করোনায় অনলাইন শিক্ষাঃ সমস্যা ও সম্ভাবনা

প্রফেসর ড. মোহা. হাছানাত আলী,
প্রকাশ: ১৩ মে ২০২০ ১৪:৪১ ।
প্রচ্ছদ
পঠিত হয়েছে ৪২৪ বার।

করনাভাইরাস পাল্টে দিয়েছে আমাদের দৈনন্দিন জীবনাভ্যাস। আমাদের চারপাশে এক অদ্ভুত অনিশ্চয়তা ভর করে বসেছে। খাদ্যের অনিশ্চয়তা, চাকুরি থাকা না থাকার অনিশ্চয়তা, সন্তানের পড়ালেখার অনিশ্চিয়তা, চিকিৎসার অনিশ্চিয়তা,করোনায় মৃত্যু হলে দাফন কাফনের অনিশ্চয়তা। দেশে দেশে মানুষ চাকুরি হারাচ্ছে। কর্মহীন হয়ে পড়ছে শ্রমিক। কলকারখানায় থেমে গেছে উৎপাদনের চাকা। এদিকে এপ্রিল মাসের রপ্তানি আয় দেশের ইতিহাসে সর্বনিম্ন। সরকারের রাজস্ব আদায় হ্রাস পেলেও  বৃদ্ধি পেয়েছে রাজস্ব ব্যয়। ব্যয় মেটাতে সরকারের ঘাড়ে বাড়ছে ঋনের চাপ। দেশে দেশে খাদ্য সংকটের সম্ভাবনা প্রকট হচ্ছে। এমন এক অনিশ্চিত বিশ্বে শিক্ষা ক্ষেত্রেও দেখা দিয়েছে স্হবিরতা। বিজনেস ইনসাইডারের তথ্যানুযায়ী বিশ্বের প্রায় ১৮৮ টি দেশের শিক্ষার্থীরা করোনাকালে সরাসরি ক্ষতির সস্মুখিন হয়েছে। বাধাগ্রস্হ হয়েছে তাদের শিক্ষাকাল। স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রম বন্ধ। শিক্ষার্থীরা ঘরবন্দী। অবশ্য কিছুকিছু দেশে পরিস্হিতি ভেদে স্কুল কলেজ খুলে দিতে শুরু করেছে। তবে তা খুবই সীমিত আকারে। বাংলাদেশে প্রায় দু'মাসেরও অধিক সময় ধরে দেশের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ। কবে আবার শিক্ষা কার্যক্রমকে স্বাভাবিক করা যাবে সেটাও অনিশ্চিত। তবে শিক্ষা মন্ত্রনালয় মাধ্যমিক পর্যায়ে সংসদ টিভির মাধ্যমে শিক্ষা কার্যক্রম চালু করেছে। মাদ্রাসা ও কারিগরি শিক্ষার্থীদের জন্যও একই ভাবে চালু করা হয়েছে টিভিতে সীমিত আকারে পাঠদান। যদিও ক্লাসের গুণগতমাণ ও তার  কার্যকারিতা নিয়ে  দেশের  ভিতরে বিভিন্ন ধরনের আলোচনা সমালোচনা রয়েছে। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রনালয়ও টিভিতে প্রাথমিকের  ক্লাস চালু করেছে। যদিও প্রান্তিক জনপদে টিভি না থাকারও অভিযোগ রয়েছে। আবার যাদের টিভি আছে তারাও মাঝে মাঝে বিদ্যুৎ বিভ্রাটের কারণে সঠিক ভাবে ক্লাসে যোগদান করতে পারছেনা।  বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয় সমুহ সরকারী অনুমোদন নিয়ে "জুম" এ্যাপস ও অন্যান্য ডিজিটাল ডিভাইস ব্যবহার করে সীমিত আকারে তাদের পাঠ ও পঠন চালু করার চেষ্টা করে যাচ্ছে। যদিও দেশের অধিকাংশ প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার গুনগতমাণ নিয়ে কমবেশী সমালোচনা রয়েছে। তারপরও দেশে উচ্চশিক্ষা বিস্তারে তাদের ভুমিকা অনস্বীকার্য। