বগুড়ায় মাদকসেবীরা ইয়াবার বিকল্প হিসেবে যা নিচ্ছে!

স্টাফ রিপোর্টার
প্রকাশ: ০৮ ফেব্রুয়ারি ২০২১ ১০:৪৭ ।
প্রচ্ছদ
পঠিত হয়েছে ৪৬১ বার।

চামেলী বেগম (ছদ্মনাম)। বয়স পনের বছর। থাকার নিজস্ব কোন বসতবাড়ী নেই। কোন সময় রেল স্টেশনে কখনও বা চকসূত্রাপুর হাড্ডিপট্রি এলাকায় সরকারি পরিত্যাক্ত জায়গায় ঝুপড়ি ঘর করে মায়ের সঙ্গে বসবাস করে। দিনের বেলায় কাগজ পলিথিনসহ নানা ধরনের পরিত্যাক্ত দ্রব্য সামগ্রী কুড়িয়ে তা জড়ো করে বিক্রি করে ভাঙ্গারী দোকানে। এতে দিনে আয় হয় গড়ে ২’শ টাকা। এই টাকার মধ্যে থেকে ১’শ টাকা দিয়ে এক পিস ট্যাপেন্টাডল গ্রুপের টেবলেট কিনে মাদক হিসেবে নেশা করে।

মাহবুব আলম (ছদ্মনাম) নামে এক কিশোরের সঙ্গে চামেলী বেগমের ভাব ভালবাসা আছে। সতের বছর বয়েসি মাহবুব আলমের পেশাও একই। তবে মাহবুবের আয় দিনে গড়ে ৩’শ টাকা। সে কাগজ কুড়ানোর পাশাপাশি কুলি শ্রমিকের কাজও করে। সন্ধায় কাজ শেষে কখনও বা দুপুরে দু’জন চকসুত্রাপুরের একটি সরকারী পরিত্যাক্ত ঘরে একত্র হয়ে ট্যাপেন্টাডল গ্রুপের ট্যাবলেট কিনে জনমানুষের অগোচরে গোপনে নেশা করতে থাকে। এভাবেই চলছে তাদের প্রায় তিন বছর। তাদের এই মাদকাসক্তের সঙ্গে যুক্ত আছে আরও একাধিক কিশোর-কিশোরী,যুবক এমনকি শিশুরাও।

মাহবুব আলম বলেন,আগে এই ট্যাবলেট এক পাতার (১০টি) দাম ছিল ৭০ টাকা। এক বছরে দাম বাড়তে থাকে। এখন হয়েছে প্রতি ট্যাবলেট ১’শ টাকা। সব দোকানে পাওয়া যায়না। চামেলী ও মাহবুবের সঙ্গে কথা বলে এসব জানা যায়। তবে কোথায় থেকে তারা এই ট্যাবলেট কেনে তা বলতে নারাজ তারা।

মাহবুর আরও জানায়, প্রতিদিন টাকা জমিয়ে এক সঙ্গে এক পাতা কখনও ২ পাতা কিনে সপ্তাহব্যাপী নেশা চালিয়ে যায় তা দিয়ে। অন্যদের কাছেও এই টেবলেট পিস হিসেবে বিক্রি করে মাহবুব। যে পদ্ধতিতে হেরোইন ও ইয়াবা টেবলেট সেবন করা হয়,ঠিক একই পদ্ধতিতে ট্যাপেন্টাডল ট্যাবলেটও সেবন করা হয়।


খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ব্যাথা নাশকের জন্য ব্যবহার করা হতো (জেনেরিক নাম ট্যাপেন্টাডল) ট্যাপেন্টাডল গ্রুপের এই ওষুধ। বাজারে এর চাহিদা যেমন ছিল তেমনি এর কার্যকারিতাও ছিল বেশ ভাল। এটি শুধু চামেলী-মাহবুবের মতো নিম্নশ্রেনীর মাদকাসক্তদের মধ্যে এর ব্যবহার সীমাবদ্ধ নেই। অভিযোগ রয়েছে, ট্যাপেন্টাডলের গ্রাহক উচ্চ ও মধ্যবিত্ত পরিবারের মাসদকাসক্তরাও আছে। কোন কোন স্থানে এটি বেশ চড়া দামেও বিক্রি হচ্ছে। প্রতি পাতা তিন হাজার টাকা দামেও বিক্রির অভিযোগ আছে।

বগুড়া সদরের স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা.সামির হোসেন মিশু বলেন, ব্যাথানাশক ওষুধ হিসেবে ট্যাপেন্টাডল গ্রুপের এই ওষুধ বেশ কার্যকর ছিল বিধায় এর চাহিদাও ছিল ব্যাপক, কিন্তু এই ওষুধের অপব্যবহার করায় চিকিৎসকরা এটি আর প্রেসক্রাইপ করেননা।

এদিকে একাধিক নামী-দামী ওষুধ কোম্পানী এই ওষুধ উৎপাদন করে আসছিল। এটি মাদকাসক্তরা নেশা হিসেবে ব্যবহার করতে শুরু করায় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের সুপারিশের পরিপ্রেক্ষিতে প্রায় দেড় বছর আগে এর উৎপাদন ও বিক্রি বন্ধ করে ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তর। কিন্তু তারপরেও এটি মাদকাসক্তরা কিভাবে পাচ্ছে, কারা বিক্রি করছে আর কোন কোন কোম্পানী এখনও উৎপাদন করছে তা নিয়ে নানা প্রশ্ন ছড়িয়ে আছে। এটি বিক্রি না করতে এক বছর আগে জেলা পুলিশের পক্ষ থেকেও জেলার ওষুধের দোকানীদের সর্তক করা হয়। 

আরও অভিযোগ রয়েছে, কিছু ওষুধ ব্যবসায়ী এই ওষুধের উৎপাদন নিষিদ্ধ করার প্রাক্কালে কিনে মজুত করে রেখেছিল তা গোপনে বিক্রি করছেন চড়াদামে। আবার কিছু ওষুধ ব্যবসায়ী গোপনে বিভিন্ন কোম্পানীর নাম ব্যবহার করে নকল হিসেবে এটি তৈরি করে গোপনে বাজারজাত করছেন।

বগুড়া জেলা ড্রাগিষ্ট এন্ড কেমিষ্ট সমিতির সহ সভাপতি জিয়াউল হক বাবলা বলেন, ট্যাপেন্টাডল গ্রুপের এই ওষুধ জেলার দোকানীদেরকে বিক্রি করতে দেড়বছর আগেই সমিতির তরফ থেকে নিষেধ করা হয়েছে, তারপরেও কোন দোকানী গোপনে বিক্রি করে থাকলে এক্ষেত্রে সমিতি তার জন্য দায়ী নয়।

ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তর বগুড়ার সহকারী পরিচালক শরীফুল ইসলাম স্বীকার করেন তার নিকটও দোকানীর বিরুদ্ধে ট্যাপেন্টাডল বিক্রির অভিযোগ রয়েছে। তিনি বলেন, মাদক হিসেবে ব্যবহার করায় এই গ্রুপের ওষুধ অনেক আগেই উৎপাদন ও বিক্রয় নিষিদ্ধ করা হয়েছে। তবুও গোপনে বিক্রি করছে বলে জানতে পেরেছি অচিরেই এ বিষয়ে অভিযান শুরু করা হবে।