করোনাকালে মানসিক ও মানবিক বিপর্যয়

হোসনে আরা মণি
প্রকাশ: ২৫ মে ২০২০ ১০:২৫ ।
প্রচ্ছদ
পঠিত হয়েছে ৪৬৫ বার।

এক অদ্ভূত ও অভূতপূর্ব অভিজ্ঞতা অর্জন করে চলেছে গোটা বিশ্ব গত পাঁচ মাস ধরে। এক আপাত অদৃশ্য শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে চলছে গোটা পৃথিবী। শত্রু আশেপাশে আদৌ আছে কি নেই, তা জানা নেই, অথচ মানুষ আতঙ্কে অস্থির হয়ে নিয়ে চলছে নানা শত্রুবিনাশী উদ্যোগ। সেসব উদ্যোগ এমনই অদ্ভূত এবং মানুষের উদ্বেগ ক্ষেত্রবিশেষে এমনই হাস্যকর যে এ শত্রুর যদি হাসবার ক্ষমতা থাকতো কিংবা মানুষের যদি সে হাসি শ্রুতিগোচর হওয়ার যোগ্যতা থাকতো তবে দিকদিগন্তব্যাপী ছড়িয়ে পড়া সে অট্টহাসি মানুষকে লজ্জায় মাটির সাথে মিশিয়ে দিত। সৃষ্টিজগতে নিজেদেরকে ‘সৃষ্টির সেরা’ বলে দাবী যাদের, জ্ঞান-বিজ্ঞানে যাদের অর্জন পৃথিবীপৃষ্ঠ ছাড়িয়ে কক্ষপথ পেরিয়ে মহাবিশ্বের নানা গ্রহ-উপগ্রহে ঠাঁই করতে চলেছে, যারা তাদের জন্মভূমি গ্রহটার সাথে ব্যবহার করেছে এমন যেন দুরন্ত শিশুর নির্দয় হাতে লোফালুফি করতে থাকা এক মামুলি টেনিস বল, তারা যখন সামান্য অকোষীয় সত্তার সাথে এক নিরন্তর যুদ্ধে লিপ্ত হয়ে নিরুপায় দশায় উপনীত হয়, তখন যে ব্যঙ্গ তাদের প্রাপ্য হয় তাতে ঐ অকোষীয় সত্তার অট্টহাসি শোনবার উপযোগী শ্রবনযন্ত্রও তাদের থাকা আবশ্যক ছিল। কিন্তু বিধাতা তার সৃষ্টির সেরা জীবের দেহ অনেক সীমাবদ্ধতা রেখে তৈরি করেছেন বলে বাঁচোয়া। মানুষের কিছু কিছু ইন্দ্রিয় ও তন্ত্র  কিছু ইতর প্রাণীর চেয়েও কম যোগ্যতাসম্পন্ন। খুব সহজ উদাহরণ হিসাবে বলা যায়- শ্রবণ, দর্শন, ঘ্রাণের ক্ষমতায় মানুষ কুকুর-বিড়ালের অধম। এই ‘অধম’ জীব যে কারণে সৃষ্টিজগতের উপর প্রভূত্ব বিস্তার করেছে তা প্রধানতঃ তার বহুমাত্রিক চতুরতা ও কুশলতা গুনে। মানব মস্তিষ্কের যে পরিমান কোষ চাতুর্য প্রক্রিয়ার সাথে জড়িত তা আসলে কয়টা শৃগালের সমান তা গবেষণার দাবী রাখে। অন্যান্য জীবের জীবনের ট্র্যাজেডি এই যে, তাদের কুশলতা থাকলেও তা বহুমাত্রিক নয় এবং চতুরতাও ব্যাপকভিত্তিক নয়। 
সেই মানুষেরা যখন এক শ্রেণীর ভাইরাসের বিরুদ্ধে সংগ্রামে নেমে নিজেদের পরস্পরকে পরস্পরের অচ্ছুৎ বলে প্রাতিষ্ঠানিক ঘোষণা দেয়, তখন অন্যান্য প্রাণী তাদের সম্পর্কে কী ভাবে বা বলে তা জানতে আমার মন চায়। আমার জানতে ইচ্ছে করে কোভিড-১৯ এর মনের কথা- আমাদেরকে এভাবে নাস্তানাবুদ করে তারা কতটা খুশি। আমাদের এমন নাজেহাল চেহারা দেখে প্রকৃতি কি বাঁকা হাসি হাসে? আমাদের দিশেহারা দশায় গাছপালা কি আমোদ অনুভব করে? জানি, আমরা তা কোনদিন জানতে পারব না কারণ আমাদের বড় সীমাবদ্ধতা এই যে, আমরা প্রকৃতির কোন জীবেরই মনের কথা আজ পর্যন্ত জানার যোগ্যতা অর্জন করতে পারিনি। আমরা কি আমাদের নিজেদের পরস্পরের মনের কথাই জানি? বুঝতে পারি? পারলেও কি সেই কথার প্রতি, অন্য হৃদয়ের আবেগ-অনুভূতির প্রতি সম্মান-সহমর্মিতা বোধ করি? যদি পারতাম, যদি করতাম, তবে কি তৈরি হতো এটম/নাপাম/ক্লাস্টার বোমা? ল্যান্ড মাইন? রাসায়নিক/জীবানু অস্ত্র? 