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় সমুহে এ উদ্দ্যোগ এখনও সেভাবে চোখে পড়েনি। তবে দু' একটি বিশ্ববিদ্যায়লয় যে অনলাইনে শিক্ষা  কার্যক্রম সীমিত আকারে শুরু করেনি তা কিন্তু নয়। তবে সে সংখ্যাটা খুবই সীমিত।  কিছু শিক্ষক  আবার স্ব- উদ্যোগী হয়েও জুম এ্যাপস্ এর মাধ্যমে ক্লাস নিয়ে তার সচিত্র বিবরন ফেসবুকে পোস্ট করে অভিজ্ঞতা শেয়ার করেছেন। যা থেকে জানা যায় যে, ৩৫-৪০% শিক্ষার্থী পুর্বে ঘোষনা দেয়া সত্বেও ক্লাসে অনুপস্হিত থাকছে। কিন্তু কেন? সংশ্লিষ্ট শিক্ষকরাই তার কারণ নির্নয় করে বলছেন ছাত্রদের অস্বচ্ছলতার কারণে এমবি/নেট কিনতে না পারা বা কারো কারো তা আবার কেনার সামর্থ থাকলেও নেট ভয়াবহ রকমের স্লো, আবার আর্থিক অস্বচ্ছলতার কারণে এন্ড্রয়েড ফোন না থাকাটাও অন্যতম কারন। এনিয়ে তো দেশের একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর ও এক শিক্ষার্থীর তর্কযুদ্ধ দেশের এক জাতীয় পত্রিকার মাধ্যমে দেশবাসী অবগত হয়েছে। তা হলে এখন আমাদের করণীয় কি? কতদিনি বা আর শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখা হবে? কিভাবে এক্ষতি পুষিয়ে নেয়া যাবে? তা নিয়ে চলছে চুলচেরা বিশ্লেষন। একদিন না একদিন আমাদেরকে তো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সমুহ খুলে দেবার সিদ্ধান্ত নিতেই হবে।  কারণ বর্তমান দেশের সামগ্রিক পরিস্হিতি বিবেচনায় অনলাইন ক্লাস পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে  পুরোপুরি যে কার্যকরী হবেনা তা ধরেই নেয়া যায়। কারন সরকারী বিশ্ববিদ্যালয় সমুহের অধিকাংশ শিক্ষার্থী হয় মধ্যবিত্ত না হয় নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান। সুতরাং তাদের পক্ষে এমবি/নেট ক্রয় করে  নিয়মিত  ক্লাসে অংশগ্রহন সম্ভবপর নাও হতে পারে। তবে স্বাস্থ্যবিধি পালন করে  আমাদেরকে কিন্ত একদিন না একদিন ক্লাসরুমে ফিরতেই হবে। সরকার ইতোমধ্যেই এসংক্রান্ত বিধিবিধান প্রনয়ণ করেছে। যা এখন নেট দুনিয়ায় ঘরে বেরাচ্ছে আমরা যেটাই করতে যাইনা কেন তার আগে করোনার বহুমাত্রিক রুপ ও তার ভয়াবহ প্রভাব মাথায় রেখেই করতে হবে। নিতে হবে সঠিক সিদ্ধান্ত। এবং তা বাস্তবায়নে ছক কশতে  হবে নিখুঁতভাবে । এখানে কোন প্রকার হটকারী সিদ্ধান্ত কাম্য নয়। তা না হলে শিক্ষাক্ষেত্রে ভয়াবহ স্বাস্হ্য বিপর্যয় দেখা দিতে পারে। প্রতিষ্ঠান খোলার আগে  আমাদেরকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সমুহের ক্লাসরুম ভিত্তিক আসন বিন্যাস, স্বাস্থ্য-সুরক্ষা সরঞ্জামাদীর সহজ প্রাপ্যতা নিশ্চিত করেই তা করতে হবে। এছাড়া শিক্ষার্থীদের মধ্যে সামাজিক দুরুত্ব কতটা নিশ্চিত করা যাবে তা কিন্তু ভাববার