তাঁর বিদ্রোহী চেতনা প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম পর্যন্ত অনুপ্রেরণা যোগাবে

আমার হৃদয়ে ম্যারাডোনা

জুবায়ের হাসান
প্রকাশ: ২৭ নভেম্বর ২০২০ ১২:২১ ।
প্রচ্ছদ
পঠিত হয়েছে ১৬৪ বার।

বেদনার কোনা রঙ নেই। তবে এ মুহুর্তে বেদনার রঙ আকাশী নীল। কেননা সাদা-নীল জাসির ফুটবল জাদুকর ম্যারাডোনা আকাশ পানে চির বিদায় নিয়েছেন। গত ৩০ অক্টোবর ২০২০ তারিখে পালিত হয়েছিল তাঁর ৬০তম জন্মদিন। সেই জন্মদিনটা ছিলো নিতান্তই সাদামাটা, সংবাদ শিরোনামে খুব একটা আসেনি। অথচ এর কিছুদিন পরেই ২৫ নভেম্বর ২০২০ তারিখে মরণকে বরণ করে নিয়ে বিশ্ব সংবাদের শিরোনাম হলেন- মুহুর্তেই তাঁর মৃত্যু সংবাদ ‘ব্রেকিং নিউজ’ হলো।
১৯৮২, ১৯৮৬, ১৯৯০ এবং ১৯৯৪ টানা চার বার বিশ্বকাপে খেলা এই আর্জেন্টাইন ফুটবল তারকা ছিলেন সেরাদের সেরা। শতাব্দীর সেরা ফুটবলার তিনি। ছোট-খাটো গড়নের বাঁ পায়ের এই ফুটবল জাদুকর- মাঠে ভেলকি দিখয়েছেন, প্রতিপক্ষকে ধরাশায়ী করেছেন অহরহ। তাঁর ড্রিবলিং ছিলো বিস্ময়কর। ইনসাইড-আউটসাইড ডজ দিতেন চমৎকারভাবে। স্পট কিক অথবা কর্ণার কিকগুলোতে তীব্র বাঁক ছিলো। গোল রক্ষক বুঝতে পারতো না যে সে ফার্স্ট বার না সেকেন্ড বার সামলাবে। বল রিসিভ করে আচমকা শরীর ঘুরিয়ে ফেলতেন। এরপর ক্ষিপ্রগতির ঝড় তুলতেন, আবার গতিপথেই হঠাৎ থেমে যেতেন। এতে করে এই ছোট্ট মানবের কাছে দৈত্যতুল্য দেহগুলো আছাড় খেয়ে পড়ে যেতো। তিনি গোল করতেন ও করাতেন। তার ডিফেন্স চেরা থ্রু পাসগুলো সতীর্থ খেলোয়াড়দের কাছে রসগোল্লায় পরিণত হতো। শুধু একটা টোকা বা একটু ছোঁয়া লাগালেই হলো। আর তাতেই অবধারিত গোল, গ্যালারিতে উল্লাস। তিনি সুযোগ সন্ধানী কোন গোলদাতা ছিলেন না। প্রচলিত স্ট্রাইকারদের মত ডি-বক্সের আশে-পাশে ঘুর ঘুর করতেন না। বরং সারা মাঠ চষে বেড়াতেন। মাঝ মাঠের দখল নিতেন, পায়ের জাদু দেখাতেন, গতির ঝড় তুলতেন। প্রয়োজনে ব্যাক হিল, ব্যাক ভলি করতেন। তাঁর পা ও শরীরের কসরত এতই সুনিপূন ছিল যে- বিপক্ষের খেলোয়াড়রা ভড়কে যেত, ভিমরি খেত। তাই ম্যারাডোনাকে রুখবার জন্য তারা বেছ নিত ভিন্ন পন্থা। টার্গেট করা হতো তাঁর পায়ের গোড়ালি, হাঁটু অথবা উরুকে। পেছন থেকে ট্যাকেল করা হতো, কখনও হাত অথবা জার্সি টেনে ধরা হতো। তিনি প্রতিপক্ষের খেলোয়াড়দের দ্বারা মারাত্মক সব ট্যাকেল ও ফাউলের শিকার হতেন। ইদানিংকালে তো ফুটবলে ব্যাক ট্যাকেল, হার্ড ট্যাকেল কিংবা হাত/জার্সি টেনে