জীবন যুদ্ধে সফল নওগাঁর ৫ নারী জয়িতার আত্মকথা

এম আর ইসলাম রতন
প্রকাশ: ১৫ জানুয়ারী ২০১৯ ১২:১৫ ।
প্রচ্ছদ
পঠিত হয়েছে ২৯২ বার।

বর্তমান সময়ে আমাদের সমাজে এমন অসংখ্য নারী রয়েছে যারা নিজেদের মনোবল, ইচ্ছাশক্তি এবং কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে হয়ে উঠেছে স্বাবলম্বী। আর এই সব নারীদের তৃণমূল পর্যায় থেকে উজ্জীবিত ও অনুপ্রাণিত করার লক্ষে মহিলা বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অধিনে উপজেলা মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তর জীবন যুুদ্ধে জয়ী নারীদের স্বীকৃতি প্রদানের জন্য ‘জয়িতা অন্বেষণে বাংলাদেশ’ শীর্ষক কার্যক্রম বাস্তবায়ন করে যাচ্ছে। 
সম্প্রতি নওগাঁর সাপাহার উপজেলা প্রশাসনের সহযোগীতায় ও মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তরের উদ্যোগে উপজেলার ৬টি ইউনিয়নের ৫টি ক্যাটাগরিতে প্রতিটি বিভাগে একাধিক আবেদনকারীদের মধ্যে থেকে দক্ষতার সাথে উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) কল্যাণ চৌধুরীর সভাপতিত্বে উপজেলা মহিলা বিষয়ক অফিসার সুলতান মাহমুদ এবং কমিটির সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা যাছাই-বাছাই করে ৫ জন জয়িতাকে নির্বাচন করা হয় এবং “জয়িতা অন্বেষনে বাংলাদেশ” শীর্ষক এক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে জয়িতাদেরকে সম্মাননা প্রদান করা হয়েছে।
য়িতাদের মধ্যে অর্থনৈতিক ভাবে সাফল্য অর্জনকারী নারী প্রতিবন্ধকতা ও সফলতা ক্যাটাগরিতে উপজেলার ওড়নপুর গ্রামের আসমা বেগম, শিক্ষা ও চাকুরী ক্ষেত্রে সাফল্য অর্জনকারী নারী প্রতিবন্ধকতা ও সফলতা ক্যাটাগরিতে সদরের করলডাঙ্গা গ্রামের অনিতা রায়, “সফল জননী নারী” প্রতিবন্ধকতা ও সফলতা ক্যাটাগরিতে সদরের (সাপাপাড়া)’র আলো রানী সাহা, “নির্যাতনের বিভিষিকা মুছে ফেলে নতুন উদ্যেমে জীবন শুরু করেছেন যে নারী” প্রতিবন্ধকতা ও সফলতা ক্যাটাগরিতে উপজেলার শিয়ালমারী গ্রামের জবেদা খাতুন, “সমাজ উন্নয়নে অসামান্য অবদান রেখেছেন যে নারী” প্রতিবন্ধকতা ও সফলতা ক্যাটাগরিতে ফাহিমা বেগম শ্রেষ্ঠ সফল জননী নারী হিসেবে সম্মাননা গ্রহণ করেছেন। 
সফল জয়িতা আসমা বেগম বলেন আমাদের সমাজে অর্থনৈতিক ও সামাজিক প্রতিবন্ধকতা থাকা সত্ত্বেও জীবন সংগ্রাম করে তিনি আর্থিকভাবে সফল হয়েছেন। ২০১৪ খ্রিঃ সনে ব্র্যাক থেকে ১০,০০০টাকা ঋণ নিয়ে হাঁস-মুরগী পালনের কাজ শুরু করেন এবং সফলতা পান। হাঁস-মুরগী পালনের সফলতা আসায় টেইলারিং এর কাজ শুরু করেন। বর্তমানে তার এই আতœ-কর্মসংস্থান মুলক কাজে ২,০০,০০০/- টাকার পুঁজি রয়েছে। অন্যরাও এতে উৎসাহিত হচ্ছেন। প্রবল মানসিক ইচ্ছাশক্তিতে বলিয়ান হয়ে আর্থিকভাকে সমাজে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন বলে তিনি জানান।