বিষয়। তাড়াহুড়ো করার দরকার নেই। এতে হীতে বিপরীত ফলও হতে পারে। এতদিন পর বলা হচ্ছে জীবন ও জীবিকা দু'টোই পাশাপাশি চালাতে হবে। কিন্তু সেটা করতে গিয়ে আমরা তো আজ এক ভয়াবহ রকমের স্বাস্থ্য ঝুকির মধ্যে পড়ে গেছি। বলা হলো স্বাস্থ্যবিধি মেনেই শপিংমল ও দোকান খোলা হবে। কিন্তু খোলার পর দেখা গেলো তা মানার কোন বালাই নেই। যে জাতির কাছে জীবন নয় উৎসবই মুখ্য। সে জাতির কপালে যে দুঃখ আছে তা তো দিনদিন আরো প্রকট হচ্ছে। দেশে সাধারণ ছুটি, গণপরিবহন বন্ধ কিন্তু রাস্তায় মানুষের ঢল। আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে। অপ্রতুল চিকিৎসা সেবা। এখন তো দেশে আর অন্যান্য রোগে অসুস্হ্য রুগিরও চিকিৎসা  পাওয়া দুস্কর হয়ে পড়েছে। যারা ভাবছেন যে ইউরোপ,আমেরিকা, সিংগাপুর মালয়েশিয়া অনলাইনে তাদের শিক্ষা কার্যক্রম চালাতে পারলে আমরা নয় কেন। তাদের কে বলছি আমরা যে তাদের মত অনেক কিছুই পারিনা এমনকি তারাও যে সব পারেনা তা কিন্তু করোনা আমাদেরকে দু'চোখে আংগুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। সুতরাং করোনার মত এক কঠিন বাস্তবতার সামনে দাড়িয়ে আমাদের সামর্থ্যের মধ্যেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে। যারা করোনার কারণে সেশনজট বৃদ্ধি পাবে বলে সরব হবার চেষ্টা করছেন তাদের কে অনুরোধ করবো অনুগ্রহ করে ৮০'র দশকের এরশাদ ভ্যাকেশনের কথা একবার ভেবে দেখুন।  তখন শিক্ষা জীবন শেষ করতে প্রতিষ্ঠান ভেদে ৭/৮ বছর সময় লেগেছিলো। আমরা কিন্তু সেখান থেকে পরিত্রাণ পেয়েছি। আমাদের শ্রদ্ধেয় শিক্ষকরাই তা করতে সহযোগিতা করেছেন। কিন্তু আজ যখন দেখি একজন শিক্ষক সময়মত পরীক্ষার খাতা মূল্যায়ন না করার কারণে ফলাফল প্রকাশে বিলম্ব হচ্ছে, ক্লাস না নেবার কারণে সময়মত সিলেবাস শেষ করতে পারেনননা বলে রুটিন অনুযায়ী পরীক্ষা না নেয়ার কারণে সেশনজট বেড়ে যায় তখন কিন্তু তা জাতিকে হতাশ করে। যে কথা বলছিলাম, এরশাদ ভ্যাকেশনে কিন্তু ঘরে থাকাটা জরুরী ছিলো না। আজ কিন্তু বাচাঁর জন্য ঘরে থাকাটা খুবই জরুরী। করোনা থেকে মুক্ত থাকার জন্য সামাজিক দুরুত্ব বজায় রেখে চলাফেরা করাই কিন্তু একমাত্র উপায়। এখনও করোনা ভ্যাকসিন নাগালের বাইরে। কবে তা পাওয়া যাবে তাও নিশ্চিত নয়। এমন এক জটিল পরিস্হিতির মুখোমুখি দাঁড়িয়ে গোটাবিশ্বের শিক্ষা ব্যবস্হা। বাংলাদেশের  পরিস্হিতি আরও নাজুক। ইচ্ছে থাকলেও ভৌত ও প্রযুক্তিগত অবকাঠামোর অপ্রতুলতার কারণে হয়তঃ পুরোপুরি অনলাইন ক্লাস ও পরীক্ষায় যাওয়া এখনই  সম্ভবপর হবে না। তাছাড়া ছাত্র/ছাত্রীদের আর্থিক অস্বচ্ছলতার বিষয়টাও না পারার অন্যতম কারণ হিসেবে বিবেচনার দাবী রাখে। 

