দুপচাঁচিয়ায় এক কর্মচারি সাসপেন্ড

সাবধান! বগুড়ায় ভূমির নামজারির কাগজ জাল হচ্ছে

পুণ্ড্রকথা রিপোর্ট
প্রকাশ: ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২০ ০৬:১২ ।
প্রচ্ছদ
পঠিত হয়েছে ১৬১৪ বার।

আপনি আপনার বসত-বাড়ি কিংবা ফসলি জমি নামজারি (প্রচলিত ভাষায় খারিজ) করতে চান। কিন্তু আপনি প্রক্রিয়াটি বোঝেন না বা একটু-আধটু জানলেও ভূমি অফিসে যোগাযোগ করার মত সময় আপনার হাতে নেই! তাই অন্য অনেকে যা করে আপনিই তাই করেছেন। ভূমি অফিসে তৎপর কোন দালাল বা ওই আফিসেরই কোন কর্মচারীর হাতে টাকাসহ প্রয়োজনীয় কাগজপত্র দিয়ে অপেক্ষা করছেন। 
ভাবছনে চিন্তা কি? আপনার অনুপস্থিতিতে কাজগুলো করার জন্য পরোপকারী (?) ওই ব্যক্তিকে দ্বিগুণেরও বেশি টাকা দিয়েছেন! এখন সরকারের নির্ধারণ করে দেওয়া ৪৫দিন পরই তো পেয়ে যাবেন ডিসিআর (ডুপ্লিকেট কার্বন রশিদ) ও খতিয়ান! আপনার পরিচিত সেই ব্যক্তি ৪৫ দিন পর কাগজগুলো হয়তো আপনাকে ঠিকই দেবেন; কিন্তু সেগুলো আসল নাকি জাল- সেটি কি কখনো খোঁজ নিয়ে দেখেছেন? না নিলে আজই খোঁজ নিন। কারণ বগুড়ায় ভূমির নামজারির জন্য প্রয়োনীয় সরকারি ডিসিআর ফরম (ডুপ্লিকেট কার্বন রশিদ) জাল করা হচ্ছে। শুধু সরকারি এই কাগজই নয় নামজারি ইস্যুর ক্ষেত্রে দায়িত্বপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সিল এবং স্বাক্ষরও জাল করা হচ্ছে। ভয়াবহ এসব অপকর্মের সঙ্গে সাধারণ কোন মানুষ নয় বরং ভূমি অফিসের কর্মচারীই জড়িত।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, নামজারি করতে আসা ভূমি মালিকদের কাছ থেকে মোটা অংকের টাকা হাতিয়ে নেওয়ার উদ্দেশ্যেই এসব করা হচ্ছে। কোন কোন ক্ষেত্রে সরকারি অর্পিত সম্পত্তি লিজ প্রদানের ক্ষেত্রেও জাল-জালিয়াতির আশ্রয় নেওয়া হচ্ছে। জালিয়াতির শিকার এক ব্যক্তি সম্প্রতি জেলার দুপচাঁচিয়া উপজেলার সহকারি কমিশনার (ভূমি) বরাবর এ সংক্রান্ত একটি লিখিত অভিযোগ দাখিলের পর পরই তা জানাজানি হয়। 
তবে ওই ঘটনায় দুপচাঁচিয়া উপজেলা ভূমি অফিসে কর্মরত ওবাইদুর রহমান নামে এক অফিস সহকারিকে শুধু সাময়িক বরখাস্ত করেই কর্তৃপক্ষ দায় সেরেছেন। অভিযুক্ত ওই ব্যক্তি উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের স্বাক্ষর ও সরকারি ফরম জাল করার মত ফৌজদারি অপরাধ করার পরেও তার বিরুদ্ধে সেই অপরাধে এখনও কোন মামলা দেওয়া হয়নি। সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা ঘটনাটিকে ‘ভয়াবহ জালিয়াতি’ উল্লেখ করে বলেছেন নামজারির ক্ষেত্রে যাতে কোন অনিয়ম-দুর্নীতি না হয় সেজন্য কিছুদিন আগে তা সারাদেশে অনলাইনে সম্পন্ন করার পদক্ষেপ নেওয়া হয়। কিন্তু তার পরেও জালিয়াতি বন্ধ করা যাচ্ছে না, যা সত্যিই উদ্বেগজনক। 
জেলার দুপচাঁচিয়া উপজেলার জিয়ানগর ইউনিয়নের খিদিরপাড়া গ্রামের বাসিন্দা আবু সাঈদ সুজা গত ১২ আগস্ট স্থানীয় সহকারি কমিশনারের (ভূমি) কাছে লিখিত অভিযোগে অভিযুক্ত ওবাইদুর রহমানের বিরুদ্ধে ভূমির নামজারির ৫টি ডিসিআর জালিয়াতির অভিযোগ উত্থাপন করেছেন। তাতে তিনি অভিযোগ করেন, তার এক নাতনীসহ পাঁচ নিকট আত্মীয়ের মালিকানাধীন জমিগুলোর নামজারি করার জন্য তিনি সহকারি কমিশনারের (ভূমি) কার্যালয়ের অফিস সহকারি ওবাইদুর রহমানের কাছে