শ্যামল ভট্টাচার্য- আমাদের বাতিঘর

আমিনুর রহমানঃ
প্রকাশ: ২২ জুলাই ২০১৮ ১০:৩০ ।
প্রচ্ছদ
পঠিত হয়েছে ১৩৭০ বার।

নিজে স্কুলে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পেলেও মহল্লার অনেকে তা থেকে বঞ্চিত ছিল। যা তাঁকে পীড়া দিত। তাইতো সেই কিশোর বয়সেই তিনি নিজ এলাকার নিরক্ষরদের মাঝে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা করেন। তখন তিনি বগুড়া জিলা স্কুলের ৮ম শ্রেণির ছাত্র। পরিকল্পনা অনুযায়ী একদিন সহপাঠীদের নিয়ে একদিন মহল্লায় একটি নৈশ বিদ্যালয় খুলে বসেন। যারা কখনও স্কুলে যাওয়ার সুযোগ পায়নি- মহল্লার এমন শিশু, সমবয়সী কিশোর এবং পিতার বয়সী বয়স্ক লোকজনদের খুঁজে এনে ভর্তি করা হয় সেই নৈশ বিদ্যালয়ে। শিক্ষা দিয়ে মানুষকে আলোকিত করার সেই মহতী উদ্যোগ পরবর্তী কর্মজীবনে এবং বর্তমান অবসর জীবনেও যিনি ধরে রেখেছেন তিনি হলেন বগুড়ার প্রবীণ শিক্ষাবিদ শ্যামলরঞ্জন ভট্টাচার্য। যিনি শ্যামল ভট্টাচার্য হিসেবেই বেশি পরিচিত।
ডিপ্লোমা প্রকৌশলী শ্যামল ভট্টাচার্য ১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধের পর পরই তৎকালীন গ্রেটার চিটাগাং ইলেকট্রিসিটি বোর্ডে সাব অ্যাসিসটেন্ট ইঞ্জিনিয়ার পদে যোগ দিয়েছিলেন। বেতন ছিল ২১০ টাকা। কিন্তু ছাত্র জীবনে তিনি নিজে এবং ৬ ভাই ৫ বোনের অধিকাংশই কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে যুক্ত থাকার তথ্য পুলিশ জেনে যাওয়ায় ১ মাস ১০দিনের মাথায় সেই চাকরিটাও চলে যায়। তারপর বেকার হয়ে চাকরির সন্ধানে চট্টগ্রাম থেকে তিনি চলে যান ঢাকায়। একদিন নিউ মার্কেট এলাকায় দেখা হয় তাঁর এক সময়ের প্রিয় শিক্ষক (১৯৫২ সালে বগুড়া জিলা স্কুলের প্রধান শিক্ষক ছিলেন) রাজশাহী বিভাগীয় ডেপুটি ডিরেক্টর অব পাবলিক ইন্সট্রাকশন-ডিডিপিআই এ কে এম এ আব্দুল আজিজের সঙ্গে। দীর্ঘদিন পরে দেখা হলেও প্রিয় ছাত্রটিকে চিনতে কষ্ট হয়নি তাঁর। কারণ স্কুলে পড়ার সময় তৃতীয় থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত বরাবরই ‘ফার্স্টবয়’ ছিলেন শ্যামল ভট্টাচার্য। এছাড়া খেলাধুলা থেকে শুরু করে বিতর্ক প্রতিযোগিতা এবং নাটকে বহু পুরষ্কার ছিনিয়ে নেওয়ায় সব শিক্ষকই তাঁকে আলাদা চোখে দেখতেন। সেই প্রিয় ছাত্র শ্যামল ভট্টাচার্য বেকার হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে শোনার পর আব্দুল আজিজ তাঁকে শিক্ষকতা পেশায় যুক্ত হওয়ার প্রস্তাব দেন। পরে তিনিই তাঁকে বগুড়া জিলা স্কুলে শিক্ষকতার চাকরিটি পাইয়ে দেন।