ধরা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। হলুদ ও লাল কার্ডের নিয়ম খুব কড়াকড়ি। ড্রিবলিং করা অবস্থায় পেছন থেকে ট্যাকেল করে ফেলে দিলেই লাল কার্ড। ডি-বক্সের মধ্যে সামান্য ধাক্কা দিলেই পেনাল্টি। এছাড়া নিজ দলের গোল রক্ষকের কাছে বল পাস করাও নিষিদ্ধ (অর্থাৎ গোল রক্ষক হাত দিয়ে ধরলে তা পেনাল্টি হবে)। ম্যারাডোনা যখন খেলেছেন- তখন যদি এসব নিয়ম-কানুন থাকতো তাহলে তিনি যে কতবার নিজ দলকে জয়ী করাতে পারতেন আর কত গোল করতেন তা অনুমান করা কঠিন। আর তাঁর শ্রেষ্ঠত্ব তখন কোন উচ্চতায় পৌঁছাতো সেটাও বলা কষ্টসাধ্য।
ম্যারাডোনা তাঁর একক নৈপুন্যে আর্জেন্টিনাকে ১৯৮৬ সালে বিশ্বকাপ এনে দিয়েছিলেন। ১৯৯০ সালে ফাইনাল খেলে রানার আপ আর ১৯৯৪ সালে ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে টুর্নামেন্টের মাঝ পথে বিশ্বকাপ থেকে বহিস্কার। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অনুষ্ঠিত সেই বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনা ২য় পর্ব থেকে বিদায় হয়ে যায়। এই তিনটি টুর্নামেন্টেই তাঁর একক নৈপুন্য ছিলো দেখবার মতো। তাঁর অসামান্য ক্রীড়া শৈলীর কারণে বিশ্বব্যাপী আর্জেন্টিনার এক বিশাল সমর্থক গোষ্ঠী তৈরি হয়। ফুটবল প্রেমীরা হয়ে পড়ে ম্যারাডোনা ভক্ত- আর্জেন্টিনা পাগল। ম্যারাডোনা নামটি একটা উদ্দীপনা, প্রেরণা ও উচ্ছ্বাসে পরিণত হয়। ম্যারাডোনা মানেই এক আনন্দময় উন্মাদনা, একটা ক্রেজ। ভক্তদের মাঝে তিনি আকাশচুম্বী জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। ঢাকা ও কলকাতা ভিত্তিক ফুটবল ভক্তদের নয়নমণি হয়ে ওঠেন তিনি। বাঙালি কাউকে ভালোবাসলে- সব কিছু উজাড় করে ভালোবাসে। বাঙালি জাতি ম্যারাডোনার প্রতিও সেই ভালোবাসার স্বাক্ষর রাখে। বাংলার কৃষক, শ্রমিক, মজদুর, রিকশা শ্রমিক, মোটর শ্রমিক, ছাত্র-জনতা সবার কাছে প্রিয় হয়ে ওঠেন ম্যারাডোনা। বাংলার শহর-গ্রামে তরুণরা ঘুরে বেড়াতে থাকে ম্যারাডোনার ছবি সম্বলিত জার্সি পরিধান করে। উঁচু উঁচু ভবন ও দালান-কোটার ছাদ ছেয়ে যায় আর্জেন্টিনার পাতাকায়। কোন একটি মহল্লা/গ্রামের টেলিভিশন সেটের সামনেই শত শত মানুষ হুমড়ি খেয়ে পড়তো ম্যারাডোনার খো দেখার জন্য। দর্শকদের হৈ চৈ শুনে দূর থেকেই বোঝা যেতো আর্জেন্টিনা গোল খেয়েছে না দিয়েছে। উল্লাস ধ্বনি যদি তীব্র হতো, তবে বোঝা যেতো- আর্জেন্টিনা গোল দিয়েছে। আর যদি ধ্বনির আওয়াজ স্বল্প হতো তবে ধরে নেওয়া যেতো- আর্জেন্টিনা গোল