করোনা থামাতে পারেনি বগুড়ার ঐতিহ্যবাহী পোড়াদহের মেলা

আব্দুল আউয়াল ও আকতারুজ্জামান সোহাগ
প্রকাশ: ১০ ফেব্রুয়ারি ২০২১ ১২:৩৪ ।
প্রচ্ছদ
পঠিত হয়েছে ৬২৫ বার।

প্রতি বছর মাঘের শেষ বুধবারেই বগুড়ায় বসে ঐতিহ্যবাহী ‘পোড়াদহের মেলা’। এবার করোনাকালেও তার ব্যতিক্রম ছিল না। সূর্যোদয়ের পর থেকেই বুধবার মেলামুখী সব সড়কে মানুষের ঢল নামে। শহর থেকে পূর্ব দিকে প্রায় ১৪ কিলোমিটার দূরে বসা প্রাচীন এই মেলায় শুধু বগুড়ারই নয় আশ-পাশের কয়েক জেলার মানুষ ভিড় করেন। প্রতি বছরের মত এবারও তাদের সবার দৃষ্টি ছিল নানা প্রজাতির বড় বড় মাছের দিকে। এরপর তারা ভিড় করেন মাছসহ নানা ফলের আকৃতির মিষ্টির দোকানে। খাট ও সোফাসহ কাঠের নানা আসবাবের দোকানগুলোতেও কেনা-কাটায় ব্যস্ত ছিলেন অনেকে।

পোড়াদহের মেলাটি একদিনের হলেও আশ-পাশের গ্রামে জামাই উৎসব চলে তিনদিন। মেলায় ওঠা বড় মাছ আর হরেক মিষ্টান্ন দিয়ে আপ্যায়নের পাশাপাশি উপহার হিসেবে তাদের জন্য কেনা হয় কাঠের আসবাব। আজ (বৃহস্পতিবার) ওই স্থানেই বসবে ‘বউ মেলা’। সদ্য বিবাহিত নারী অর্থাৎ নতুন বউদের জন্য চুড়ি, ফিতা ও কানের দুল এবং ইমিটেশনের গহনাসহ রূপচর্চার নানা সামগ্রীতে ঠাসা থাকবে দোকানগুলো। পোড়াদহের মেলা উপলক্ষ্যে বাবার বাড়িতে নাইওরে আসা মহিলা এবং স্থানীয় নববধুরাই ‘বউ মেলা’র প্রধান ক্রেতা।

প্রবীণদের বর্ণনা মতে প্রায় দেড়শ’ বছর আগে পোড়াদহ এলাকায় আশ্রয় নেওয়া এক হিন্দু সন্যাসীর স্মরণে সেখানে প্রতি বছর মেলার আয়োজন চলে আসছে। সনাতন ধর্মের বিশ্বাস মতে ওই সন্যাসী যে মরা বটগাছের নিচে আশ্রয় নিয়ে ছিলেন দীর্ঘ সাধনার পর সেটি আবার জীবিত হয়। এজন্য ওই স্থানটি হিন্দু স¤প্রদায়ের কাছে আজও পূজনীয়। সে কারণে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের কাছে মেলাটি সন্যাস মেলা নামেও পরিচিত।

পোড়াদহের মেলায় এবার সবচেয়ে বড় মাছটি ছিল বাঘাইড়। যার ওজন ছিল ৬৫ কেজি। মেলার পাশে রাণীরপাড়া এলাকার শুকুর সাকিদার ক’দিন আগে যমুনা নদীর বঙ্গবন্ধু যমুনা সেতুর নিচ থেকে ধরেছেন। প্রতি কেজি ১ হাজার ৫০০ টাকা হিসেবে মাছটির দাম হাঁকলেও বিক্রি হয়েছে ১ হাজার ১৫০ টাকা কেজি দরে। এছাড়া রুই, কাতলা, মৃগেল, ব্রিগেড, চিতল, সিলভার কাপ এবং বোয়ালসহ অর্ধশত প্রজাতির মাছ কেনা-বেচা হয়েছে।

মেলায় এবারও মাছ আকৃতির ছয় কেজি ওজনের ‘রুই মিষ্টি’ তৈরী করেন গাবতলীর সৈয়দ আহম্মেদ কলেজ স্টেশন এলাকার ব্যবসায়ী আব্দুর রাজ্জাক। প্রতি কেজি ৩০০ টাকা হিসেবে বড় ওই মিষ্টির দাম ধরা হয়েছে ১ হাজার ৮০০ টাকা। আব্দুর রাজ্জাক জানান, মেলা উপলক্ষ্যে তিনি বিভিন্ন রকম মাছের আকৃতির মিষ্টি তৈরি করেছেন। 

বাবা-মার সঙ্গে গতকাল মেলায় গিয়েছিলেন বগুড়া বিয়াম মডেল স্কুল ও কলেজের শিক্ষার্থী মীম আফরোজ। এক সঙ্গে অনেকগুলো বড় মাছ আর বিশাল সাইজের মিষ্টি দেখে সে দারুণ খুশি। মীম বলে, ‘এত্ত বড় মাছ আর  মিষ্টি আগে কখনও দেখিনি। মেলাটা অনেক মজার।’ জয়পুরহাট থেকে আসা  আবু তালেব নামে এক ব্যক্তি বলেন, ‘কয়েক বছর ধরেই আমি বগুড়ার পোড়াদহের মেলায় আসছি। এবার করোনা সত্তে¡ও এসেছি। বড় বড় মাছ আর মিষ্টি দেখতে খুব ভাল লাগে। তবে আগের মত জ্যন্ত মাছ আর দেখিনা। এখন ফ্রিজে রাখা মাছ আনা হয়।’ 

মেলার পার্শ্ববর্তী গোলাবাড়ি এলাকার আসমা খাতুন বলেন, ‘ঈদে দাওয়াত না করলেও জামাইরা মন খারাপ করে না কিন্তু মেলায় না ডাকলে তারা কষ্ট পায়।’ মেলা সংলগ্ন রাণীরপাড়া এলাকার প্রবীণ ব্যবসায়ী আব্দুল জলিল মÐল জানান, বুধবার একদিনের মেলা শেষে কাল  বৃহস্পতিবার মেলা প্রাঙ্গণে বসবে বউ মেলা। 

মেলার আয়োজক কমিটির সদস্য আবু হাসান জানান, করোনা সত্তে¡ও এবার মেলায় মানুষের কমতি ছিল না। অন্যান্য বারের মতই সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত হাজার হাজার মানুষ কেনা-কাটা করতে এসেছেন। তিনি বলেন, ‘সামাজিকভাবে এই মেলার গুরুত্ব অনেক বেশি। কারণ এই মেলাকে ঘিরেই ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে এ অঞ্চলের সব শ্রেণি পেশার মানুষ ভেদাভেদ ভুলে উৎসবের রঙে রঙিন হয়ে ওঠে। যা ঈদ কিংবা পূজাতেও দেখা যায় না।’