বগুড়াবাসীর প্রশ্ন- ‘একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য আর কত যোগ্যতার পরিচয় দিতে হবে?’

বিশেষ প্রতিবেদনঃ
প্রকাশ: ২২ জুলাই ২০১৮ ০৫:৫৪ ।
প্রচ্ছদ
পঠিত হয়েছে ১৭৬৬ বার।

‘আর কত বয়স হলে বয়স্ক ভাতা মিলবে?’- এধরনের প্রশ্নবোধক শিরোনাম আমরা পত্র-পত্রিকায় প্রায়ই দেখি। আর্থিকভাবে স্বচ্ছল নন এবং বয়সও ষাটের উপর। তার পরেও যদি কোন বৃদ্ধ সরকারি তরফে বয়স্ক ভাতা না পান তখন সেই কাহিনীর গুরুত্ব তুলে ধরতে গিয়ে গণমাধ্যমগুলোতে এ ধরনের শিরোনাম ব্যবহার করা হয়।
বগুড়ায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষের উদ্যোগহীনতায় হতাশ এ জেলার মানুষের মনেও ঠিক একই ধরনের প্রশ্নের সৃষ্টি হয়েছে। এখন তাদের একটাই জিজ্ঞাসা- ‘একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য আর কত যোগ্যতার পরিচয় দিতে হবে?’ তাদের এ প্রশ্ন অমূলক নয় বরং যুক্তিসঙ্গত। কারণ একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সব উপযোগীতা এখানে বিদ্যমান।
এক. প্রায় দেড় যুগ আগে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় একটি আইন পাশ হয়েছে।
দুই. প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতিশ্রুতি রয়েছে
তিন. জেএসসি, এসএসসি এবং এইচএসসির ফলাফলে বগুড়ার শিক্ষার্থীরা বার বার বোর্ডে সেরা হওয়ার কৃতিত্ব দেখিয়ে যাচ্ছে।
চার. বাংলাদেশের পুরাতন ১৮টি জেলার মধ্যে একমাত্র বগুড়া ছাড়া অন্য জেলাগুলোতে একটি করে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা হয়েছে।
পাঁচ. এক সময়ের মহকুমা ছিল এখন জেলায় উন্নীত হয়েছে এমন ছোট কয়েকটি জেলার ভাগ্যেও বিশ্ববিদ্যালয় জুটেছে।

পেছনে ফিরে দেখাঃ ২০০১ সালের ১৫ জুলাই তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনামলে জাতীয় সংসদে ‘বগুড়া বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় আইন’ পাশ করা হয়। পরবর্তীতে সেই আইনটি গেজেটভুক্তও করা হয়। কিন্তু ২০০১ সালের অক্টোবরে নির্বাচনের মাধ্যমে বিএনপি নেতৃত্বাধীন চার দলীয় জোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর সেটি আর আলোর মুখ দেখেনি। এমনকি সেই সময়কার প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার নির্বাচনী জেলা হিসেবে বগুড়ায় আন্তর্জাতিক মানের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ‘এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফর উইমেন’ প্রতিষ্ঠার উদ্যোগের কথা শোনা গেলেও পরবতীতে সেটি  চট্টগ্রামে সরিয়ে নেওয়া হয়।
এরপর বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দাবিতে বগুড়ার বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষ আন্দোলন শুরু করলে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৫ সালের ১০ জানুয়ারি ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে বগুড়ায় আর্মি মেডিকেল কলেজ ভিত্তি স্থাপনের প্রাক্কালে এ জেলায় বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনে তাঁর সদিচ্ছার কথা জানান। এরপর একই বছরের ১২ নভেম্বর বগুড়ায় এক জনসভায় তিনি বগুড়ার উন্নয়নে বিশ্ববিদ্যায়সহ বড় ধরনের ৮টি উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নের প্রতিশ্রুতি দেন। তার প্রায় দেড় বছরের মাথায় ২০১৭ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি জেলার সান্তাহারে আওয়ামী লীগের অপর এক জনসভায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বগুড়ায় বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনে তার দেওয়া প্রুতিশ্রুতির কথা পুনর্ব্যক্ত করেন।

