্রানের চাল আত্নসাতের অভিযোগ উঠেছে এবং প্রমানিত হয়েছে তাদেরকে প্রয়োজনে মোবাইল কোর্ট করে দৃষ্টান্তমুলক শাস্তিসহ পদ থেকে তাৎক্ষনাৎ অপসারণ করে আগামী সকল নির্বাচনে সারাজীবনের জন্য অযোগ্য ঘোষনা করা যেতে পারে। এমন দুর্যোগে সকলকে কোন অপরাজনীতি না করে জাতীয় ঐক্যমত্যের ভিত্তিতে সুশৃঙ্খলভাবে এই দুর্যোগ মোকাবেলা করা উচিত। গোটা বিশ্ব আজ এক চরম ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে। আমরাও তা থেকে বিচ্ছিন্ন নই। সারা বিশ্বে লাফিয়ে লাফিয়ে মৃত্যুর মিছিল লম্বা হচ্ছে। বাংলাদেশেও আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। অনেকেরই অনেক কিছু আছে। নেই শুধু করোনা মোকাবেলা করার উপায়। তাই দেশের এমন ক্রান্তিকালে কোন অপরাজনীতি না করে দল মত ধর্ম জাতি বর্ণ নির্বিশেষে দেশের পাশে দেশের মানুষের পাশে দাড়ানো উচিৎ। সেলফি নয়, নিরবে নিভৃতে অসহায় মানুষকে সাহায্য করা দরকার।
এই মহা সংকটের সময় নিজেকে, সমাজকে সর্বপরি দেশটাকে নিরাপদ রেখে নিজেদের সামর্থ অনুযায়ী WHO ও সরকারের নির্দেশনা অনুযায়ী দেশের অসহায় মানুষের পাশে দাড়াতে হবে। দেশের বড় বড় ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিদের অনুরোধ করবো অতি মুনাফার আশায় খাদ্য দ্রব্যের ক্রাইসিস তৈরী করবেন না। মানুষ বাচঁলে তো ব্যবসাটা বাচঁবে। চিকিৎসক ভাই বোনেররা নিজেদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে দেশের চিকিৎসা ব্যবস্হাকে সচল রাখুতে পারেন। অযথা শুধু নিজের কথা না ভেবে সাধারণ মানুষের কথা ভাবুন। রুগীরা তো আল্লাহ তায়ালার পর আপনাদের প্রতি ভরসা রাখে। সুতরাং তাদের ভরসার অমর্যাদা করবেন না। করোনা সারা বিশ্বের মানুষের মাঝে মৃত্যর ভয় প্রকট ভাবে সৃষ্ট্রি করেছে। পৃথিবীর মহা পরাক্রমশালী রাষ্ট্র প্রধান গন করোনার কাছে অসহায় আত্নসমর্পণ করতে বাধ্য হয়েছেন। তাদের অনেক ক্ষমতা,অনেক সম্পদ।কিন্তু এই অর্থ সম্পদ করোনা মোকাবেলায় আজ কোন কাজেই আসছে না। টাকা আছে, মানুষ হত্যার অত্যাধুনিক মারনাস্ত্র আছে, প্রযুক্তি আছে, কিন্তু নেই শুধু মানুষ বাচাঁনোর কোন মেডিসিন,নেই করোনা করোনা ধবংসের কোন মারনাস্ত্র। বাংলাদেশের অনেক রাজনীতিবীদ,এমপি ব্যবসায়ী ও মন্ত্রীরা কথায় কথায় সামান্য জ্বর সর্দি কাশির চিকিৎসা করাতেও উন্নত বিশ্বের নামি দামি হাসপাতালে যান । তবে দেশে যে তাদের কেউ কেউ চিকিৎসা করান না তা কিন্ত নন। তবে তা খুবই নগণ্য। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে তাদের অনেকেই বিলাসী জীবন যাপনের জন্য দেশের টাকা অবৈধ্য ভাবে বিদেশে পাচার করে উন্নত দেশের বেগম পাড়া, সেকেন্ডহোমে বাড়ি গাড়ি করেছেন, নিজেদের আয়েশী জীবন যাপনের জন্য। কিন্তু আন্তর্জাতিক মানের কোন হাসপাতাল তৈরী করেন নি। কিন্তু আল্লাহ না করুন তাদের একজনও যদি আজ করোনায় আক্রান্ত হন তাহলে কিন্তু সেই টাকা, গাড়ি বাড়ি কোন কাজে আসবে না। বিদেশে যাবার বিমানও পাবেন না। প্রকৃতপক্ষে এই করোনা মহামারির মধ্যদিয়ে আমাদের দেশের চিকিৎসা ব্যবস্হার দৈন্যতা বহুলাংশে প্রকাশিত হয়েছে । আজ যদি দেশে উন্নত মানের একাধিক হাসপাতাল তৈরী হতো, দেশের চিকিৎসা ব্যবস্হা আন্তর্জাতিক মানের হতো চিকিৎসকের ব্যক্তিগত নিরাপত্তা ব্যবস্হা নিশ্চিত করা যেত তাহলে আমরা কিছুটা হলেও চিকিৎসা ব্যবস্হা নিয়ে স্বস্তিতে থাকতে পারতাম। আশা করছি সংশ্লিষ্টরা বিষয়টা গুরুত্ব দিয়ে ভেবে দেখবেন। যাতে ভবিষ্যতে আমার প্রিয় দেশে আন্তর্জাতিক মানের হসপিটাল ও চিকিৎসা সেবা প্রতিষ্ঠা করা যায়। সরকার ও বিরোধীদল কাদা ছোড়াছুড়ি না করে একটেবিলে বসে সুসমন্মিত কর্মপন্হা নির্ধারণ করে জাতিকে সঠিকপথ দেখাতে পারে। জাতিও সেটাই প্রত্যাশা করে।

লেখক: অধ্যাপক, আইবিএ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়