আর্জেন্টিনা-ব্রাজিলের জয়: আনন্দের ঢেউ লেগেছে বাংলাদেশে!

জুবায়ের হাসান:
প্রকাশ: ২৮ জুন ২০১৮ ১৭:৫৬ ।
প্রচ্ছদ
পঠিত হয়েছে ৪১৬ বার।

আর্জেন্টিনা নাইজেরিয়াকে ২-১ গোলে হারাল এবং একই সময়ে ক্রোয়েশিয়াও আইসল্যান্ডকে ২-১ গোলে হারাল (২৬-০৬-১৮)। এরফলে আর্জেন্টিনা গ্রুপ পর্বের বৈতরণী পার হয়ে দ্বিতীয় পর্বে উত্তীর্ণ হল। বাংলা জনপদের সর্বত্র মুহুর্মুহু হর্ষধ্বনি, হৈ চৈ, কোলাহল, চিৎকার-চেঁচামেচির প্রচ- কলরবে রাত্রির ঘুম ভাঙাল। উল্লাস-উন্মাদনায় ফেটে পড়ল দেশ। ঘামে ভেজা শরীরে ছুটে চলা মজুরের মুখে আর্জেন্টিনা! শ্রমিকের যন্ত্র সঙ্গীতের মাঝে আর্জেন্টিনা। কৃষকের বুক ভরা আনন্দের ধানের শীষে আর্জেন্টিনা! পাল তালা নৌকায় ধেয়ে চলা মাঝির কণ্ঠে আর্জেন্টিনা! ক্যাম্পাসের মিছিলে আর্জেন্টিনা! পথে প্রান্তরের সর্বত্রই দিনভর আর্জেন্টিনাকে নিয়ে আলোচনা। গ্রুপ পর্বে জয়ের আনন্দ যদি এমন হয়, তবে ফাইনাল জিতলে কী হবে?
বংশ পরস্পরায় বাঙালির রক্তে মিশে আছে ফুটবল খেলা। এরা খেলা দেখে প্রচ- আবেগ দিয়ে। ফুটবল এদের হাসায়, আবার ফুটবল এদের কাঁদায়। এরা সহজভাবে বোঝে বেশি গোল করলেই জয়। আর্জেন্টিনা বেশি গোল করেছে এবং জিতেছে। অতএব, তোরা সব জয়ধ্বনি কর! আর্জেন্টাইন সমর্থকরা শেষ মুহূর্তে এসে আনন্দের গীত গেয়েছে। চারিদিকে বিশ্বকাপের উন্মত্ত আবেশ ছড়িয়ে দিয়েছে। এটা হওয়াটাই স্বাভাবিক। জয়টা তাদের জন্যে খুব জরুরী ছিল। কতটুকু ভাল খেললো, আগের ম্যাচগুলোতে কেন খারাপ খেললো, কিভাবে নাইজেরিয়া দুঃখের সাগরে ভেসে গেল, কেনইবা তারা প্রতিবাদহীন থাকল-এসবের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ-তথ্য-উপাত্তকে বাঙালি ফুটবল ভক্তরা খুব সামান্যই আমলে নেয়। তাদের সরল চাহনিতে থাকে স্বাধীনতা, বিজয় ও ভাতের মত সীমিত চাওয়া। এতটুকু পূরণ হলেই তাদের মনতুষ্টি হয়।
বাংলার গণমানুষের এই আবেগ-উচ্ছ্বাস-অনুভূতি, চাওয়া-পাওয়া-কে উপলব্ধি করতে না পারলে প্রকৃত দেশপ্রেমিক নেতা হওয়া যায় না। যখনই কোন নেতা বাংলার গণমানুষের আকাঙ্খার মূল্যায়ন করেছেন, তখনই তিনি তাঁদের কাছে হয়ে উঠেছেন নয়নের মধ্যমণি। তাঁকে আজীবন হৃদয়ের কুঠরে স্থান দিয়েছেন। একবার ভালবাসলে সে ভালবাসা আর ফেরত নেয় না। এখনো ম্যারাডোনা কান্দিলে বাঙালি কান্দে। প্রাণপ্রিয় নেতা কান্দন ভাঙা কণ্ঠে আহবান জানালে বাঙালি সাড়া দেয়। বাঙালি তখন রাত আন্ধার না জোছনার সালোকে আলোকিত তা ভেবে দেখে না। এরা বের হয় ঝাঁকে ঝাঁকে পিলপিল করে। যে নেতা তাদের হৃদয় জয় করেন তাঁকে তারা মনে রাখেন চিরদিন।