এমন এক জটিল পরিস্হিতিতে আমাদের করণীয় কি সেটা সুচারু ভাবে নির্ধারণ করা খুবই গুরুত্বপূর্ন। যদি করোনাকাল আরো দীর্ঘায়িত হয় তাহলে হয়ত আমাদেরকে বাধ্য হয়েই অনলাইন ক্লাস ও পরীক্ষায় যেতে হবে। তবে সেক্ষেত্রে নিম্মোক্ত দু'টি বিষয় বিবেচনা করে তা করা গেলে দেশের শিক্ষা ব্যবস্হায় তা করোনা কালের আশির্বাদ বলেই বিবেচিত হবে।

এক. 

প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের প্রযুক্তি ও ভৌত অবকাঠামো উন্নয়ন করে সময়োপযোগী করে গড়ে তুলতে হবে। যাতে  করে অনলাইনে ক্লাস ও পরীক্ষাসমুহ গ্রহন করা সংশ্লিষ্ট সবার কাছে সহজসাধ্য হয়।

দুই.

অনলাইনে ক্লাস ও পরীক্ষায় অংশগ্রহনের জন্য শিক্ষার্থীদেরকে বিনা পয়সায় ইন্টারনেট ব্যবহার করার সুযোগ নিশ্চিত করতে হবে।এক্ষেত্রে  বিশ্ববিদ্যালয়সমুহ ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডারদের সাথে এসংক্রান্ত চুক্তি সম্পাদন করতে পারে। যারা একেবারেই অস্বচ্ছল তাদেরকে প্রয়োজনমতে এন্ড্রয়েড মোবাইল সেট সরবরাহ করতে হবে। 

আর যদি মনে হয় যে,  করোনামুক্ত হয়ে আমরা আগামী দু'চার মাসের মধ্যেই ক্লাসরুমে ফিরে যেতে পারবো তাহলে তাড়াহুড়ো না করে অপেক্ষা করাই যুক্তিযুক্ত হবে। এক্ষেত্রে পরবর্তীতে ক্লাসের সংখ্যা বাড়িয়ে বা শীতকালীন ছুটি কমিয়ে করোনাকালের ক্ষতিটা সহজেই পুষিয়ে নেয়া যাবে। আমাদের দেশে শিক্ষিতের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে কিন্তু শিক্ষারগুণগত মান হয়েছে নিম্নমূখী। তাই শটকাট কোন পদ্ধতি অবলম্বন না করে ভেবে চিন্তে সিদ্ধান্ত গ্রহন করাটাই হবে যুক্তিযুক্ত। আবেগ নয়, তথ্য ও যুক্তির উপর ভর করেই আমাদেরকে এযাত্রায় অগ্রসর হতে হবে। অনলাইনে ক্লাস গ্রহনে আমার নিজের একটা অভিজ্ঞতা শেয়ার করতে চাই। যার মধ্যদিয়ে পাঠক সহজেই এসংক্রান্ত একটা সুস্পষ্ট  ধারনা পেতে পারেন। আমি নিজে গত ১০মে '২০২০ তারিখে বিবিএ ৪র্থ ব্যাচের ক্লাস প্রতিনিধির মাধ্যমে গতকাল ১২.০৫.২০২০ দুপুর ২টায় জুম এ্যাপসের মাধ্যমে অনলাইনে ক্লাস নেবার সম্ভাব্যতা যাচাই করার জন্য একটি সেশন আয়োজন করেছিলাম। মোট শিক্ষার্থীর মধ্যে মাত্র ২৯জন অংশগ্রহন করেছিলো। যা মোট শিক্ষার্থীর ৫০% এরও কম। যারা অংশগ্রহন করেছিলো তাদের মধ্যে আবার ১০/১২ জন শুধু মাত্র ভয়েস শেয়ার করতে পারছিলো ভিডিও নয়। কারন ইন্টারনেটের গতি অত্যন্ত স্লো। কেন বাকিরা অংশগ্রহন করে নাই জানতে চাইলে যা জানা গেল তা  মোটাদাগে দাড়ায় তাদের পরিবারের  আর্থিক অস্বচ্ছলতা। টাকা দিয়ে এমবি কিনে  এধরনের ব্যয়বহুল শিক্ষাব্যবস্হায় অংশগ্রহন করা তাদের পক্ষে প্রায় অসম্ভব। এ অভিজ্ঞতা শুধু যে আমার একার তা কিন্তু নয়। যারা অনলাইনে ক্লাস নিয়েছেন তাদের অভিজ্ঞতাও  ঠিক আমার অনুরূপ। সুতরাং দেশের বাস্তব পরিস্হিতি বিবেচনা করেই অনলাইনে ক্লাস বা  প্রতিষ্ঠান খোলার সিদ্ধান্ত নিতে হবে। জাতি কোন তাড়াহুড়ো চায়না। 

লেখক: অধ্যাপক, আইবিএ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।

[email protected]