রাজশাহী বোর্ডে বগুড়ার শ্রেষ্ঠত্বঃ চলতি বছর ১৯ জুলাই উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার ফল ঘোষণায় দেখা গেছে পাশের হার এবং জিপিএ-৫ প্রাপ্তির ক্ষেত্রে বগুড়া এবার বোর্ড সেরা হয়েছে। রাজশাহী শিক্ষা বোর্ডে এবার গড় পাশের হার যেখানে ৬৬ দশমিক ৫১ শতাংশ সেখানে বগুড়ার কলেজগুলো থেকে উত্তীর্ণ হয়েছে ৭১ দশমিক ২০ শতাংশ শিক্ষার্থী। বগুড়া থেকে উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীদের মধে ১ হাজার ৬৮৮ জন শিক্ষার্থী জিপিএ-৫ পেয়েছে। যা রাজশাহী শিক্ষা বোর্ডে সর্বোচ্চ। শুধু এবারই নয় ২০১৫ সাল থেকেই জিপিএ-৫ প্রাপ্তির ক্ষেত্রে বগুড়ার কলেজগুলো শ্রেষ্ঠত্ব ধরে রেখেছে। তাছাড়া ২০১৫ সাল পর্যন্ত বোর্ড সেরা ২০টি প্রতিষ্ঠানের তালিকায় (এখন আর করা হয় না) বরাবরই অর্ধেকেরও বেশি বগুড়ার দখলে থাকতো। উচ্চ মাধ্যমিকের মত চলতি বছর মাধ্যমিকেও বগুড়া সর্বোচ্চ সংখ্যক শিক্ষার্থী জিপিএ-৫ পেয়ে উত্তীর্ণ হয়ে রেকর্ড সৃষ্টি করে। এমনকি এ বছর বিভাগীয় জেলা রাজশাহীর চেয়ে বেশি সংখ্যক শিক্ষার্থী বগুড়া থেকে মাধ্যমিক পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে। মাধ্যমিকে রাজশাহী থেকে অংশ নেয় ৩১ হাজার ৯২৯জন আর বগুড়ার পরীক্ষার্থী ছিল ৩৩ হাজার ৪৩৩জন। একই অবস্থা নিম্নমাধ্যমিক সমাপনী পরীক্ষাতেও।

সুশীল সমাজের প্রতিক্রিয়াঃ বগুড়া জিলা স্কুলের প্রাক্তন শিক্ষক বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ শ্যামল ভট্টাচার্যের মতে কারণ এ জেলায় শিক্ষার হার অনেক বৃদ্ধিও কারণে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা জরুরী হয়ে পড়েছে। তিনি বলেন, ‘বগুড়ায় কোন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় না থাকায় প্রতি বছর এইচএসসি উত্তীর্ণ অন্তত ১০ হাজার শিক্ষার্থীকে ঢাকা, চট্টগ্রাম ও রাজশাহী ছুটতে হয়। এতে যেমন ভোগান্তি বাড়ে তেমনি অনেকের পক্ষে পরীক্ষায় অংশ নেওয়াও সম্ভব হয় না। ফলে বহু শিক্ষার্থী উচ্চ শিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত থাকছে।’

বগুড়া সচেতন নাগরিক কমিটির (সনাক) সভাপতি মুক্তিযোদ্ধা মাছুদার রহমান হেলাল বলেন, ‘বাংলাদেশের পুরাতন যেসব জেলা রয়েছে সেগুলোর মধ্যে বগুড়া ছাড়া সবগুলোতেই পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। এমনকি পূর্বে মহকুমা ছিল এমন অনেক জেলাতেও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। কিন্তু শুধু বগুড়ার ভাগ্যেই আজ পর্যন্ত একটি বিশ্ববিদ্যালয় জুটলো না; এমনকি প্রধানমন্ত্রীর প্রতিশ্রুতি থাকার পরেও না।’

শাসক দলের স্থানীয় নেতৃবৃন্দ কী বলছেনঃ বগুড়া জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি মমতাজ উদ্দিন বলেন, এ জেলায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে সরকার খুবই আন্তরিক। কিন্তু প্রক্রিয়াগত নানা জটিলতায় সেটি হয়তো পিছিয়ে যাচ্ছে, তবে এটা একদিন হবেই।

জেলা প্রশাসক যা বলেনঃ বগুড়ায় বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনে প্রধানমন্ত্রীর দেওয়া প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সর্বশেষ অগ্রগতি জানতে চাইলে জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ নূরে আলম সিদ্দিকী বলেন, ‘আমরা জানি যে শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনকে আইন প্রণয়নের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। তবে সেটা এখন কোন অবস্থায় রয়েছে সেটি আমরা জানি জানি না।’