বিশ্বকাপ জয়ী আর্জেন্টিনা: চাঁদেরও কলঙ্ক আছে!

জুবায়ের হাসান:
প্রকাশ: ৩০ জুন ২০১৮ ০৬:৪৬ ।
প্রচ্ছদ
পঠিত হয়েছে ৫০৭ বার।

বিজয়ী দলের সমর্থকগোষ্ঠী ও বশংবদ ইতিহাসের কঠিন সত্যের মুখোমুখি হতে চান না। তাঁরা ভেবে বসেন প্রতিকূল তথ্য তাঁদের মহিমাকে কলঙ্কিত করে ফেলবে। অতএব, ইতিহাসকে ধামাচাপা দিয়ে তাঁরা প্রফুল্লচিত্তে দিন যাপন করেন। এসব চেপে রাখা ইতিহাস নতুন প্রজন্মের সামনে উপস্থাপিত হলে সেসবকে নতুন বানোয়াট কথা বলে প্রতীয়মান হয়। এর ফলাফলে সমাজে সৃষ্ট হতে থাকে জানা-অজানার সংঘাত। বিজেতার আঁতে ঘা লাগে। সুড়সুড়ি খেয়ে ঘুমন্ত সিংহের ন্যায় জেগে উঠে হুংকার ছাড়ে, থাবা দিয়ে ধরে ফেলে। জীবন বাঁচানোর তাগিদে তুলতুলে মূষিক অনুনয় করে বলে-“আমি ছোট্ট, আমাকে মেরো না। একদিন আমিও তোমার উপকারে আসতে পারি।”
এসব কথা আনছি আর্জেন্টিনার বিশ্বকাপ জয়কে ঘিরে (১৯৭৮ ও ১৯৮৬)। ১৯৭৮ সালে স্বাগতিক আর্জেন্টিনা ৩-১ গোলে নেদারল্যান্ডকে হারিয়ে প্রথমবারের মত বিশ্বকাপ জিতে নেয়। কিন্তু আর্জেন্টিনা ফাইনালে ওঠার আগে একটি দুর্নামের কালি লেপ্টে যায় তার গায়ে। তখন ছিল ১৬টি দল নিয়ে বিশ্বকাপ। কোন নক আউট পর্ব ছিল না, সেমিফাইনালও ছিল না। গ্রুপপর্বের খেলায় কোন দল বিজয়ী হলে পূর্ণ ২ পয়েন্ট লাভ করত এবং ড্র করলে ১ পয়েন্ট করে ভাগাভাগি হত। (বর্তমানে জিতলে পূর্ণ ৩ পয়েন্ট লাভ করা যায় এবং ড্র করলে ১ পয়েন্ট ভাগাভাগাগি হয়)। যাহোক, ১৯৭৮ সালে ১৬টি দল প্রথমে গ্রুপ-১,২,৩ ও ৪-এই চারটি গ্রুপে (৪X৪=১৬) ভাগ হয়ে যায়। শুরু হয় দ্বিতীয় পর্বে উঠবার পারস্পারিক মুখোমুখি লড়াই। প্রতিটি গ্রুপ থেকে শীর্ষ দুটো করে দল (৪X২=৮) উঠে আসে দ্বিতীয় পর্বে। এই আটটি দল আবার গ্রুপ-এ ও গ্রুপ-বি তে (৪+৪) বিভক্ত হয়ে যায়। এরা পরস্পরের মুখোমুখি হয় ফাইনালে ওঠার লড়াইয়ে। অতঃপর দুটো গ্রুপ থেকে ১টি করে শীর্ষ দল ফাইনালে উঠে। কিন্তু বি গ্রুপ থেকে শীর্ষ দল হিসাবে ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনার মধ্যে থেকে কোন্ দল ফাইনালে যাবে সেটা নির্ভর করে তাদের নিজ নিজ শেষ খেলার উপর। শেষ ম্যাচে ব্রাজিল পোল্যান্ডকে ৩-১ গোলে হারিয়ে দিলে তার পয়েন্ট দাঁড়ায় ৫, গোল পক্ষে ৬ ও বিপক্ষে ১, অর্থাৎ +৫। ব্রাজিলের খেলা শেষ হওয়ার পর একই দিনে (২২-০৬-১৯৭৮) আর্জেন্টিনা পেরুর বিপক্ষে শেষ ম্যাচে মুখোমুখি হয়। তখনকার দিনে এখনকার মত গ্রুপ পর্বের শেষ ম্যাচ একই দিনে একই সময়ে অনুষ্ঠিত হত না।  