শ্যামল ভট্টাচার্য ১৯৬৭ সালের ১৬ জানুয়ারি বগুড়া জিলা স্কুলে যোগদান করেন। শুরুতে ‘ইন্ডাস্ট্রিয়াল আর্টস’ বিষয়ের শিক্ষক হিসেবে যোগদান করলেও পরবর্তীতে তিনি বাংলা পড়ানো শুরু করেন। মাঝে দু’ বার অন্যত্র বদলি হলেও ২০০০ সালে অবসর নেওয়ার আগ পর্যন্ত দীর্ঘ সময় তিনি ওই স্কুলেই কর্মরত ছিলেন। ১৯৩৯ সালের ১০ আগস্ট বগুড়ায় জন্ম নেওয়া শ্যামল ভট্টাচার্য শিক্ষকতা শুরু করার পর বেতনের পয়সা দিয়ে জলেশ্বরীতলা নূর মসজিদ এলাকায় একটি পাঠাগার গড়ে তোলেন। সেখানে বই পড়ার জন্য স্কুলের ছাত্রী এবং গৃহবধুরাই বেশি যেতেন। ১৯৬৯ সালে গড়ে তোলা পাঠাগারটি প্রায় পাঁচ বছর চালু ছিল। পরবর্তীতে তিনি আরও বড় পরিসরে পাঠাগার তৈরির পরিকল্পনা করেন। শ্যামল ভট্টাচার্য জানান, শুনে শুনে জ্ঞানবানের মত অভিনয় করার চেয়ে মানুষ যাতে বই পড়ে প্রকৃত অর্থেই নিজেকে সমৃদ্ধ করতে পারে সেই লক্ষ্য নিয়েই তিনি বড় একটা পাঠাগার তৈরির কথা চিন্তা করেন।  এরপর তিনি ১৯৭৪ সালে ঢাকায় বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের স্বপ্নদ্রষ্টা আব্দুল্লাহ্ আবু সাঈদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন এবং তাঁর মাধ্যমেই বগুড়ায় বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের যাত্রা শুরু হয়। পরবর্তীতে তাঁর হাত ধরে ঠাকুরগাঁও, নীলফামারী, নাটোরসহ উত্তরাঞ্চলের অন্য জেলাগুলোতেও বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্রের কার্যক্রম আর প্রসারিত হয়।
বই পাগল শ্যামল ভট্টাচার্য দশম শ্রেণির ছাত্র থাকা অবস্থায় বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বুদ্ধদেব বসু, তারাশঙ্কর, মানিক বন্দোপাধ্যায় এবং বিভূতি ভুষণ বন্দোপাধ্যায়সহ বিখ্যাত লেখকদের প্রায় সব বই পড়া শেষ করেছেন। এমনকি পারিবারিক রাজনৈতিক আবহে বেড়ে ওঠার কারণে সেই কিশোর বয়সে কালমার্কসের লেখাগুলোও তার মগজে ঢুকে পড়ে। বড় ভাই চিত্ত রঞ্জন ভট্টাচার্যের (যিনি ১৯৪০ সালে কমিউনিস্ট পার্টির জেলা সম্পাদক ছিলেন) অনুপ্রেরণায় ছাত্র রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন শ্যামল ভট্টাচার্য। ১৯৫২ সালে যখন ভাষা আন্দোলন শুরু হয় তখন তিনি ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্র। একুশে ফেব্রুয়ারি ঢাকায় ছাত্রদের মিছিলে গুলির খবর পাওয়ার পর কিশোর শ্যামল ভট্টাচার্য স্কুলের ৩০০ শিক্ষার্থীকে নিয়ে মিছিল বের করেন। মিছিলটি নিয়ে স্কুলের ক্যাম্পাস থেকে শহরের সাতমাথা এলাকা প্রদক্ষিণ করার সময় পুলিশ তাদের বাধা দেয়। এরপর