প্রয়োজনীয় কাগজপত্রসহ মোট ১৮ হাজার টাকা জমা দেন। তারপর ওবাইদুর রহমান তাকে নিয়ম মাফিক ৪৫দিন পর যোগাযোগ করতে বলেন। আবু সাঈদ সুজা বলেন, ‘নির্ধারিত ৪৫ দিন পর ওবাইদুর রহমান আমাকে ডেকে নিয়ে পাঁচটি খারিজের (নামজারি) ডিসিআর দেন। পরে তার দেওয়া সেই ডিসিআরগুলো (কেস নং-১৫৪৭, ১৬৯৪, ১৬৯৭, ১৬৯৬ ও ১৬৯৩) নিয়ে আমি জিয়ানগর ইউনিয়ন ভূমি অফিসে গিয়ে তা সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার কাছে দাখিল করি। এরপর সেগুলোর বিপরীতে খতিয়ান চাইলে ইউনিয়ন ভূমি কর্মকর্তা আমাকে জানান ওই পাঁচটি ডিসিআরই ভুয়া। তারপর প্রতিকার চেয়ে আমি সহকারি কমিশনার (ভূমি) বরাবর অভিযোগ জানাই।’ তিনি বলেন, প্রতিটি নামজারির জন্য সরকার নির্ধারিত ফি ১ হাজার ১৫০ টাকা হলেও ওবাইদুর রহমান আমার কাছ থেকে ৩ হাজার ৬০০ টাকা করে নিয়েছেন।’ 
ওই অভিযোগটি অনুসন্ধানকালে দেখা গেছে, প্রতিটি ডিসিআরের বহি ও পৃষ্ঠা নম্বর পৃথক হওয়ার কথা থাকলেও বেশ কয়েকটিতে তা একই দেখা গেছে। এছাড়া প্রতিটি ডিসিআরে ‘সহকারি কমিশনার (ভূমি)’ ও ‘নাজির’ হিসেবে যাদের স্বাক্ষর রয়েছে সেগুলোও জাল।’
দুপচাঁচিয়া উপজেলা সহকার কমিশনার (ভূমি) আবু সালেহ্ মোহাম্মদ হাসনাত জানান, অভিযুক্ত অফিস সহকারি ওবাইদুর রহমানের বিরুদ্ধে ৫টি নয় মোট ১২টি ডিসিআর জাল করার অভিযোগ পাওয়া গেছে। তাছাড়া তিনি অর্পিত সম্পত্তির বরাদ্দ বাবদ প্রায় ৩ লাখ টাকাও সরকারি কোষাগারে জমা না দিয়ে নিজের কাছে রেখেছিলেন। এসব অপরাধে তাকে গত ৯ আগস্ট সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। এছাড়া তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা দায়েরে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য অনুরোধ জানিয়ে গত ১৯ আগস্ট জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে। তবে এ বিষয়ে বক্তব্য জানতে অভিযুক্ত ওবাইদুরের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য সোমবার বিকেলে তার মোবাইল ফোন কল দিয়েও কোন সাড়া পাওয়া যায়নি। 
জালিয়াতির ঘটনায় জড়িত ওবাইদুর রহমানের বিরুদ্ধে কোন ফৌজদারি মামলা করা হবে কি’না এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক আব্দুল মালেক বলেন, ‘ওবাইদুর রহমান ফৌজদারি অপরাধ করেছেন-এটা ঠিক। তবে তার বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা করতে গেলে যিনি বাদি হবেন দায়িত্বপ্রাপ্ত সেই কর্মকর্তাকে সাক্ষ্য দেওয়ার জন্য আদালতে একাধিকবার আসা-যাওয়া করতে হবে। এটা অনেক সময় পারা যায় না। তাই বিভাগীয় মামলার মাধ্যমেই ব্যবস্থা নেওয়া হয়ে থাকে। ওবাইদুর রহমানের বিরুদ্ধেও তাই করা হবে।’
সচেতন নাগরিক কমিটির (সনাক) বগুড়ার সভাপতি মুক্তিযোদ্ধা মাছুদার রহমান হেলাল বলেন, ‘লিখিত অভিযোগের প্রেক্ষিতে আমরা শুধু দুপচাঁচিয়ার ঘটনাটি জানতে পেরেছি। কিন্তু যেহেতু জাল ফরম পাওয়া গেছে সেক্ষেত্রে মনে হয় এই জালিয়াতির সঙ্গে একটি চক্র জড়িত এবং তারা অন্যান্য ভূমি অফিসেও সক্রিয় রয়েছে। তাই রাজস্ব বিভাগকে বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে দেখা উচিত এবং সেজন্য অভিযুক্ত কর্মচারীর বিরুদ্ধে মামলা করে তাকে রিমান্ডে নেওয়া দরকার। আর সিন্ডিকেটের পরিচয়গুলোও জনগণের জানা দরকার।