আর্জেন্টিনা বনাম আইসল্যান্ড: বাঘ আইলো!

জুবায়ের হাসান :
প্রকাশ: ১৬ জুন ২০১৮ ০৮:২৮ ।
প্রচ্ছদ
পঠিত হয়েছে ৬৪৬ বার।

আমাদের দেশের শহরগুলো বর্তমানে ভৌগলিক রূপ ধারণ করার আগে বন-জঙ্গলে বেষ্টিত ছিল। ওইসব বন-জঙ্গল থেকে প্রায়শই বাঘ বেরিয়ে এসে লোকালয়ে ঢুকে পড়তো শিকারের নেশায়। শহর অঞ্চলের মানুষগুলো তখন ভয় পেয়ে বা ভয় দেখাতে বলতো বাঘ আইলো (আসলো)। ’৮০-এর দশকের ঢাকা লীগে আবাহনীকে বলা হতো আধুনিক ফুটবলের ধারক-বাহক। সেই সময়ের জমজমাট-উত্তেজনাকর লীগ চ্যাম্পিয়নশিপের লড়াইয়ে ফকিরাপুল বা ফরাশগঞ্জের মতো দল আবাহনীকে আচমকা হারিয়ে দিয়ে বা ড্র করে পয়েন্ট ছিনিয়ে নিতো। একটা ম্যাচ এমন হলে, পরের ম্যাচগুলোতে আবাহনীকে ভয় দেখাতে মোহামেডানের পুরানো ঢাকার সমর্থকরা গ্যালারিতে বসে চিৎকার করে বলতো ফকিরাপুল, ফরাশগঞ্জ আইলো। আজকের আর্জেন্টিনা বনাম আইসল্যা-ের খেলায় ব্রাজিলীয় সমর্থকরা বলতেই পারেন আইসল্যান্ড আইলো!
আইসল্যান্ড অর্থ ‘বরফভূমি’। নরওয়েজিয়ান সাগর দ্বীপের এই ছোট্ট দেশটির আয়তন প্রায় এক লক্ষ তিন হাজার বর্গ কি.মি.। আইসল্যান্ড যেন পার্থিব কোলাহল থেকে মুক্ত থাকার অভিপ্রায়ে অনেক দূরে একা থাকতে চেয়েছে। এই দেশটার আশে-পাশের চারিদিকে কয়েক শত মাইল দূরের কোনো প্রতিবেশি রাষ্ট্র নেই। নির্জন বিচ্ছিন্ন এই দ্বীপ দেশ বাণিজ্যের জন্য রাজধানী রিকজাভিক থেকে ৮৬০ নটিক্যাল মাইল পথ পাড়ি দিয়ে সুদূর গ্লাসগোতে (স্কটল্যান্ড) জাহাজ ভেড়ায়। মাত্র সাড়ে তিন লাখ দ্বীপবাসী মানুষের এ দেশটি এবারই প্রথমবারের মত বিশ্বকাপের টিকিট কেটেছে। ‘পড়ি না মরি’, ‘যাব কি যাব না’, ‘হবে কি হবে না’ এমন করে বিশ্বকাপে আসেনি তারা। ইউরোপ অঞ্চলের বাছাই পর্বে ১০ ম্যাচের ৭টিতে বীরদর্পে জিতে গ্রুপের মগডালে বসেই বিশ্বকাপের টিকিটি ছোঁ মেরে ছিনিয়ে নিয়েছে।

শুভ্র বরফে ঢাকা আইসল্যান্ডের বহিরাবরণ দেখে তাকে শান্ত ভোলা-ভালা মনে হতে পারে। কিন্তু আসলে ঠিক তা নয়। এর আড়ালে লুকানো আছে তেজদীপ্ত লেলিহান শিখা। পৃথিবীর এক ভয়ঙ্কর বিশাল অগ্নেয়গিরি অঞ্চল-এর তলদেশেই ঘুমিয়ে আছে। দ্বীপ কন্যা প্রথমবারের মত বিশ্বকাপ খেলছে। হারানোর কিছু নেই। তাই বরং বরফ তলদেশের হ্যাক্লা দৈত্যটার ঘুম ভাঙ্গালে কেমন হয়! তাহলে আর্জেন্টিনা বধের জংলি উৎসবটা ভাল করেই পালিত হবে। আর্জেন্টিনা বিরোধী ব্রাজিলীয় ভক্তরা বরফ দেশের এমন আগ্নেয় বিস্ফোরণের প্রতীক্ষায় থাকবে। যদি তাই ঘটে যায়, তবে সেটাকে অঘটন বা আপসেট বলা যাবে না। বরং বলতে হবে যোগ্যতার প্রতিফলন ও প্রতিদান।এতক্ষণের কথাগুলোতে মনে হলো, ‘আর্জেন্টিনা বুঝি কোয়েল পাখির রোস্ট হয়ে তৈরি আছে। আইসল্যান্ডের মৎসকুমারীরা আসবে আর কুড়মুড় করে খাবে’। না! বিষয়টা অত সহজ নয়। কারণ-মেসি! মেসি! এবং মেসি! ভিন গ্রহের মেসি। বাম পায়ের জাদুকর মেসি। বাম পায়ের খেলোয়াড়দের ড্রিবলিং বিপক্ষের ডিফেন্ডারকে গোলক ধাঁধায় ফেলে দেয়। দিয়েগো আরমান্দো ম্যারাদোনারও একই সুবিধা ছিল। আমাদের দেশের ’৮০-এর দশকের ঢাকা লীগে ‘চুন্নু’ও এই সুবিধা পেয়েছেন। যাহোক, সাবেক স্প্যানিশ কলোনি আর্জেন্টিনা (আদি পুরুষ স্পেন থেকে আগত, ভাষা স্প্যানিশ, ধর্ম খ্রিস্টান, সংস্কৃতি স্প্যানিশ ভাবধারা) বর্তমান ফিফা র‌্যাংকিংয়ে ৫ নম্বর দল। এরপরেও কেন জানি না তারা প্রত্যেক বিশ্বকাপের আগে খাদের কিনারে পড়ে গিয়ে বাতাস ভারী করা ‘হেল্প!’ ‘হেল্প!’ আর্ত চিৎকারে সমর্থকদের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠ বাড়িয়ে দেয়। ১৯৯০ সালের পর থেকে প্রায় প্রতিটি বিশ্বকাপের বাছাই পর্বেই একটা বিদায় ঘন পরিবেশ তৈরি করে আসছে। আর বিশ্বকাপের ঊষালগ্নে এসে ওয়ার্মআপ ম্যাচই তাদের কাছে হয়ে যায় হাইভোল্টেজ ম্যাচ। মূল পর্বের খেলা খেলতে গেলেই ‘সাধারণ গ্রুপ’-টাই তাদের কাছে হয়ে পড়ে ‘ডেথ গ্রুপ’। সব মিলিয়ে লেজেগোবরে তথৈবচ অবস্থা।

