রাশিয়া বিশ্বকাপে মাতৃভাষা ও দেশপ্রেম!

জুবায়ের হাসান:
প্রকাশ: ২৬ জুন ২০১৮ ১৩:৪৯ ।
প্রচ্ছদ
পঠিত হয়েছে ৬৮৪ বার।

খেলা শেষ হওয়া মাত্রই ম্যাচ সেরা খেলোয়াড়দের লাইভ সাক্ষাতকার টিভি-তে দেখানো হয়। খেলা শেষের এই ‘পোস্ট ম্যাচ ইন্টারভিউ’ আমি বিশেষ মনোযোগ সহকারে দেখি। বিজয়ী কিংবা পরাজিত খেলোয়াড়রা কিভাবে তাঁদের উচ্ছ্বাস-অনুভূতি প্রকাশ করেন, সেটা জানবার প্রতি আমার প্রবল আগ্রহ। এর কারণ সেখানে শুনতে পাওয়া যায় বিশেষ কিছু মূল্যবান বক্তব্য যা জীবন-সংসার সম্পর্কে ভাবতে শেখায়। এই রাশিয়া বিশ্বকাপে খেলোয়াড়দের ম্যাচ পরবর্তী সাক্ষাতকার বুঝতে গিয়ে পড়েছি বেশ বিড়ম্বনায়। প্রত্যেক দেশের খেলোয়াড়রা কথা বলছেন নিজ নিজ মাতৃভাষায়। স্প্যানিশ, সুইস, ফ্রেঞ্চ, পর্তুগীজ, রাশান, জার্মান, অ্যারাবিক প্রভৃতি ভাষায় অনর্গল বলে যাচ্ছেন তারা। এসব ভাষার আধিক্যে ইংরেজি উধাও হয়েছে। তাঁদের মুখ থেকে ইংরেজি উচ্চারিত না হওয়ায়, আমি তাঁদের বক্তব্য বুঝতে পারছি না। আর তাই গতদিনে তারা কি বলেছিলেন তা জানতে পত্রিকার ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে।
এবারের বিশ্বকাপে অংশ নেওয়া মোট ৩২টি দেশের মধ্যে মাত্র দুটো দেশ ইংরেজিভাষী-অস্ট্রেলিয়া ও ইংল্যান্ড। বাকি ৩০টি দেশের খেলোয়াড়রা মিডিয়ার সামনে প্রয়োগ করছেন নিজ নিজ মাতৃভাষা। এর অর্থ এই নয় যে, তারা ইংরেজি জানেন না। এরা বেশ ভালই ইংরেজি জানেন, কিন্তু বলেন না। বিশ্বকাপের মত বড় রঙ্গমঞ্চে এসে তাঁরা নিজেদের ভাষা-সংস্কৃতি-ঐতিহ্যকে তুলে ধরার সুযোগটাকে পুরোপুরি কাজে লাগান। এসব সুপারস্টাররা নিজস্ব ভাষাতেই বিশ্বের সামনে নিজের দেশকে তুলে ধরেন। তাঁরা বেশ ভালভাবেই জানেন বিশ্বজনতা ‘সুপারস্টার’ সেলিব্রেটিদের অনুসরণ করে। তাঁদেরকে ঘিরেই গল্প গাঁথা তৈরি হয়। তাঁদের কথা হয়ে যায় সংবাদ শিরোনাম। অতএব নিজ ভাষা প্রয়োগের সুযোগটা নেব না কেন? মেসিপুত্র স্ট্যাটাস দিয়েছে-‘ভামোস পাপি’। অর্থাৎ ‘বাবা তুমি এগিয়ে যাও।’ এটাই এখন সংবাদ শিরোনাম। অভিনন্দন তাদের সবাইকে। এরা জানে-

‘নানান দেশের নানান ভাষা
বিনা স্বদেশী ভাষা, মিটে কী সে আশা?

