তাজউদ্দীন আহমদের জন্মদিন আজঃ ‘বাংলাদেশ একদিন নিজস্ব প্রয়োজনেই খুঁজে নেবে তাঁকে’

শারমিন আহমদঃ
প্রকাশ: ২৩ জুলাই ২০১৮ ০৪:৪৫ ।
প্রচ্ছদ
পঠিত হয়েছে ৩৬৯ বার।

শীতলক্ষ্যার কূল ঘেঁষা, শাল গজারীর বনে ঘেরা, লাল মাটিতে পথ আঁকা, নিটোল সবুজ গ্রাম দরদরিয়ায়, ভরা শ্রাবণের এক দিবাগত রাতে, ১৯২৫ সালের ২৩ জুলাই, বৃহস্পতিবার, তাজউদ্দীন আহমদ জন্ম গ্রহণ করেন। মাত্র অর্ধশত বছরের জীবনেই তিনি সম্পন্ন করেছেন শত বছরের যুগান্তকারী কর্ম। বাংলাদেশ নামের এক স্বাধীন রাষ্ট্রের অভ্যুদয়ে ও নবজাত রাষ্ট্র গঠনে তিনি যে অনন্য ও অসাধারণ অবদান রেখেছেন তা যুগ যুগ ধরেই বিশ্বের স্বাধীনতাকামী জাতির জন্যে হতে পারে দিক দর্শন ও অপার সম্ভাবনার বাতিঘর। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রেরণা ও প্রতীক । পাকিস্তান কারাগারে বন্দী বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে, তাজউদ্দীন আহমদ, এক নির্মোহ সাধকের অধ্যবসায় নিয়ে সেই প্রেরণাকে এক সাফল্যমণ্ডিত মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার মধ্যে দিয়ে বাস্তবায়িত করেন। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদকে যদি একবাক্যে সংজ্ঞায়িত করতে হয় তাহলে বলা যায় তিনি ছিলেন এক দুর্দান্ত প্রকৃতির ন্যায়নিষ্ঠ, নির্ভীক, দূরদর্শী ও স্বাধীনচেতা মানুষ। নিজেকে আড়ালে রেখে ও কোন কৃতিত্ব দাবী না করে বিশাল মাপের কাজগুলি অসাধারণ দক্ষতা, বিচক্ষণতা ও আন্তরিকতার সাথে যেমন করে সম্পন্ন করতেন তার জুড়ি মেলা ভার। তার চরিত্রর ঐ বিরল গুনাবলীরই সার্থক বহিঃপ্রকাশ ঘটে ১৯৭১ সালের চরম প্রতিকূল সময়ের আবর্তে- মুক্তিযুদ্ধের যজ্ঞ পীঠে। তাজউদ্দীন আহমদকে না জানলে তাই বাংলাদেশের জন্ম কথা- মুক্তিযুদ্ধর ইতিহাস জানাও হবে অসম্পূর্ণ।

১৯৭১ সালের ৩০ মার্চ, শ্রান্ত, অনাহারে ক্লিষ্ট তাজউদ্দীন আহমদ ও তাঁর দুর্গম যাত্রা পথের সাথী ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলামকে কুষ্টিয়ার সীমান্ত হতে ভারতে স্বাগত জানিয়েছিলেন ভারতের সীমান্ত রক্ষীবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় প্রধান আই. জি গোলোক মজুমদার। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মৃত্যু তালিকাভুক্ত তাজউদ্দীন আহমদ ঐ শঙ্কাকুল অবস্থাতেও নিজ দেশের মর্যাদার প্রসঙ্গে ছিলেন সজাগ ও অবিচল। তিনি ও ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম গোলোক মজুমদারকে বলেছিলেন যে এক স্বাধীন রাষ্ট্রের প্রতিনিধি রুপে তাঁদেরকে যোগ্য মর্যাদায় গ্রহণ করলে পরেই তারা ভারতে আশ্রয় নেবার কথা ভাবতে পারেন। গোলোক মজুমদার সেই কথা রেখেছিলেন। তিনি তাঁর ঊর্ধ্বতন সীমান্ত রক্ষী বাহিনীর প্রধান রুস্তমজীর মাধ্যমে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সাথে তাজউদ্দীন আহমদের সাক্ষাতের ব্যবস্থা (৪ এপ্রিল, ১৯৭১) করিয়ে দিয়েছিলেন। বাংলাদেশ সরকার গঠনে সর্বাত্মক সহযোগিতা প্রদান করেছিলেন।

