ঈদের জামা কেনার টাকা অভুক্ত বান্ধবীর পরিবারকে দিলেন ইতি

অরূপ রতন শীল
প্রকাশ: ২০ মে ২০২০ ০৭:৩৭ ।
প্রচ্ছদ
পঠিত হয়েছে ৬৯৮ বার।

বান্ধবী ও তার পরিবারের সদস্যরা মুড়ি এবং সেদ্ধ করা শাকপাতা খেয়ে রোজা রাখছেন- একথা জানার পর ঈদের জামা কেনার জন্য বাবা ও ভাইয়ের কাছ থেকে পাওয়া ৫ হাজার ৩০০ টাকা সেই বান্ধবীকেই দান করলেন মেহেরুন্নেছা ইতি নামে এক কলেজ ছাত্রী। বগুড়া সরকারি আজিজুল হক কলেজের সমাজ বিজ্ঞান বিভাগের শেষ বর্ষের শিক্ষার্থী ইতি দৈনিক সমকালের পাঠক সংগঠন সমকাল সুহৃদ সমাবেশের বগুড়া শাখার সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক। পড়ালেখার পাশাপাশি বাংলাদেশ ন্যাশনাল ক্যাডেট কোরের (বিএনসিসি) মহাস্থান রেজিমেন্টে ল্যান্স কর্পোরাল হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। এছাড়া তিনি ছাত্র রাজনীতির সঙ্গেও জড়িত। বাংলাদেশ ছাত্রলীগের সরকারি আজিজুল হক কলেজের বেগম রোকেয়া হল শাখার সাধারণ সম্পাদক ইতি অবসরে গান ও নাচ করেন। সম্প্রতি তিনি বাংলাদেশ বেতার রাজশাহী কেন্দ্রের শিল্পী হিসেবে তালিকাভুক্ত হয়েছেন।

করোনার কারণে গত ১৯  মার্চ কলেজ ও হল বন্ধ হওয়ার পর তিনি বগুড়ার শাজাহানপুর উপজেলার গোহাইল ইউনিয়নের খাদাশ গ্রামের বাড়ি চলে যান। তখন থেকে তিনি বাড়িতেই অবস্থান করছেন। মাঝে একবার তিনি বগুড়া শহরে এসেছিলেন নিজ কলেজের আশ-পাশে দুঃস্থ শতাধিক পরিবারকে ত্রাণ দিতে। তারা বিএনসিসির সদস্যরা টাকা তুলে সেই ত্রাণ তৎপরতা চালিয়েছিলেন।