শ্যামল ভট্টাচার্যকে আটক করা হয়। ছেলের মিছিল করার অপরাধে আটক করা হয় তাঁর বাবা বগুড়া বারের তৎকালীন সিনিয়র আইনজীবী হৃষিকেশ ভট্টাচার্যকেও। কয়েক ঘন্টা পর অবশ্য তাদের দু’জনকেই ছেড়ে দিতে বাধ্য হয় পুলিশ। ভাষা আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা পালনের কারণে দশম শ্রেণিতে পড়ার সময় ১৯৫৬ সালে তাঁকে ছাত্র ইউনিয়ন বগুড়া জেলা কমিটির পাঠাগার সম্পাদক মনোনীত করা হয়। ১৯৫৮ সাল পর্যন্ত তিনি ওই দায়িত্ব পালন করেন। রাজনীতি সচেতন শ্যামল ভট্টাচার্য ঢাকায় ইস্ট বেঙ্গল পলিটেকনিক ইন্সটিটিউটে (বর্তমানে ঢাকা পলিটেকনিক ইন্সটিটিউ) ভর্তি হওয়ার পর ’৬২ সালের ঐতিহাসিক শিক্ষা আন্দোলনের সঙ্গেও যুক্ত হয়েছিলেন।
শিক্ষার পাশাপাশি নাট্য আন্দোলনের সঙ্গেও সম্পৃক্ত শ্যামল ভট্টাচার্য। স্কুলের বার্ষিক নাটকে অভিনয়ের পাশাপাশি পাড়া-মহল্লার মঞ্চেও নিয়মিত ছিলেন তিনি। ১৯৭২ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি তিনি বগুড়া নাট্য গোষ্ঠী নামে একটি নাটকের দল গঠন করেন। একই বছর তিনি ‘আমিই মন্ত্রী হব’ নাটকের কেন্দ্রীয় চরিত্রে অভিনয় করেন। সে সময় তার অভিনীত ‘নানা রঙের দিনগুলি’ নাটকটি ব্যাপক দর্শক প্রিয়তা পেয়েছিল। দর্শকদের অনুরোধে নাটকটি অন্তত দেড় শ’ বার মঞ্চস্থ হয়। দ্বৈত চরিত্রের ওই নাটকে তিনি ‘রজনী চাটুয্যে’ চরিত্রে অভিনয় করেন। এরপর ১৯৭৪ সালে মঞ্চস্থ ‘অন্ধকারের নিচে সূর্য’ নাটকটিও ব্যাপক জনপ্রিয় হয়েছিল। নাট্য সংগঠক শ্যামল ভট্টাচার্য পরবর্তীতে ‘বগুড়া নাট্য দল’ নামে নতুন একটি দল গঠন করেন। নতুন ওই দল গঠনের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে শ্যামল ভট্টাচার্য জানান, ১৯৮৭ সালে গঠিত সেই দলটির নাম রেখেছিলেন দেশ বরণ্যে নাট্য ব্যক্তিত্ব রামেন্দু মজুমদার।
নাটকের প্রতি প্রচ- ভালবাসা রয়েছে বলেই অভিনয়ের ডাক পেলে এখনও তিনি মঞ্চে ছুটে যান। সর্বশেষ ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে মঞ্চস্থ হয় তাঁর অভিনীত নাটক ‘খারিজ’। পশ্চিমবঙ্গের বিশিষ্ট লেখক হরিমাধব মুখোপাধ্যায়ের লেখা ওই নাটকে প্রধান চরিত্র ‘মাতব্বর’-এর ভূমিকায় অভিনয় করে ব্যাপক প্রশংসা কুড়িয়েছেন পঁচাত্তর বছর বয়সী শ্যামল ভট্টাচার্য। অভিনয়ের পাশাপাশি তিনি নাট্য আন্দোলনকে ছড়িয়ে দিতে নতুন মুখ তৈরিতেও কাজ করে যাচ্ছেন। শহরের শহীদ টিটু মিলনায়তনে বগুড়া নাট্য দলের কার্যালয়ে নিয়মিত ক্লাস নেন গুণী এই নাট্য ব্যক্তিত্ব। বগুড়া জিলা স্কুলের প্রাক্তন ছাত্র ও বগুড়া থিয়েটারের সাধারণ সম্পাদক তৌফিক হাসান ময়না জানান, ‘শ্যামল স্যার অসাধারণ প্রতিভার একজন মানুষ। স্কুল জীবনে যাঁদের কাছে নাটক শিখেছি তাদের অন্যতম শ্যামল স্যার। তিনি এখনও নাটকের সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন। তাঁর কর্ম আমাদের  প্রেরণার উৎস।’