এই যে যুদ্ধ শুরু হয়েছে তার পরিণতি কোথায় আমরা জানি না। কত প্রাণের বিনিময়ে, কত বিপর্যয়ের ভেতর দিয়ে কবে কোনদিন আমাদের মুক্তি লাভ হবে তাও আমরা জানি না। এক প্রকার আনুবীক্ষণিক জীবানুর ভয়ে আমাদের সকল স্বাধীনতা থমকে আছে। পৃথিবীর সকল স্বাধীন ও স্বাধীনতাপ্রিয় জাতি-গোষ্ঠী আজ অনুভব করছে যে, আক্ষরিক অর্থেই মানুষ কতটা অস্বাধীন। বিশেষ করে এ উপলব্ধি তাদেরই হচ্ছে যারা এই অদৃশ্য জীবানু, তার কার্যকলাপ ও ক্ষতিকর ক্ষমতা সম্পর্কে বিভিন্ন মাধ্যমে জানে-শোনে ও বিশ্বাস করে। আবার এই জানাশোনাকে উপলব্ধি ও বিশ্বাসটুকু করার জন্য দরকার হয় কিছু বিজ্ঞানভিত্তিক পড়াশুনা থাকা। নইলে সব জানার পরও মানুষ ‘বাঁচামরা উপরঅলার হাতে’ বলে দিব্যি টেনশন ফ্রি থাকতে পারে ও করতে পারে সেসব বিভীষণতুল্য কাজ যা কোভিডের প্রবেশ ও বিস্তারে সহায়ক হয়ে বিশ্বের জনসংখ্যা কমিয়ে দিতে পারে মানবজাতির ইতিহাসে ভয়াবহতম হারে। আর যেহেতু আমাদের চারপাশে বিজ্ঞানমনষ্ক মানুষের চেয়ে অদৃষ্টবাদী ভাবনাহীন আপাতসুখান্বেষী মানুষের সংখ্যা বেশি, দিকে দিকে তাই দৃষ্ট হচ্ছে কোভিডেরই জয়জয়কার।
তবু মনে আশা রাখি এবং বিশ্বাসও করি যে কোভিডের এ জয় সাময়িক। বিজ্ঞানই হোক কিংবা প্রকৃতি, একদিন ঠিকই পরাস্ত করবে কোভিডকে। যেমন পরাস্ত হয়েছে পূর্বের বহু কুখ্যাত মারনঘাতী জীবানু। কিন্তু যতদিন তা না ঘটে ততদিন মানুষের যে মানসিক বিপর্যয় ঘটতে থাকবে তা যে মানবসভ্যতায় কতটা মানবিক বিপর্যয় বয়ে আনবে তা কে বলতে পারে অগ্রিম?
মানসিক বিপর্যয়ে মানবিক বিপর্যয়ের কিছু দৃষ্টান্ত আমরা দেখে ফেলেছি এরই মধ্যে। স্বামী মারা যাচ্ছে, সাহায্যের জন্য প্রতিবেশীদের দ্বারে দ্বারে মাথা কুটছে স্ত্রী, কিন্তু কেউ সাড়া দেয়নি। কারণ রোগের লক্ষণ শুনে মনে হয় রোগী করোনাক্রান্ত। লোকটি মারা গেল বিনাচিকিৎসায়। লাশ দাফনের প্রশ্ন। এবার প্রতিবেশীরা সরব। তারা কিছুতেই স্থানীয় কবরস্থানে দাফন হতে দেবে না, কোন হুজুর তার জানাজা পড়াবে না, কাফনের তো প্রশ্নই ওঠে না- এ যে করোনারোগীর লাশ! প্রশাসনের তদারকীতে লাশ মাটিতে গাড়া হলো, লাশ থেকে নমুনা তুলে পরীক্ষাগারে পাঠানো এলো, কদিন পর ফলও এলো-নাহ্, করোনা ছিলো না লোকটার। এমন ঘটনা জেলায় জেলায় ঘটে চলছে। কদিন পর কি ঘটবে পাড়ায় পাড়ায়, ঘরে ঘরে?