খেয়েছে। ম্যারাডোনার এই জনপ্রিয়তা শুধু দুই বাংলায় নয় বরং তা পুরো উপমহাদেশ জুড়ে বিদ্যমান ছিলো। এমনকি পুরো এশিয়াতেও একই অবস্থা। আরব জাহানের জনগণের কাছেও তিনি ভীষণভাসে সমাদৃত। কালো কালো মানুষের দেশ আফ্রিকা মহাদেশেও তিনি খ্যাতির শীর্ষে। আর নিজ মহাদেশ দক্ষিণ আমেরিকার কথা তো বলাই বাহুল্য। অর্থাৎ এশিয়া, আফ্রিকা ও দক্ষিণ আমেরিকা মহাদেশের ফুটবল প্রেমীদের কাছে তিনি এক মনপাখি।
তবে মার্কিন মুলুকে এবং পশ্চিম ইউরোপে তিনি ততটা জনপ্রিয় নন। তারা বরং ম্যারাডোনারকে বাঁকা চোখে দেখেছে। তাঁর নানা দোষ-ত্রুটি ঘাঁটাঘাঁটি করে সমালোচনার তীর নিক্ষেপ করেছে, নিন্দাবাদ করেছে। তাদের গণমাধ্যম নন্দিত ম্যারাডোনাকে নিন্দিত করতে চেয়েছে। ঝামেলার শুরু ১৯৯০ সালের ইটালি বিশ্বকাপ থেকে। সেবার আর্জেন্টিার কাছে সেমিফাইনালে স্বাগতিক ইটালি পরাজিত হয়- আর যায় কোথায়? ওই পরাজয়টা ইটালির ফুটবল মাফিয়া বা আন্ডারওয়ার্ল্ড মেনে নিতে পারেনি। ফলে সহসাই ম্যারাডোনার কথিত মাদক সেবনের বিষয়টি গণমাধ্যমে আসতে থাকে। মিডিয়া জগতের গডফাদার ও পাপারাজ্জিরা তাঁর পিছু নেয়। অন্যদিকে এর আগে থেকেই পশ্চিমে ইউরোপের অপর দেশ ইংল্যান্ডের সাথে আর্জেন্টিনার সামরিক ও রাজনৈতিক বিরোধ ছিলো। আর্জেন্টিনার জলসীমায় অবস্থিত ফকল্যান্ড দ্বীপ ইংল্যান্ড অবৈধভাবে দখল করে রেখেছে আজ অবধি। ১৯৮২ সালে আর্জেন্টিনা ওই দ্বীপের মালিকানা স্থাপন করতে গেলে- দুই দেশের মধ্যে এক ভয়াবহ রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ হয়। যুদ্ধে স্বল্প শক্তির আর্জেন্টিনা হেরে গেলেও বীর দর্পে যুদ্ধ করে। এই রাজনৈতিক শত্রুতার প্রেক্ষাপটের মধ্যেই ১৯৮৬ সালের বিশ্বকাপে ইংল্যান্ড ও আর্জেন্টিনা মুখোমুখি হয়। ম্যারাডোনা দু’টি গোল করেন। প্রথমটি ঈশ্বরের হাত দিয়ে আর দ্বিতীয়টি সর্বকালের সেরা গোল হিসাবে স্বীকৃতি পায়। যাহোক- ম্যারাডোনার মাদক গ্রহণের বিষয়টি যখন ইটালি দ্বারা প্রচারিত হয়, তখন পুরনো রাগ ঝাড়ার একটা সুযোগ ইংল্যান্ডও পেয়ে যায়। ব্রিটিশ গণমাধ্যম ম্যারাডোনাকে ভিলেন হিসেবে চিত্রিত করার কাজে নেমে পড়ে।