কেন এমন হয়? ওয়ান ম্যান শো-এর ম্যাজিক দেখানো স্টার প্লেয়ার-এর উপর অতিমাত্রায় নির্ভরশীলতাই এর কারণ। তখন থেকেই এটা দেখে আসছি (১৯৯০ সালের পর থেকে) ম্যারাডোনাকে একটু টোকা-খোঁচা দিলেই পুরো আর্জেন্টিনা দলের খেলোয়াড়রা এলোকেশি হয়ে যেত। ম্যারাডোনার পর মেসি যুগে এসেও সেই ধারা অব্যাহত থাকল। তারকা মেসিই দলের ওপর পাহাড়সম চাপ তৈরি করে। আর্জেন্টিনার কোন কোচেরই সাহস হয়নি মেসিকে কৌশলগত বদলি খেলোয়াড় হিসেবে মাঠে নামাবার অথবা ফরোয়ার্ড থেকে সরিয়ে উইংগারে খেলানোর। মেসির জন্ম দিয়েছ বার্সালোনা ক্লাব, আর্জেন্টিনা নয়। তাই মেসি যখন দেশের হয়ে খেলতে যায়, তখন তাঁকে একজন আগন্তুক মেহমানের মত মনে হয়। সেই অপরিচিত অতিথির চায়ের কাপে চিনি না লবণ দিতে হবে সেটা অভ্যর্থনাকারী জানেন না। ফুটবল খেলার চিরন্তন নিয়ম এই যে, সতীর্থরা এলোমেলো-অগোছালো কাঁচা ফুটবল খেললে মেসির মত আকাশের চাঁদও মাটিতে নেমে এসে উই ঢিবি হয়ে যায়। সুতরাং আকাশতারা মেসি ঝলক দেখতে চাইলে তাঁর সতীর্থদের সমানতালে দৌড়াতে হবে। মনে রাখতে হবে মেসি একজন মানুষ। দানব বা অবতার নয়। ভাবতে হবে মেসির পায়ে যাদু আছে, হাতে নেই।আর্জেন্টিনার থিঙ্ক ট্যাঙ্ক আইসল্যান্ডের সম্ভাব্য অগ্নুৎপাতের অনুসন্ধান কতটুকু করেছে জানি না। তবে আইসল্যান্ড খুব ভালভাবেই জানে আর্জেন্টিনার দুর্বলতা, মেসিতে মোহিত হয়ে থাকা। খেলার প্রথম ১৫ মিনিটেই আইসল্যান্ড রোমারোবিহীন আর্জেন্টাইন গোল পোস্ট পরখ করতে চাইবে, অচেনা-অপরীক্ষিত  গোল রক্ষককে নিয়ে আর্জেন্টিনার ডিফেন্ডাররা বিচলিত থাকবে। এজন্যই খেলার শুরুর দিকে আইসল্যান্ডের খেলোয়াড়রা ‘ধর’ ‘ধর’ করে তেড়ে আসবে। এরপর থেকে আইসল্যান্ড যদি রক্ষণাত্মক হয়ে যায় তখন ভদ্র আর্জেন্টিনার সামনে সেটাই বাধা হয়ে দাঁড়াবে। সেই বাধা অতিক্রম করতে হলে আর্জেন্টিনাকে ফ্রি কিক প্লানিংটা ঠিক করতে হবে।
কিন্তু রাশিয়ায় সামুদ্রিক বাতাসের প্রভাব কতটুকু তা আমি জানি না। বাতাস না থাকলে ‘রেইনবো কিক’ কাজ করবে না। আইসল্যান্ডের খেলোয়াড়ররা লম্বা। কর্ণার কিকও কাজে আসবে না। তাই মেসি তুমি তীব্র গতিতে করে যাও ড্রিবলিং, আদায় কর পেনাল্টি। কারণ আমার কচিকাঁচা অবুঝ মেয়ে দু’টো হাতে ‘ঈদ মোবারক’ না লিখে ‘মেসি’ লিখেছে। ওরা পৃথিবী উল্টে গেলেও আর্জেন্টিনা ছাড়বে না[email protected]