করোনাকালে হোস্টেলের বান্ধবী ও তার পরিবারের কষ্টের কথা জানিয়ে বুধবার সকাল ৯টা ৫৫ মিনিটে নিজের ফেসবুক অ্যাকউন্টে লিখেন, ‘হঠাৎ রাত ২টায় (মঙ্গলবার দিবাগত রাত) কল আসে আমার ফোনে। নম্বরটি সেভ করা ছিল না। তাই ধরলাম না। কিন্তু আবারও যখন কল আসল তখন ধরতেই হলো। এক মহিলার কন্ঠ। হালকা কান্নার সুরে কথা বলা শুরু করলেন, ‘মা কেমন আছ তুমি? আমি তোমার (নামটা বলা উচিৎ নয়) হোস্টেলর বান্ধবীর মা বলছিলাম।’ আমি চিনতে পেরে বললাম, ‘হ্যা আন্টি আলহামদুলিল্লাহ ভাল। আপনারা সবাই কেমন আছেন?’ কথাটা শেষ না হতেই তিনি কান্না শুরু করলেন। ওপাশ থেকে আরো দু’একজনের কান্নার শব্দও শুনতে পাচ্ছিলাম। বিষয়টা অন্যরকম লাগলো.. আমি বললাম ‘কি হয়েছে আন্টি বলেন তো.. আমার বান্ধবী কই.. সে ভাল আছে তো?’ তখন তিনি বললেন, ‘ও আমার পাশেই আছে মা.. তুমি তো জানো আমাদের সংসারটা ওর বাবার সিএনজির (অটোরিকশা) উপরই চলে। এক মাস আগে তোমার আঙ্কেল (আমার সহপাঠীর বাবা) অ্যাক্সিডেন্ট করেছেন। পা ও বুকে আঘাত লেগেছে। তাই বাসায় পড়ে আছেন।’ আমি বললাম, ‘কই আমার বান্ধবী তো আমায় একটিবারও জানাল না আন্টি!’ তখন গাইবান্ধায় বসবাসকারি সেই আন্টি তার কষ্টের কথা বলা শুরু করেন, ‘মা তোমার আঙ্কেলের জমানো কিছু টাকা দিয়ে আমরা চলছিলাম.. আর তুমি তো জান আমাদের পরিচিত তেমন কেউ নেই যে তাদেরকে বলবো.. তাছাড়া তোমার আঙ্কেল না খেয়ে মরে গেলেও কারো কাছে চাইবে না। এদিকে আজ দুই দিন হলো মুড়ি ছাড়া বাসায় কোন খাবারও নাই। তাই মুড়ি আর শাক তুলে সেটা সেদ্ধ করে তিন মানুষ দুইদিন হলো খাচ্ছি। তোমার কথা অনেক শুনেছি আমি। আমাদের কষ্টের কথা তোমাকে জানানোর জন্য মেয়েকে বলেছিলাম। কিন্তু সে লজ্জায় বলতে পারছে না। এদিকে ওরা বাবা- মেয়ে এসব খেয়ে রোজা করছে এতে আমার বুক ফেটে যাচ্ছিল.. তাই লজ্জা শরম ফেলে আমি তোমায় বললাম মা। আমাদের তুমি বাঁচাও। তুমিও আমার মেয়ে এক মুঠো খাবারের ব্যবস্থা করে দাও দয়া করে..।’ আর কোন কথা শোনা যায় না শুধু কান্নার শব্দ। ততক্ষণে আমার চোখ বেয়ে পানি পড়া শুরু করেছে। ভাবছিলাম হে আল্লাহ এমন পরিস্থিতিরও মুখোমুখি দাঁড়াতে হবে ভাবিনি কখনও। এই ভাবতে ভাবতে চোখের পানি মুছে চিন্তা করলাম কি করবো আমি? ওদের বাসা তো অনেক দূরে। আর অনেক জায়গায় ত্রাণের টাকা বিতরণ করায় হাতে তেমন টাকাও নাই। ঠিক তখনি মনে হলো আব্বু ও ভাইয়া ঈদের জামা কেনার জন্য টাকা দিয়েছে ওখান থেকেই দেওয়া যাবে। সাথে সাথে আমি বললাম, ‘আন্টি আমার বান্ধবীকে ফোনটা দিন। ওকে বললাম সকাল সাড়ে ৮টায় তোর ফোনে কিছু টাকা পঠাচ্ছি..। আর বাকিটা পওে দেখছি’। তারপর গেলাম ‘বিকাশ’-এর দোকানে আর ৫ হাজার ৩০০ টাকা পাঠিয়ে কল দিলাম সেই বান্ধবীকে। ফোন ধরেই হাজারো দোয়া আর খুশিতে কান্না..আমার এতটাই ভালো লাগছিল যে একটা কৃষক অনেক পরিশ্রম করার পর যেমন বাগানে প্রথম ফল বা ফুলের মুখ দেখে মনে যে আনন্দ হয় ঠিক তেমনি...’
মেহেরুন্নেছা ইতি আরও লিখেছেন, ‘হে আল্লাহ এই মহামারী করোনা পরিস্থিতি থেকে আমাদের রক্ষা কর। ভালো থাকুক প্রতিটি পরিবার। আসুন এই দুর্দিনে আমরা আমাদের বন্ধু-বান্ধবী ও সহপাঠীদের খোঁজ খবর নিই। আদৌ তারা ভালো আছে তো? তারা তো বলতে চাইবে না তাদের কষ্টের কথা! তাই আমাদেরকেই খোঁজ নিতে হবে। অনুরোধ রইলো সবার কাছে, সবাই সহপাঠীদের খোঁজ নিন।’