বার্ধক্য শরীরে ভর করলেও তাকে পাত্তা দিতে চান না শ্যামল ভট্টাচার্য। এখনও দিনের বেশির ভাগ সময় তিনি বইয়ের ভেতর ডুবে থাকেন। বাড়ির শয়ন কক্ষে গড়ে তুলেছেন ২ হাজার বইয়ের একটি লাইব্রেরী। তাঁর সংগ্রহে রয়েছে বিশ্ব ইতিহাস, সাহিত্য ও সংস্কৃতির দুর্লভ অনেক বই। শ্যামল ভট্টাচার্য জানান, আলমিরা ভর্তি বইগুলোই তার সারা জীবনের সঞ্চয়। বগুড়া লেখক চক্রের সাধারণ সম্পাদক আমির খসরু সেলিম জানান, শ্যামল স্যার বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের মাধ্যমে বহু পাঠক তৈরি করেছেন। ওই কেন্দ্রের সদস্য সংখ্যাও দিন দিন বাড়ছে। তিনি বলেন, ‘শিক্ষার্থীদের সুবিধার্তে স্যার নিজেও তার বাড়িতে একটি লাইব্রেরী গড়ে তুলেছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষার্থী তাদের গবেষণার জন্য প্রয়োজনীয় বইয়ের সন্ধান করতে স্যারের বাসায় আসেন। কিছুদিন আগে একজন গবেষক ৭০টি দুর্লভ একটি বইয়ের তালিকা নিয়ে স্যারের কাছে গিয়েছিলেন। তার মধ্যে ৬২টি বই পাওয়া গেল স্যারের লাইব্রেরীতে।’
সৃজনশীল মানুষ শ্যামল ভট্টাচার্য খেলাধুলা বিশেষত ক্রিকেট আর ফুটবলের দারুণ ভক্ত। এখনও রাত জেগে খেলা দেখেন তিনি। বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের অধিনায়ক মুশফিকুর রহিম মিতু তাঁর ছাত্র। বগুড়ার ছেলে মিতু জাতীয় দলের অধিনায়ক নির্বাচিত হওয়ার পর নিজের বাড়িতে যাওয়ার আগে স্যারের পা ছুঁয়ে সালাম করেছিলেন। সেদিনের অনুভূতির কথা বলতে গিয়ে শ্যামল ভট্টাচার্য বলেন, ‘মিতু আমাকে যে সম্মান দিয়েছে তা কখনও ভুলতে পারবো না। ও যখন আমার পায়ে হাত দিয়ে সালাম করে তখন মনে হয়েছে আমি শিক্ষকতা পেশায় এসে ভুল করিনি। প্রকৌশলী কিংবা অন্য কোন পেশায় থাকলে হয়তো এটা পেতাম না।’
শ্যামল ভট্টাচার্য এখনও শোষণ ও বঞ্চনামুক্ত একটি সুখি বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেন। রাজনীতির নামে নোংরামি আর স্বাধীনতা বিরোধীদের আস্ফালন এবং তাদের মিথ্যাচারে তিনি ভীষণ কষ্ট পান। তিনি মনে করেন, শিক্ষার প্রকৃত আলো ছড়িয়ে দেওয়ার মাধ্যমেই কেবল দেশ ও দেশের মানুষকে এগিয়ে নেওয়া সম্ভব। তাই শিক্ষা বিস্তারে আমৃত্যু কাজ করে যেতে চান সৃষ্টিশীল এই মানুষটি।