কবর খোঁড়াই যাদের নেশা

গোরখোদকদের আত্মকথন

জাকির আরেফিন শুভ
প্রকাশ: ১৯ জানুয়ারী ২০১৯ ১৩:৫১ ।
প্রচ্ছদ
পঠিত হয়েছে ৮৯৯ বার।

‘একদিন মাটির ভিতরে হবে ঘর রে .. মন আমার, কেন বাঁধো দালান ঘর’ শ্বাশত এই বাউল গানের মত সবারই একদিন শেষ ঠিকানা হবে স্যাঁতসেতে অন্ধকার মাটির ঘর। এই মাটির ঘর অর্থাৎ কবর তৈরীর যারা সুনিপুন কারিগর তাদের বলা হয় “গোরখোদক”। কথা হচ্ছিল বগুড়ার কাটনারপাড়ার অভিজ্ঞ গোরখোদক বেলাল হোসেনের সাথে।
শুরুতেই বেলালের কাছে জানতে চাই, কবর খুঁড়তে গিয়ে কোন ভীতিকর অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়েছে কিনা ? শুনে একমুহুর্ত কি যেন ভাবলো বেলাল, তারপর স্মৃতি হাতরে বলা শুরু করলো- অনেকদিন আগে, কবর খুঁড়তে যায়্যা দুডা খুলি আর হাড্ডি পাইছিলাম ! খুলির সাথে মশকরা করছিল তার সঙ্গী সাইফুল। ব্যাস! মাস দেড়েকও বাঁচলোনা আর। থাক্যা থাক্যাই খালি ঝাকি দিয়ে উঠতো আর জিহ্বা বার কর‌্যা থাকতো কালিমুর্তির মত। ডাক্তার ফকির কেউ কিচ্চু করতে পারলোনা।
কথাবার্তায় বোঝা গেল, বেলাল আজও ভুলতে পারেনি সাইফুলের এই রহস্যজনক মৃত্যুর কথা।
পেশায় টিউবওয়েল মিস্ত্রি বেলাল কবর খোঁড়ার পাশাপাশি লাশ ধোওয়ার কাজও করে। তার দলের অন্য গোরখোদকদের মধ্যে উল্লেখ্যযোগ্য হলো- আব্দুর রহিম (৩৫), ফেরদৌস (৫০), বাবলু মিয়া (৫৫) আর চান্দা (৬০)। এদের কেউ ভ্যান চালক, কেউ হাটের পাহারাদার আবার কেউ স্কুলের নাইটগার্ডের চাকরী করে। চান্দাই এইকাজে তাদের ওস্তাদ। তবে বয়সের কারনে চান্দা সরে দাঁড়িয়েছে অনেক আগেই। এখন বেলালই পরিচালনা করছে তাদের দল-কে। বেলাল জানায়, খোঁড়ার কাজে নবীন প্রবীণ মিলে ১০/১২ জনের একটি দল আছে তাদের। সবাইকে অবশ্য সমসময় ডাকার প্রয়োজন পড়ে না। কবর খোঁড়ার জন্য ৪/৫ জনই যথেষ্ট।
বেলালের চেয়ে বয়সে তরুণ আব্দুর রহিম। রহিম জানায়, বর্ষার সময় কবরের মধ্যে পানি চোওয়ায় বেশী। কখনও কখনও বুক পর্যন্তও পানি উঠে আসে। অগত্যা বারবার ডুব দিয়ে তলার মাটি খুঁড়ে আনতে হয়। জানা যায়, এ কাজে নাকি রহিমের জুরি মেলা ভার। বর্ষার সময় তলার পানিটুকু অনেকসময় মেশিন দিয়েও সেচতে হয়। তারপর ফিনিশিং-এর কাজ করে তারা।
বেলালের কাছ থেকে জানা যায়, কবরে পানি উঠলে মেয়েদের কবর খুঁড়তে সময় অনেক বেশী লাগে। কারন ধর্মীয় মতে মেয়েদের কবরের উচ্চতা হতে হয় বুকের ছাতি পর্যন্ত আর ছেলেদের নিয়ম নাভি পর্যন্ত খোঁড়া। যাইহোক কবরে পানি থাকলে লাশকে শোয়ানোরও একটি বিশেষ নিয়ম আছে বলে পুন্ড্রকথা’কে জানায় তারা। কলার গাছের ডোঙ্গা দিয়ে ভেলা বানিয়ে তার উপর লাশকে শোয়াতে হয়। কবরে মাটি চাপা পড়লে পানি আর নীচ থেকে চোওয়ায় না।