ব্রাজিলের পরে খেলা হওয়ায় আর্জেন্টিনা হিসাব কষে দেখল পেরুর বিরুদ্ধে জিতলে তার পয়েন্টও ব্রাজিলের সমান ৫ হবে। কিন্তু গোল গড়ে ব্রাজিল এগিয়ে আছে। সুতরাং এখন ব্রাজিলকে পেছনে ফেলতে হলে পেরুকে কমপক্ষে ৪-০ গোলে হারাতে হবে। তবেই বি গ্রুপ থেকে শীর্ষ দল হিসাবে আর্জেন্টিনা ফাইনালে যেতে পারবে।
এমন কঠিন পরিস্থিতির মুখে আর্জেন্টিনা পেরুর বিপক্ষে ৬-০ গোলে জয়লাভ করে ফাইনালে যায়। ব্রাজিলীয় মিডিয়ায় অভিযোগ করা হয় যে, “আর্জেন্টিনার সামরিক সরকার পেরুকে ভয়ভীতি প্রদর্শন করেছে। আর্জেন্টিনায় জন্ম নেওয়া পেরুর গোলরক্ষক অর্থের বিনিমযে গোল হজম করেছে।” পরবর্তীকালে পেরুর সিনেটর ভেনারো লাদেসমা ও গোলরক্ষক রেমন কিরাগোর জবানবন্দিতে এসব অভিযোগের সত্যতা মেলে। আর্জেন্টিনার তৎকালীন স্বৈরশাসক ভিদেলা বিশ্বকাপ জয়ের মাধ্যমে বিশ্বকে দেখাতে চেয়েছিলেন যে, আর্জেন্টিনার পারিস্থিতি স্বাভাবিক আছে।
১৯৭৮ সালে আর্জেন্টিনা যখন প্রথমবারের মত বিশ্বকাপ জেতে তখন ম্যারাডোনার বয়স ১৭ বছর। কম বয়স হওয়ার কারণে তিনি আর্জেন্টিনার বিশ্বকাপ স্কোয়াড থেকে বাদ পড়েন। তবে ১৯৮৬ সালে তিনি অধিনায়ক হিসাবে বিশ্বকাপ জেতেন। কিন্তু ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে ম্যারাডোনা অত্যন্ত  কৌশলে হেড দেওয়ার মত করে লাফ দিয়ে মাথার কাছে হাত নিয়ে সেই হাত দিয়ে গোল করেন। এটিও আর্জেন্টিনার গায়ে লেগে থাকা একটি কলঙ্ক।
চাঁদের কলঙ্ক। সর্বাঙ্গসুন্দর বস্তুর মধ্যে সামান্য কিছু দোষ। চাঁদের গায়ে কাল দাগ থাকায় চাঁদ কলঙ্কিনী হয়ে যায়নি। বরং চাঁদ সৌন্দর্য্যরে উপমায় ব্যবহৃত হয়ে আসছে। এর কারণ পৃথিবীর বুকে রাতের আঁধার কাটাতে চাঁদ কখনো কার্পণ্য করেনি। ম্যারাডোনা স্বীকার করেছেন ঈশ্বরের হাত দিয়ে গোল করার ঘটনা। সেজন্যই ৫/৬ জনকে কাটিয়ে একক প্রচেষ্টায় তাঁর করা অপর একটি গোল শতাব্দীর সেরা গোলের স্বীকৃতি পেয়েছে। ত্রুটি-বিচ্যুতি স্বীকার করাটাই মাহাত্ম্য। মিথ্যা অহমিকার অন্ধতায় শ্রেষ্ঠত্ব অর্জিত হয় না, জনপ্রিয়তায় ধস নামে। ভাল, স্বচ্ছ, সুন্দর-পরিমল খেলা উপহার দিলে আর্জেন্টিনা দলকে সবাই আজীবন ভালবাসবে। [email protected]