তাজউদ্দীন আহমদের সাথে ঘনিষ্ঠ ভাবে কাজ করতে যেয়ে তিনি ও তাঁর মত অনেকেই আবিষ্কার করেছিলেন এক বিশ্বমাপের নেতাকে ; প্রথম বাংলাদেশ সরকারের রূপকার ও সংগঠক, মুক্তিযুদ্ধের পরিচালক ও প্রধানমন্ত্রীর পদবী ও পদের চাইতেও আকাশছোঁয়া মানবিক চেতনা ও আত্মমর্যাদা বোধ সম্পন্ন এক বিনম্র মানুষকে; সাধারণের ভিড়ে এক অসাধারণকে।

তাজউদ্দীন আহমদ গোলোক মজুমদারকে বলেছিলেন যে ভারত যদি সার্বভৌম রাষ্ট্ররুপে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি না দেয় তিনি রিফিউজি ক্যাম্পে চলে যাবেন এবং সেখান থেকেই মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করবেন। ইন্দিরা গান্ধীকে বলেছিলেন যে স্বীকৃতি ব্যতীত সার্বভৌমত্তের বন্ধুত্ব হয়না। তাঁরা যৌথ চুক্তি করেছিলেন যে স্বীকৃতির পরেই ভারতীয় সহায়ক বাহিনী মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে বাংলাদেশে প্রবেশ করবে এবং যেদিন বাংলাদেশ সরকার মনে করবে সহায়ক বাহিনীর দেশে থাকবার প্রয়োজন নেই,সেদিনই ভারতীয় বাহিনী প্রত্যাহার হবে।  ১৯৭১ সালের ঐ চুক্তি অনুসারেই ১৯৭২ সালের মার্চ মাসে ভারতীয় সেনা বাহিনী প্রত্যাহার হয়। ভিন্ন রাষ্ট্রে আশ্রয় ও তার সহযোগিতা গ্রহনের পরেও প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশের মর্যাদা ও স্বাধীনতা রক্ষায় তাজউদ্দীন আহমদের দূরদর্শী পদক্ষেপ ও বিচক্ষণতা বাংলাদেশের ইতিহাসের এক গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়। যুদ্ধ বিধ্বস্ত নবজাত বাংলাদেশের অর্থমন্ত্রী হিসেবেও তিনি প্রতিনিয়ত লড়েছেন বাংলাদেশকে পরনির্ভরশীলতা থেকে মুক্ত করে স্বয়ংসম্পূর্ণ ও বৈষম্যমুক্ত রুপে গড়ে তুলতে।

তাজউদ্দীন আহমদেরই সমবয়সী গোলোক মজুমদার ( জন্ম ৮জুলাই, ১৯২৫), যিনি নিজেও   ছিলেন এক অসাধারণ গুনী, বিনম্র, ইতিহাস চিহ্নিত ব্যাক্তিত্ত এবং বাংলাদেশের দুঃসময়ের বন্ধু। এবছরেই তাঁর নব্বইতম জন্ম বার্ষিকীর মাত্র দুদিন আগেই, ৬ জুলাই চলে গেলে্ন‌ অমর্ত্যলোকে। তার সাথে শেষ দেখা ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে কলকাতায়। সে সময় “তাজউদ্দীন আহমদ নেতা ও পিতা”বইটির  জন্যে ও মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে তিনি আমাকে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়েছিলেন। বইটি প্রকাশ হবার পর তিনি বইটি  পড়ে তাজউদ্দীন আহমদ সম্পরকে তাঁর সৃতিচারনা ও অভিব্যাক্তি নিজ হাতে লিখে তাঁর কন্যার মাধ্যমে আমাকে পাঠিয়েছিলেন যা ছিল ব্যাক্তিগত এবং ঐতিহাসিক আঙ্গিকে এক পরম পাওয়া। তাঁর লেখা থেকে উদ্ধৃতি দেয়া হল।

