জেনে নিন কিছু মুখরোচক খাবারের কথা

সবার জিভে জল এনে দেয় বগুড়ার স্ট্রিটফুড

জাকির আরেফিন শুভ
প্রকাশ: ০৮ জানুয়ারী ২০১৯ ১৪:০৪ ।
প্রচ্ছদ
পঠিত হয়েছে ১৮৯২ বার।

বুয়েটে অধ্যয়নরত রিদম বগুড়ায় এলেই অপেক্ষায় থাকে কখন সন্ধ্যা হবে। সন্ধ্যা মানেই সাতমাথা, আর সাতমাথা মানেই শফিকুলের ভাজাপোড়ার দোকান। শফিকুলের হাতের বারমাখা না খাওয়া পর্যন্ত বগুড়ায় আসা যেন সার্থক হয় না তার। শুধু রিদম নয়, প্রাণের শহর বগুড়ায় এসে ষ্ট্রিটফুড জোনে খাওয়া আর আড্ডা যুবকদের ক্রেজে পরিণত হয়েছে এখন। 

“ষ্ট্রিট ফুড” - নামে রাস্তার খাবার হলেও গোটা বিশ্বে এই খাবারের জনপ্রিয়তা এখন তুঙ্গে। টিভি চ্যানেলের বদৌলতে বিভিন্ন দেশের ষ্ট্রিটফুডের সাথে আমরা কমবেশী সবাই পরিচিত। ছোট্ট শহর বগুড়াও এদিক দিয়ে পিছিয়ে নেই। সাতমাথার দিনের চেহারা যেমনই হোক না কেন বিকেল হতেই দৃশ্যপট পাল্টাতে শুরু করে। বিশেষ করে ডাকঘরের সম্মুখ চত্বর, খোকনপার্কের গেট, জিলা স্কুলের গেট, পার্টি অফিসের সম্মুখ ভাগে খাবারের পসরা সাজিয়ে বসে তৌহিদ, শফিকুল, শিপন, মোহন, সুবীর, শ্যামল, ফখরুদ্দীন, আকাশ, রুবেলসহ আরও অনেকেই। গভীর রাত অবধি চলে খাবার বিক্রির রমরমা ব্যবসা। দোকানীদের হাকডাক, খাবার ভ্যানের আলোকসজ্জা আর সাজিয়ে রাখা রকমারী খাবারের লোভনীয় দৃশ্যকে অগ্রাহ্য করা সত্যিই কঠিন হয়ে দাঁড়ায় ভোজনরসিকদের জন্য। 

বগুড়া সাতমাথায় জনপ্রিয় ষ্ট্রিটফুডের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো চিকেন ফ্রাই, সাসলিক, ফ্রেঞ্চ ফ্রাই, বার্গার, নুডুলস, কাটলেট, রশুন-আলু-ফুলকপি ও ডিমের চপ, চিংড়ির বড়া, বেগুনি, বারমাখা, বুট, মুড়ি মাখা, পিয়াজু, সবজ্বি বড়া, ঝুরি, পাপর, মাশরুমফ্রাই, কলার চপ, হালিম, ভুড়িভাজি, কলিজার লটপটি ইত্যাদি। এসবের পাশাপাশি আকর্ষনের বড় অংশ জুড়ে রয়েছে চটপটি-ফুচকা এবং কাবাব-রুটির দোকান। শীতের শুরুতে এসবের সাথে আরও যোগ হয় ভাপা পিঠার দোকান। ভ্যানের উপর ছোট্ট চুলোয় টগবগ করে ফোটে পানি। ঢাকনার ছিদ্র দিয়ে তীব্রবেগে বেরিয়ে আসে তার গরম ভাব। সেই ভাবের আঁচেই দোকানীর শৈল্পিক হাতে তৈরী হয় বিভিন্ন সাইজের মোহনীয় পিঠা। পিঠার মধ্যে কেউ কেউ মোরব্বা, কিসমিস, চেরী, নারিকেলের টুকরা মিশিয়ে নিজস্ব ফ্লেভার ও স্বাদ দেওয়ার চেষ্টা করে। শীতের দিনে অন্য খাবারের চেয়ে পিঠার বিকিকিনিই বেশী হয়। সাতমাথায় এসময় কমবেশী ৮/১০টি পিঠার ভ্যান থাকেই সন্ধ্যার পর। এদের একটি ভ্যান রুবেলের। রুবেল পুন্ড্রকথা’কে জানায়, সারাবছর অন্য কাজ করলেও শীতের ক’মাস গ্রাম থেকে ছোট ভাইকে নিয়ে এসে পীঠার ব্যবসা করে সে। রুবেল প্রতিদিন চার থেকে পাঁচ কেজি চালের পীঠা বেঁচতে পারলেও কেউ কেউ ছয় থেকে সাত কেজি চালের পীঠাও বিক্রি করে।  আকারভেদে পীঠার দাম ১০, ৪০, ৬০ থেকে ৮০ পর্যন্ত হয়ে থাকে।