ম্যারাডোনা ছিলেন পূঁজিবাদের সমালোচক। পশ্চিম ইউরোপ ও মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে বলতেন। কিউবার ফিদেল ক্যাস্ট্রোর কাছে ছুটে যেতেন বারবার। ভেনিজুয়েলার হুগো শ্যাভেজ, নিকোলাস মাদুরো তাঁর বন্ধু ছিলেন। চে গুয়েভারা তাঁর ভাববাদী নেতা। তিনি মেহনতি মানুষদের জন্য লড়তে চেয়েছিলেন। তাই তিনি ঘুরে বেড়িয়েছেন সান্টিয়াগো-কারাকাস-হাভানা। ছবি তোলার পোজ দিয়েছেন ওই কালো উসাইন বোল্টের সাথে। ফিলিস্তিনিদের দুঃখের কথা অনুভব করেছেন। মাহমুদ আব্বাসের সাথে দেখা করে বলেছিলেন- ‘আমার হৃদয়ে আছে ফিলিস্তিন। এসব কারণে তিনি স্বভাবতই মার্কিন ও পশ্চিম ইউরোপের মিডিয়ার কাছে ‘ভিলেন’। তাঁর মতো সেলিব্রেটিরা তো থাকবে -লন্ডন, প্যারিস, জুরিখ, নিউইয়র্ক বা লস অ্যাঞ্জেলসসে। কথা বলবেন- পশ্চিমা ধাঁচের তোতা পাখিদের মতো। শেখানো বুলি আওড়াবেন আর বলবেন- বিশ্ব মানবতার জন্য এই সেই অনেক কিছু করছি! ঘরে ঘরে টিকা দিচ্ছি! রাস্তায় রাস্তায় মাইন সরাচ্ছি আর পরিবেশ রক্ষা করছি।
কিন্তু এসবের বিপরীতে ন্যায্য কথা বললে, পশ্চিমাদের বাণিজ্য যুদ্ধ ও সামরিক যুদ্ধের কথা বললেই বিপদ। নতুন আঙ্গিকের কলোনী স্থাপন প্রক্রিয়ার কথা বললেই সেলিব্রেটিগিরি শেষ- সুশীল সমাজ থেকে ঘার ধাক্কা দিয়ে বিদায়। কিন্তু ম্যারাডোনা এসবের তোয়াক্কা করেন নি। কৃত্রিম খ্যাতিকে তিনি দুপায়ে ফুটবলের মাতোই লাথি মেরেছেন। আমৃত্যু কথা বলেছেন- নির্যাতিতদের পক্ষে। ফিফার দুর্নীতি নিয়েও সমালোচনা করেছেন। কারো শেখানো বুলি তিনি আওড়াননি। ২০১৭ সালে মার্কিন যুক্তরাস্ট্রের ভ্রমণ ভিসার জন্য আবেদন করে প্রত্যাখ্যাত হয়েছিলেন। কারণ তিনি ভিসা সংক্রান্ত প্রশ্ন-উত্তর পর্বে ট্রাম্প সম্পর্কে নেতিবাচক মন্তব্য করেছিলেন। তাঁর উত্তর ছিলো ট্রাম্প নামক লোকটা একটা পুতুল। 
হায়রে রাষ্ট্র ব্যবস্থার বৈশ্বিক রীতি! ডযনি বিশ্ব তারকা, তিনি তো বিশ্ব নাগরিকও বটে। তাঁর জন্য আবার কিসের ভিসা! যেখানেই ভক্ত সেখানেই তিনি যাবেন। এতে বাধা দেওয়ার যৌক্তিকতা কোথায়? 
অতএব এসবের সূত্র থেকে বলা যায়, ম্যারাডোনার বিরুদ্ধে নিন্দাবাদ মূলত পশ্চিমা এলিট ও এস্টাবলিশমেন্টদের অহমিকাবোধের এক নির্লজ্জ বহিঃপ্রকাশ ছাড়া আর কিছুই নয়। তিনি যদি তাদের কথা মতো, তাদের ধাঁচে চলতেন, যদি সারি সারি বাড়ি আর শত শত গাড়ির বহরে বিচরণ করতেন- তাহলে জীবিত ম্যারাডোনা তাদের কাছে ফেরেশতাতুল্য হয়ে থাকতেন। আসলে সাজানো মঞ্চ ম্যারাডোনার জন্য ছিলো বড্ড বেমানান। দামাল ছেলেদের খোলা প্রান্তরেই যতসব সৌন্দর্য। সেখানেই গড়ে ওঠে শ্রেষ্ঠতম কীর্তিসমূহ। ম্যারাডোনা ছিলেন মুক্ত মঞ্চের সেই দামাল ছেলে। তিনি আর ইহলোকে নেই। তবে চিরঞ্জীব হয়ে রবেন ধরনীতলে। তাঁর বিদ্রোহী চেতনা প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম পর্যন্ত অনুপ্রেরণা যোগাবে।