বিশেষ আরও একটি তথ্য পাওয়া গেলো বেলালদের সাথে কথা বলে। গোরস্থানের মাটির তৈলাক্ততা নাকি অন্যান্য মাটির তুলনায় অনেক বেশী। যাইহোক ওদের ব্যাখ্যাটা শুনে একটু শিউরে উঠলাম। শিউরে ওঠারই কথা। গোরস্থানের মাটির সাথে মৃত মানুষের দেহের মাংস, চর্বি মিশে দীর্ঘ সময়ের ব্যবধানে মাটির তৈলাক্ততা অনেক বেড়ে যায়। ফলে কবর খোঁড়ার সময় শরীরে যে মাটি লেগে যায় সেটা সহজে ওঠে না। দাফন শেষে পরে থাকা বাঁশের টুকরোগুলি কেটে চাছ বানিয়ে তারপর শরীর থেকে তৈলাক্ত মাটি কেকড়ে তুলতে হয়। ভাবা যায়!
অনেক সময় কবর খুঁড়তে গিয়ে মানুষের দেহের হাড়গোরও পাওয়া যায়। গোরখোদকরা সে হাড়গুলি যত্ন সহকারে আবার পার্শ্ববর্তী কোন জায়গায় পুঁতে দেয়।
যাইহোক, কবর খোঁড়ার ডাক পেলে যত দ্রুত সম্ভব বেলালদের কেউ না কেউ গিয়ে খোঁড়ার কাজ শুরু করে। অন্যরা হাতের কাজ সেরেই চলে আসে। চান্দা-বেলালের দল এ পর্যন্ত সাতশতর মত কবর খুঁড়েছে বলে জানা যায়।
নিকটজনদের কবর খোঁড়ার মত কষ্টের অভিজ্ঞতা তাদের সবারই রয়েছে। তবে বেলাল এক্ষেত্রে যেন একধাপ এগিয়ে। আজ থেকে বছর দশেক আগে মাত্র একদিনের ডায়রিয়ায় বেলাল তার প্রাণপ্রিয় সন্তানকে হারিয়েছে। বেলাল জানায়, সে তার কলিজার টুকরা সন্তানের কবর খোঁড়ার সাথেও সম্পৃক্ত ছিল।
একসময় চান্দা, বেলালদের মত গোরখোদকরাই ছিল কবর খোঁড়ার প্রধান করিগর। এরমাঝে সময় পেরিয়েছে অনেক। এখন বিভিন্ন গোরস্থান কমিটি কবর খোড়ার জন্য নিজস্ব গোরখোদক নিয়োগ দিয়ে থাকে। ফলে বেলালদের কাজ কমে এসেছে অনেক। কথায় কথায় জিজ্ঞেস করি পারিশ্রমিকের কথা। তারা জানায়, পারিশ্রমিকের কান্ডারী নয় তারা। কবর খোঁড়া নেকির কাজ, ছোওয়াবের কাজ। নেকির নেশাতেই তারা ছুটে যায় অচেনা-অজানা মানুষের শেষ ঠিকানার বন্দোবস্ত করতে। তাদের শান্তি এখানেই।
কবর খোঁড়ার পর মৃতের পরিবার খুশি হয়ে যা বকশিস দেয় তাতেই খুশি বেলালরা। কথাটা বলার সময় প্রশান্তির একটা হাসি খেলে যায় বেলালের চোখেমুখে।
যাইহোক, সবার সাথে কুশল বিনিময় করে উঠলাম। অফিসপানে ছুটতে হবে এখন। মনে মনে ভাবলাম, গোরখোদকদের প্রাপ্তিটা আসলে কোথায়? পরক্ষনেই মনে হলো, আসলে বেলালদের প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তিকে বৈষয়িক লাভ লোকসানের মাপকাঠিতে মাপা সম্ভব নয়। এদের প্রাপ্তিটা অন্য কোথাও, অন্য কিছু। এদের প্রাপ্তিটা আসলে অপার্থিব।
ভালো থাকুক বেলালেরা।