জয়িতা অনিতা রায় বলেন তিনি ছোট বেলা থেকেই নানান প্রতিবন্ধকতার মধ্যে বড় হয়েছেন। তারা দুইবোন। পিতা ছিলেন দিনমুজুর এবং ২০১৭ সালে মৃত্যুবরণ করেন। বাবার অকাল মৃত্যুতে তিনি আজও প্রতিকূলতা থেকে বের হতে পারেননি। ছোট বোনের লেখা-পড়া ও সংসারের খরচ চলে তার বেতন থেকে। তিনি ছোট্টবেলা থেকেই দেখেছেন, তার বাবা মজুরির টাকা তার মা’র হাতে দিত। মা তা দিয়ে চালিয়ে নিত তাদের লেখাপড়া ও সংসারের অন্যান্য খরচ। অনিতা রায় ২০০৫ সালের একটা ঘটনার কথা ভুলতে পারেন না। তখন তিনি ৮ম শ্রেণিতে পড়েন। তিনি জানতেন মাস শেষ হলে তার বাবার চিন্তা আরো বেরে যায়, কিভাবে দুটো মেয়ের প্রাইভেটের বেতন দিবেন। একদিন তার বাবা গায়ে জ্বর নিয়ে কাজে গেলেন। প্রায় দিনই বাবার সকালের খাবার দিয়ে তিনি স্কুলে যেতেন। সেদিনও খাবার নিয়ে গেলেন। বাবার কপালে হাত দিয়ে দেখেন গায়ে জ্বর আছেই। কাজ করতে নিষেধ করলেন। তার বাবা শুনলেন না এবং বললেন, কটা দিন পরেইতো মাস শেষ হবে। তোর প্রায়ভেটেরে বেতন দিতে হবেরে মা। মাঠে কাজ করলে এরকম গা গরম থাকেই। তুই কোন চিন্তা করিসনে। আমি ঠিক আছি, আমার কোন অসুবিধা হচ্ছেনা। কাজ শেষে গোসল করলে গায়ের এই গরম আর থাকবেনা। তুই স্কুলে যা। বাবার এমন কষ্ট তাকে খুব ভাবাতো। প্রতিবেশীরাও তার বাবাকে বলতো মেয়েকে বিয়ে দিতে। তাদের কথা শুনতেন না। কিন্তু সকলের পরামর্শের নিকট একদিন তার বাবা হার মানলেন। বাবা সিদ্ধান্ত নিলেন মেয়ে অনিতা রায়কে বিয়ে দিবেন। অনিতা রায় তখন অষ্টম শ্রেণিতে। অনিতা তাতে রাজী হলেন না এবং বাবা-মাকে বললেন, তোমরা আমাকে নিয়ে কোন চিন্তা কর না। আমার মনোবল আছে। আমি দারিদ্রতার সঙ্গে লড়াই করতে পারবো, যা তোমরাই শিখিয়েছ। অন্যের কথায় কান দিও না।
সফল জননী আলো রানী সাহা বলেন তিনি সাহা দরিদ্র পরিবারের সন্তান। এইচএসসি পাশ করার পর তার বিয়ে হয়। স্বামী বেকার। তিনি জানান, বিয়ের পর তাদের অভাবের সংসারে এক পুত্র সন্তান জন্মগ্রহণ করেন। আলো রানী সাহা তখন থেকেই ভাবতে থাকেন তার সন্তানের ভবিষ্যৎ নিয়ে। বাবা ও স্বামীর দারিদ্রতা তার স্বপ্নকে থামাতে পারেনি। এ লক্ষ্যে তার স্বামীর মনযোগ তৈরী করেন আত্মকর্মসংস্থানের প্রতি। চালু করেন সামান্য পুঁজির এক পানের দোকান। প্রতি দিনের পান বিক্রি থেকে যে লাভ হতো তা দিয়ে চালিয়ে নিত তাদের দৈনন্দিন খরচ। তিনি ছিলেন আতœনির্ভরশীল। সন্তানের পড়া লেখার খরচের জন্য স্বামীর প্রতি নির্ভরশীল ছিলেন না। তিনি টিউশানী করাতেন। তাতে যে টাকা পেতেন তা দিয়ে তিনি একমাত্র ছেলে অনিকের লেখা-পড়ার খরচ চলাতেন। তিনি নিজেও তার ছেলেকে পড়াতেন। কিন্তু আলো রানী সাহার সংসারে আর্থিক সংকট লেগেই থাকতো। তাদের সংসার চলত কঠিন নিয়মের এক ছকে। তিনি বলেন, বর্তমানেও তাদের সংসারে অভাব অনটন লেগেইে আছে। অত্যন্ত কঠোর পরিশ্রম ও আত্মবিশ্বাসে বলিয়ান হয়ে আলো রানী সাহা সমস্ত প্রতিকূলতাকে জয় করে তার সন্তানের লেখা পড়া চালিয়ে গেছেন এবং সন্তানকে স্বপ্ন দেখাতেন। অনিক এখন মা-বাবার স্বপ্ন পূরণের মহাসড়কে। বর্তমানে তার একমাত্র ছেলে অনিক রাজশাহী মেডিকেল কলেজে এমবিবিএস প্রথম বর্ষে অধ্যয়নরত। 