করোনা সন্দেহে মাকে জঙ্গলে ফেলে যাচ্ছে পুত্র, করোনাক্রান্ত প্রতিবেশীর বাড়ি ঢিল ছুঁড়ছে প্রতিবেশীরাই। যেনো এ রোগ যার হচ্ছে সে বিশেষ কোন পাপে পাপী। আর যার হয়নি তার যে হতে পারে যেকোন সময় সে সম্ভাবনা সে বুঝতে পেরে শঙ্কিত ও নমনীয় হওয়ার বদলে হয়ে উঠছে নির্মম, উদ্ধত, বেপরোয়া। অথচ রোগটি ছোঁয়াচে-সংক্রামক, সহজে বাহিত এবং তা যেকোন সময় সংক্রমিত করতে পারে যে কাউকেই। আবার এমনও দেখা যাচ্ছে, যিনি করোনা পজিটিভ তারই শয্যাসঙ্গী (স্বামী/স্ত্রী) নেগেটিভ। আমার চেনা জানা বিআরটিএর এক কর্মকর্তা জানালেন তিনি যাদের সাথে মোবাইল কোর্ট করতে একত্রে সারাদিন ঘুরেছেন, এক গাড়িতে চড়েছেন, তারাসহ তার স্ত্রী সবাই সুস্থ ও পরীক্ষায় করোনা নেগেটিভ হয়েছেন কিন্তু তিনি আক্রান্ত হয়েছেন ও ভুগেছেন। তার মানে রোগটা যাকে ধরছে ও কুপোকাত করছে তার নিতান্ত দুর্ভাগ্য বলেই তা ঘটছে। বলা হয়, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা যার বেশি সে জীবানু বহন করলেও হতে পারে লক্ষণহীন এবং এরাই নীরব বাহক। সামাজিক সংক্রমনের এই সময়ে করোনার লক্ষণ যাদের শরীরে প্রকাশ পাচ্ছে তাদের চেয়ে এই নীরব বাহকই বেশি ক্ষতিকর, করোনা ছড়ানোর ক্ষেত্রে এদের ভূমিকাই বেশি। অথচ সমাজের চোখে অভিযুক্ত সেই দুর্ভাগা, যার রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমের কারণে সে করোনায় আক্রান্ত।
যেকোন রোগে ভুক্তভোগীই কেবল জানে সে রোগের যাতনা। করোনায় আক্রান্তের দেহে যেসব লক্ষণ প্রকাশ পায় তা সহ্য করা খুবই কষ্টকর। দৈহিক কষ্টের সাথে আছে মৃত্যুভীতি যা মানসিকভাবে শক্তিশালী মানুষকেও কাবু করে ফেলতে পারে। এর উপর যদি যুক্ত হয় পরিবার-পরিজনের দুর্ব্যবহার, পাড়া-প্রতিবেশীর কটূ আচরণ তাহলে সেই মানুষগুলোর মনের অবস্থা কী হয় তা সহজেই অনুমেয়। সবচেয়ে বড় কথা মানুষ হিসাবে আমরা যে নিজেদেরকে সৃষ্টির সেরা বলে দাবী করি তার কী পরিচয় আমরা দেই একজন পীড়িতকে পীড়া দিয়ে? এ যে কত বড় নির্মমতা ও মূর্খতা! 
হ্যা, আমাদের মানসিক বৈকল্য ঘটেছে। করোনাতঙ্ক আমাদেরকে এমন এক অস্থির ও অনিশ্চয়তাবোধের মধ্যে ফেলেছে যার চাপ আমরা উৎরাতে না পেরে তার প্রতিক্রিয়ায় নানা রকম অসংলগ্ন ও যুক্তিহীন আচরণ করছি। আমরা অনেকেই মরে যাওয়ার ভয়ে ভীত হয়ে মুমূর্ষুর প্রতি খড়গহস্ত হয়ে উঠছি, আবার অনেকে মরার ভয়কে থোড়াই কেয়ার করছি কিংবা মরার আগে ‘সাধ-আহ্লাদ’ পূরণের খায়েশে নিজের ও অন্যের মৃত্যুর কারণ হতে দ্বিধা করছি না। কারণে-অকারণে বাইরে ঘোরাঘুরি করা, আড্ডা দেয়া, শপিংয়ে যাওয়া, ঈদ করতে জানবাজি রেখে দেশের বাড়ি ছোটা দলগুলো এই ‘সাধ-আহ্লাদ’ গোত্রের।