মাতৃভাষা নিয়ে বিশ্বের সকল জাতির মধ্যে সবচেয়ে বেশি গর্ব করতে পারে বাংলাদেশের বাঙালি জাতি। এর কারণ আধুনিক বিশ্বের অন্য সকল ভাষার লিখন শুরু হতে পেরেছিল কালি দিয়ে। আর আমরা লিখলাম রক্ত দিয়ে। আমাদের একুশের ঘটনা বিশ্বের প্রতিটি জনপদের মাতৃভাষাকে যেমন মহিমান্বিত করেছে তেমনি বাংলার বিস্তৃত জনপদের আঞ্চলিক, উপ-আঞ্চলিক ভাষাকেও স্বীকৃতি দিয়েছে। আমাদের দেশে প্রচলিত আঞ্চলিক ভাষার রূপ বাংলাকে বিবর্ণ করেনি বরং বৈচিত্রময় করেছে। যেমন হিন্দিতে ‘হাম’ আর বগুড়ার ‘হামি’। এই উভয় শব্দের অর্থ ‘আমি’। ইংরেজি ভাষায় ‘আমি’ শব্দের পরিভাষা ‘আই’ (I)। বাংলাদেশের নোয়াখালি অঞ্চলে বলা হয়-‘আঁই খেলা দেইখখুম।’ অর্থাৎ ‘আমি খেলা দেখব। সেটা বগুড়াতে বলা হবে-‘হামি খেলা দ্যাখ্্মো’। কত বিচিত্র এই বাংলা ভাষা। এজন্যই কবি অতুল প্রসাদ সেন (১৮৭১-১৯৩৪) গেয়ে উঠেছেন,

‘কি জাদু বাংলা গানে,
গান গেয়ে দাঁড় মাঝি টানে।
গেয়ে গান নাচে বাউল
এমন কোথা আর আছে গো!
গান গেয়ে ধান কাটে চাষা।
-আমরি বাংলা ভাষা।’

আঞ্চলিক বাংলা আমাদের সাহিত্যের সম্পদ। কিন্তু আমরা যেন নিজেকে প্রকাশ করতে চেয়েছি-‘মুই কি হনুরে!’ আঞ্চলিক ভাষা, নিজ মাতৃভাষা, নাড়ির সাথে সম্পর্কিত  ভাষাকে বর্জন করে চলেছি। বিশুদ্ধতার নামে এক কুলীন বাংলা ভাষা চালু করে ফেলতে চাইছি। এসব কুলীন বাংলা ভাষাভাষীরা কখনো কোথাও আঞ্চলিক ভাষার কথন-লিখন দেখলে নাক সিটকায়। তাদের ভ্রু সংকুচিত হয়ে ওঠে। তারা আঞ্চলিকতা ধারণকারীদের হরিজন সম্প্রদায় রূপে গণ্য করে। এই কুলীনরা জানেন না ভাষা কোন বাঁধা মানে না। মনের ভাব প্রকাশের জন্য ভাষার বিস্ফোরণ ঘটবেই। ব্যাকরণ ভাষা সৃষ্টি করে না বরং ভাষাই ব্যাকরণ সৃষ্টি করে। ব্যাকরণ ভাষার প্রবাহকেও স্তব্ধ করতে পারে না। একটু ভেবে দেখুন তো, ‘সেলফি’ শব্দটি কোন্ ডিকশনারির শব্দ? মাত্র ৫/১০ বছর আগেও পৃথিবীর কোথাও এই শব্দের অস্তিত্ব ছিল না। ‘সাবধান! সাবধান! ব্যাকরণ ঠিক কর, শুদ্ধ সাধু ভাষাতে কথা বল’-এই নিষেধাজ্ঞা মানুষ মেনে চলেনি। তাইতো মাত্র কিছুদিন হল সর্বত্র চালু হয়েছে চলিত ভাষায় লিখন। ’৭০ বা ’৮০-এর দশকের মত কেউ আর সাধু ভাষায় বই লিখেন না। সাধুরীতিতে সংবাদপত্রও আর মুদ্রিত হয় না। জাত গেল! জাত গেল! করতে যেয়ে কুলীন ভাষা সংস্কৃত বিলুপ্ত হয়েছে মানুষের মুখ থেকে। আছে শুধু ব্যাকরণ গ্রন্থে।
মাইকেল মধুসূদন দত্ত (১৮২৪-১৮৭৩)-এর মধ্যে এক প্রকার ‘মুই কি হনু রে! ভাব এসেছিল। তবে তিনি সংশোধিত হয়েছিলেন। ফ্রান্সে বসেই তাঁর মধ্যে কৈশোরের স্মৃতি কাতরতা জাগ্রত হয়। তিনি নিজের ভুল বুঝতে পারেন। তিনি বুঝে ফেলেন যে, তিনি প্যারিসের মাইকেল নন বরং সাগরদাঁড়ির কপোতাক্ষ পাড়ের মধুসূদন। সিন নদীর তীরে বসে তিনি লিখলেন-