জয়িতা মোসাঃ জবেদা খাতুন বলেন, তার আর্থিক অবস্থা ভাল ছিল না। বিয়ের পর থেকে স্বামী তাকে যৌতুকের জন্য শারিরীক ও মানষিকভাবে নির্যাতন করত। তালাকপ্রাপ্ত হওয়ার পর চরম দারিদ্রতা মোকাবেলা করেছেন তিনি। সমাজের কিছু লোকের অনেক কটুকথা ও সমালোচনার শিকার হন।
জয়িতা ফাহিমা বেগম বলেন ছোটবেলা থেকেই বাধাবিপত্তি উপেক্ষা করে সমাজ সেবামূলক বিভিন্ন কাজ করতেন তিনি। ১৯৮৫ সালে নওগাঁ জেলার সাপাহার উপজেলায় তার বিবাহ হয়। বিবাহের পর সমাজসেবা মূলক কাজে স্বাামীর উৎসাহ পান। দুঃখের বিষয় তার স্বামী ১৯৯৭ সালে স্ট্রোক করেন এবং ১২ বছর চিকিৎসাধীন থেকে ২০০৯ সালে মৃত্যুবরণ করেন। বিবাহের পর হতে সাপাহার উপজেলার সদর ইউনিয়নে যৌতুক প্রথা নিরোধ, আদিবাসীদের জীবনমান উন্নয়ন, সমাজের অসহায় ও অবহেলিত মানুষের পাশে দাড়ানোসহ সমাজ সংস্কার মূলক বিভিন্ন কার্যক্রমে জড়িয়ে পড়াতে সমাজের এক শ্রেণির মানুষ তার কাজের প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেন। 
তিনি আরো বলেন ২০০৩ সালে সাপাহার ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে সংরক্ষিত মহিলা আসনে তিনি প্রথম জয়লাভ করেন এবং ২০০৮ সালে ইউপি নির্বাচনেও একই পদে ২য় বার জয়লাভ করেন। ফাহিমা ২০০৩ সালে ইউপি মেম্বার পদে ভোটের মনোনয়ন জমা দেয়ার পর পারিবারিক ও পারিপার্শিক বাধার সম্মুখ্খীন হোন। প্রথম নির্বাচনে তার স্বামী ও শ্বশুর-শ্বাশুরীকে পাড়া প্রতিবেশীর নানান কটু কথা শুনতে হয়েছে। এক পর্যায় তার শ্বশুর-শ্বাশুরী ভোট করতে অসম্মতি জানান। এ বিষয়ে তাদের মধ্যে দ্বন্দ্বেরও সৃষ্টি হয়। কিন্তু তার স্বামী ওই সময় তাকে দূর্বল ও আশ্রয়হীন করেননি পাশেই ছিলেন এবং উৎসাহ প্রদান করেন। ২০০৩ হতে ২০১৫ পর্যন্ত একটানা ১২ বছর ইউনিয়ন পরিষদের সংরক্ষিত আসনে সদস্য ছিলন। স্বামীহারা এই নারীর রয়েছে প্রবল আতœবিশ্বাস ও জনসাথধারণের অশেষ ভালবাসা। তিনি দেখে দিয়েছেন কোন বাধাই তাকে থামাতে পারেননি। জনসাধারণের অশেষ ভালবাসায় ফাহিমার আগ্রহ ও প্রত্যাশা আরও বেরে যায়। ২০১৭ সালে নওগাঁ জেলা পরিষদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে সংরক্ষিত (সাপাহার-পোরশা-নিয়ামতপুর) আসনে জয়লাভ করেন। বর্তমানে তিনি নওগাঁ জেলা পরিষদের সম্মানিত সদস্য। সর্বোপরি নিজের অবস্থানে থেকে ফাহিমা বেগম সমাজের উন্নয়নমূলক কর্মকান্ডে জড়িত আছেন।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা কল্যাণ চৌধুরী বলেন, এই জয়িতারা এই সমাজের পিছিয়ে পড়া অন্য নারীদের জন্য এক মহা দৃষ্টান্তর। তাদের খুজে বের করে সম্মানিত করা আমাদের নৈতিক দায়িত্বের একটি অংশ। তাই আমরা চেষ্টা করেছি এই জয়িতাদের ক্ষুদ্র হলেও সম্মানিত করার। আমাদের চেষ্টা আগামীতেও অব্যাহত থাকবে।