নানা মাধ্যমে হামেশাই বিজ্ঞাপন চলছে- সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার আহ্বান সম্বলিত। কিন্তু সামাজিক-শারিরীক কোন দূরত্বই বজায় নেই ব্যাংকে, হাসপাতালে, মার্কেটে, পথে, যানবাহনে- জনসমাগমপূর্ণ কোন স্থানেই। মানুষ চলছে উভ্রান্ত, দায়িত্বজ্ঞানহীনভাবে। এসব বিষয়ে সরকারী নীতি আরো মজার। জনগণ এমন করবে এ যেনো সরকার জানতো। জানতো যে ব্যর্থতার সব দায় একদিন জনগণ কাঁধে তুলে নেবে। তাই বুঝি শুরুতে তার আটুনির ঘোষণা ছিলো বজ্রের মতোই কড়া, যদিও নামটা ছিলো বড় মিষ্টি- সাধারণ ছুটি; কিন্তু সরকারী গেরোগুলো ছিলো বড়ই ফস্কা। সেকারণে জনগণ সাধারণ ছুটি অসাধারণভাবে ভোগ করতে চেয়েছে, করেছেও অনেকে।
জনগণের যথেচ্চাচারের মাশুল জনগণ গুনবে, গুনছেও। কিন্তু উপর মহলের নীতির যথেচ্চাচার গোটা ব্যবস্থাপনাকেই প্রশ্নবিদ্ধ করছে। সমূদয় ব্যাংক ও অধিকাংশ অফিস খুলে রেখে গুটিকতক প্রতিষ্ঠান যেখানে জনসম্পৃত্ততা নিতান্তই কম তা বন্ধ রাখার কী যে মাহাত্ম্য তা ‘অবিচক্ষণ’ জনসাধারণের পক্ষে বোঝা সত্যিই দুষ্কর। আবার দেশের অধিকাংশ উৎপাদনমুখী প্রতিষ্ঠান বন্ধ রেখে তৈরি পোশাক শিল্প খুলে দেয়ার নীতিতে কতটা শিল্পরক্ষা হয় তাও ভাববার বিষয়। আর এভাবে নামকাওয়াস্তে লকডাউন, একজনের করোনা শনাক্ত হলেই সেই পাড়া-মহল্লা, অফিস, এমনকি হাসপাতাল লকডাউন ঘোষণা করোনা প্রতিরোধ ব্যবস্থা হিসাবে কতটা কার্যকর তাও এখন খতিয়ে দেখার সময়।
সবচেয়ে বড় কথা রোগে মরার চেয়ে না খেয়ে মরার সম্ভাবনা যাদেরকে বেশি তাড়া করে তাদেরকে কখনো রোগের ভয় দমাতে পারে না। আমাদের হতদরিদ্র থেকে নিম্নমধ্যবিত্ত শ্রেণী পর্যন্ত জীবিকার অনিশ্চয়তায় দিনযাপন করে। মৃত্যুকে পরোয়া না করে পথ চলতে, যেকোন কাজ করতে তারা আগে থেকেই অভ্যস্ত। তারা এও জানে যে, তার নিজের ও পরিজনের পেটের দায় নিতান্তই তার, অন্য কেউ বা কোন প্রতিষ্ঠান সাময়িক এগিয়ে এলেও দীর্ঘমেয়াদে কেউই দায়িত্ব নেবে না। তারা সে আশা করেও না। এমনকি সরকারী সাহায্যও যে দীর্ঘদিন পাওয়ার জিনিস নয়, সে বোধ তাদের আছে। কাজেই জীবিকার প্রশ্নে এসব মানুষ জীবনকে তুচ্ছ জ্ঞান করতে জানে। আর যারা সাময়িক বেঁচে থাকাকে দীর্ঘ জীবনের চেয়ে মূল্যবান বলে চেনে তাদেরকে ঘরে থাকা ও হাত ধুতে বাধ্য জীবনে অভ্যস্ত করা তো সহজ নয়। জীবনকে তারা যত না সহজ ও শান্তিতে যাপন করে, তার চেয়ে বেশি করতে চায় উদযাপন। তাই পালা-পার্বন এলে তাদের ঢল নামে পথে-মাঠে-ঘাটে, হাট-বাজার-ধর্মালয়ে। করোনার আঘাতে বিশ্বজুড়ে যে মহামন্দা ও সামগ্রিক অর্থনীতিতে যে ধ্বস তা নিম্নমধ্যবিত্তকে দরিদ্র করবে, দরিদ্রকে হতদরিদ্র করবে এবং হতদরিদ্রকে নিশ্চিহ্ন করবে সবরকম মানবিকতার আশ্রয় থেকে। সমাজের সর্বস্তরের মানসিক বিপর্যয় ঘটিয়ে চলবে ছোট-বড় অগণিত মানবিক বিপর্যয়। আমাদের কানের কাছে বাজছে এখন অশনি সংকেত, জানি না কতদিন এটা বাজতে থাকবে।