“তাজউদ্দীন সাহেবের  সঙ্গে আমার পরিচয় একাত্তরের সেই রক্তঝরা মুক্তিযুদ্ধের সময় থেকে। স্থির চিত্ত স্বল্পভাষী এই মানুষটির ব্যাক্তিত্ত ছিল অসাধারণ। তাঁর সত্যনিষ্ঠা ও স্বার্থত্যাগ সবরকম  ষড়যন্ত্র ও প্রতিকূলতা কাটিয়ে একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা সম্ভব করেছিল।–যার নাম বাংলাদেশ। বঙ্গবন্ধুর প্রতি তাঁর আস্থা ও আনুগত্য ছিল অকপট ও অবিচল...। বইটিতে কোন অত্যুক্তি নেই, নেই কোন উচ্ছাস। প্রতিটি ছত্রে তাজউদ্দীন সাহেবের উজ্জ্বল উপস্থিতি অনুভব করি।”

১৯৪৮ সালের ৩০ জানুয়ারী মহাত্মা গান্ধীর হত্যাকাণ্ডর পরদিন বাইশ বছরের তরুন রাজনৈতিক কর্মী ও শিক্ষার্থী শোকাহত তাজউদ্দীন দিনলিপির পাতায় লিখেছিলেন “সূর্য অস্তমিত হোল। এবং অস্তমিত হোল মানবতার পথের দিশারী আলোক বর্তিকা। তাহলে কি অন্ধকার নেমে এল? আলো এবং অন্ধকার। অন্ধকার এবং আলো। .....মেঘাছন্ন আকাশ। তারপরে তো সূর্যের কিরন। ক্ষীণতনু নতুন চন্দ্র। কিন্তু তারপরে তো আনন্দময় পূর্ণ চন্দ্রের আবির্ভাব। হতাশার শেষ তো আশাতে। ........ যে মানুষটির শোকে আজ আমরা মুহ্যমান,সে মানুষটিতো অন্ধকারের দীর্ঘপথ অতিক্রম করে আলোতে পৌঁছেছিলেন। তাঁকেও তো অন্ধকারে আলোর অন্বেষণে উদ্বিগ্ন হতে হয়েছে। অথচ কি বিস্ময়! তিনি নিজেই তো ছিলেন একটি আলোক বর্তিকা। আলোক কে কি তুমি ধ্বংস করতে পার? আলোর কনিকা আমাদের কাছ থেকে বহু দূরে অবস্থিত হতে পারে। কিন্তু তাতে কি? ধ্রুবতারার দূরত্ব অকল্পনীয়। কিন্তু বিজন মেরুতে অভিযানকারীর সেইতো একমাত্র দিক নির্ধারক। যুগ থেকে যুগে। ”

দিনলিপিটি লেখার  সময় তরুন তাজউদ্দীন জানতেন না যে একদিন তার কাঁধে  ন্যস্ত হবে বাঙ্গালীর মুক্তিযুদ্ধ  পরিচালনার দায়িত্ব। ঘাতকের গুলীতে প্রাণদান করে তিনিও অমরত্ব লাভ করবেন। রুপান্তরিত হবেন পথ নির্ধারক আলোক বর্তিকায়।

আমার সুগভীর বিশ্বাসের  কথাটি আবারও উল্লেখ করি। বাংলাদেশ একদিন তার নিজস্ব প্রয়োজনেই খুঁজে নেবে তাজউদ্দীনকে। তাঁর জ্যোতির্ময় জীবন ধারার অনির্বাণ আলোয় শিশুরা খুজে পাবে মুক্তির পথ। [সংকলিত]