ডাকঘরের গেটের সামনে ভ্যানে করে ছেলে বিপুলকে নিয়ে মুড়ি মাখা বিক্রি করে মোহন। চার সন্তানের জনক। এই ব্যবসা দিয়েই সংসার, বাচ্চাদের লেখাপড়া চলে। মোহনের মত শ্যামল, সুবীর, ফখরুদ্দীনও মুড়ি মাখার ব্যবসা করে সাতমাথায়। মাত্র তিন বছরের মধ্যেই মোহনের মুড়িমাখা বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। মোহন জানায়, বেশীরভাগ কাষ্টমারই পাঁচ টাকার মুড়ি মাখা কিনে খায়। ব্যবসা ভালো হলে কখনও কখনও দিনে তিন হাজার টাকা পর্যন্তও বিক্রি হয় তার। কোন এক সময় সাতমাথায় বসা নিষিদ্ধ ছিল তাদের। সেই দিনগুলি পরিবার পরিজন নিয়ে অভাবনীয় দুঃখ কষ্টে কেটেছে বলে সে জানায়। 
মোহনের পাশেই এলএফসি’র ফুডভ্যান। গতানুগতিক খাবারের বাহিরে ভিন্নমাত্রার খাবার তারাই প্রথম নিয়ে আসে সাতমাথায়। তাদের সাসলিক, চিকেন ফ্রাই, বার্গার, কোয়েল ফ্রাই এবং সাথে দেওয়া চাটনীর স্বাদ সত্যিই অপূর্ব। শুরুতেই বলেছি শফিকুলের কথা। ২০/২৫ টি আইটেম রয়েছে শফিকুলের খাবার তালিকায়। বেশী চাহিদা রয়েছে মাশরুম ফ্রাই, বেগুনী, বারমাখা আর বুট মাখার। 

জিলা স্কুলের গেটের সামনে মোহাম্মদ আলী’র লাকি চটপটি ও ফুচকার দোকান। বগুড়ার চটপটি ও ফুচকা ব্যবসার গোড়াপত্তন তার হাতেই বলা যায়। একসময় ঢাকায় রাজমিস্ত্রির কাজ করতো সে। তারপর প্রতিবেশীর বদৌলতে চটপটির ব্যবসা শিখে একবারেই বগুড়ায় চলে আসে। মোহাম্মদ আলীর দেখাদেখি পিয়াজু, আলু চপের ব্যবসা ছেড়ে ইলিয়াছও চটপটি আর ফুচকার ব্যবসায় নামে সেই সময়। তার পর কেটে গেছে প্রায় ত্রিশ বছর। আজও তারা পাশাপাশি ব্যবসা করছে। 

ফুচকা ব্যবসায়ী তৌহিদ জানায়, মধ্যবিত্তরাই তাদের প্রধান কাষ্টমার। বড় ভাই তাহেরকে সহযোগিতা করার জন্য বাবা-মাসহ পরিবারের সকলে মিলে গাইবান্ধা থেকে বগুড়ায় চলে এসেছে তারা। এই চটপটির ব্যবসা করেই তাদের সংসার চলে। ছোট বোনের নামেই দোকানের নাম দেয়া হয়েছে তানিয়া ফুচকা ও চটপটি। 

ইলিয়াস, তৌহিদ বা মোহাম্মদ আলীর মত আরও ১০/১২টি ফুচকা ও চটপটির দোকান বসে ডাকঘর, খোকনপার্ক ও জিলা স্কুলের দেয়াল ঘেষে। চটপটি ও ফুচকার দোকানগুলোতে সাধারণত তিন থেকে ছয় হাজার টাকা পর্যন্তও বিক্রি হয় বলে জানা যায়। ফুচকার দোকানগুলো ঘিরে বসার ব্যবস্থা থাকায় বেশীরভাগ কাষ্টমার এখানে তাদের পরিবার নিয়ে আসতেই বেশী পছন্দ করেন। 

মুখরোচক খাবার গ্রহনের সময়টুকু “বিনোদন” হিসাবে বিবেচনা করলে ষ্ট্রিটফুড সামাজিক বিনোদনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ বলা যায়। বগুড়া পৌরসভার দূরদর্শীতায় বেশ কয়েকবছর আগেই শহরের খোকন পার্ক সংলগ্ন দৃষ্টিনন্দন ফুল মার্কেট গড়ে উঠেছে। জনসাধারণের অভিমত, এতে শহরের শোভাই বেড়েছে বৈ কমেনি। এভাবে সাতমাথা সংলগ্ন কোন জায়গা ষ্ট্রিটফুড বিক্রেতাদের জন্যও নির্দিষ্ট করে দেওয়া যায় কিনা পুন্ড্রকথা’র মাধ্যমে প্রশাসনের নিকট এই আকুতি জানিয়েছেন মুড়িমাখা বিক্রেতা মোহনসহ আরও অনেকেই। তাদের প্রত্যাশা প্রশাসন এ ব্যাপারে আন্তুরিকভাবেই ভেবে দেখবেন।