‘সতত, হে নদ, তুমি পড় মনে!
সতত তোমার কথা ভাবি এ বিরলে।
.. .. .. .. .. .. .. .. .
বহু দেশে দেখিয়াছি বহু নদ-দলে
কিন্তু এ স্নেহের তৃষ্ণা মিটে কার জলে?
দুগ্ধ স্রোতরূপী তুমি জন্মভূমি-স্তনে।
'

কাক হয়ে ময়ূরের পেখম পরে উড়তে চাইলে ধপাস করে পড়ে মরতে হয়। এই কথাটি মাইকেল মধুসূদন দত্ত একটু পরে উপলব্ধি করেছিলেন। তবে কবি অতুল প্রসাদ সেন (১৮৭১-১৯৩৪)-এর সেরূপ ভ্রান্তি বিলাস কখনই হয়নি। তিনি লন্ডনে ব্যারিস্টারি অধ্যয়ন করেছিলেন ঠিকই কিন্তু কখনই বাংলা ও বাঙালিত্বকে ভুলে যাননি। তিনি দেশ প্রেমের চেতনা থেকেই লিখেছিলেন-

প্রবাসী, চল্ রে দেশে চল্
আর কোথায় পাবি এমন হাওয়া,
এমন গাঙের জল।
যখন ছিলি এতটুক্
সেথায় পেলি মায়ের সুধা ঘুম-পাড়ানো বুক,
সেথায় পেলি সাথীর সনে বাল্য-খেলার সুখ,
যৌবনেতে ফুটলো সেথায় হৃদয় শতদল
-প্রবাসী চল্ রে দেশে চল্।
.. .. .. .. ..
মনে পড়ে দেশের মাঠে খেত-ভরা সব ধান,
মনে পড়ে তরুণ চাষীর করুণ বাঁশীর তান,
মনে পড়ে পুকুর পাড়ে বকুল গাছের গান;
মনে পড়ে আকাশ ভরা মেঘ ও পাখির দল
-প্রবাসী চল্ রে দেশে চল।

আমাদের দেশের খেলোয়াড়বৃন্দ যদি ভাবতে থাকেন, কোন ভাষাতে প্রেস কনফারেন্সে কথা বলবো? তাহলে নিঃসন্দেহে হালি হালি গোল খেতে হবে। দেশ, মাটি ও মানুষ এবং নিজস্ব স্বকীয়তা বজায় রাখলে স্টার-রা হয়ে যাবেন সুপারস্টার। তা না করে, এসব উঠতি তারকারা যদি নিজস্ব ভাষা-সংস্কৃতি-ঐতিহ্যের দুয়াটিতে কপাট লাগিয়ে দেন তবে তারা অচিরেই হারিয়ে যাবেন। যারা আমাকে কৈশোরে জুবাডোনা বলে ডাকতেন তাদের অনেকেই ডাবলিন, লন্ডন, স্টকহোম, মস্কো, বোস্টন, ডেটন, মায়ামি, নিউইয়র্ক, শিকাগো, ফিলাডেলফিয়া, লসএ্যাঞ্জেলস্, টরেন্টো, সিডনিসহ পৃথিবীর বিভিন্ন শহরে বাস করছেন। তাদের স্মৃতিকে নাড়িয়ে দেবার জন্য আমার এই বিশ্বকাপ ভাবনাটা তুলে ধরা। তাদেরকে জানাতে চাই বাংলাদেশ আর ভাল ফুটবল খেলে না। [email protected]