ব্রাজিল খেলেছে ভাবলেশহীনভাবে ব্রাজিলের ঢঙে (ব্রাজিল-২: সার্বিয়া-০, ২৭-০৬-১৮)। ১৯৯৪-এর বিশ্বকাপ থেকে তারা খেলে আসছে ল্যাটিন-ইউরো সংমিশ্রিত এক ফুটবল। প্রয়োজন হলে ছন্দ তুলে আক্রমণে যায়। কখনো খেলার গতি বাড়িয়ে দেয়, কখনোবা গতি একেবারে কমিয়ে দেয়। এই কৌশলে ব্রাজিলের খেলায় আশা-নিরাশার দোলাচাল খুব কমই থাকে। নির্ধারিত নব্বই মিনিটের খেলায় ব্রাজিলকে হারানো প্রায় অসম্ভব এক ব্যাপার। একেবারে যেন এলিট  ক্লাবের ছক বাধা খেলা।
অভিজাত পাড়ার শিক্ষিত উচ্চবিত্ত-মধ্যবিত্ত শ্রেণির মধ্যে ব্রাজিলের সমর্থন ও প্রভাব বেশ পরিলক্ষিত হয়। এর কারণ-“৮০’এর দশকের গোড়ার দিকে বাংলাদেশে মিডিয়া ও মিডিয়া যন্ত্রের প্রচলন খুব সামান্যই ছিল। এজন্য সে সময় ও তার পূর্বে ব্রাজিরের খেলা শুনতে, পড়তে ও দেখতে পারত একমাত্র শিক্ষিত উচ্চবিত্ত-মধ্যবিত্ত শ্রেণি। সুতরাং তাদের মধ্যে ব্রাজিলীয় ভাবাবেগ সঞ্চারিত হয়।” কিন্তু ৯০ সাল নাগাদ বাংলাদেশে টেলিভিশনের প্রাচুর্য ছড়িয়ে পড়ল। সকলে দেখতে পেল ক্রন্দনরত এক ম্যারাডোনাকে। ফাইনাল ম্যাচ (পশ্চিম জার্মানি-আর্জেন্টিনা, ১৯৯০) হেরে গিয়ে শিশুর মত অঝোর ধারায় কাঁদছেন ম্যারাডোনা। কারো প্রতি অন্যায়, অবিচার, ষড়যন্ত্র হলে বাঙালি তাঁর পক্ষে অবলম্বন করে। তাঁর জন্যে হৃদয় উজাড় করে দেয়। ’৯০-এ ম্যারাডোনা কেঁদেছেন আর বাঙালি তাতে হৃদয় হারা হয়ে ফুঁসে উঠেছেন। সেই থেকে প্রজন্ম ধারায় বাঙালির মনে বয়ে চলেছে একই রক্ত।
অতএব! ব্রাজিল ভক্ত সমর্থকদের এই আর্জেন্টাইন আবেগ-অনুভূতির প্রতি সতর্ক থাকতে হবে। তাদেরকে সংযত আচরণ দিয়ে গণমানুষের হৃদয় জয় করতে হবে। এলিট ক্লাবের উগ্র সমর্থক হয়ে বিভেদের দেয়াল তোলাতে কি লাভ? ভাগাভাগিতেই আনন্দ বেশি উপভোগ্য হয়ে উঠে। আমাদের সমাজে গড়ে উঠা এমন ব্যবধান মুছে ফেলার দায়িত্ব মিডিয়ার। প্রশ্ন রাখা দরকার আমাদের সবার ঠিকানা কী? আমাদের ঠিকানা খুঁজে পাওয়া যায় এই গানে-

“এই পদ্মা এই মেঘনা, এই যমুনা সুরমা নদী তটে
আমার রাখাল মন গান গেয়ে যায়
এ আমার দেশ এ আমার প্রেম..
কত আনন্দ বেদনা মিলন বিরহ সংকটে।”

[email protected]