আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের ‘খোয়াবনামা’য় বর্ণিত কাতলাহার বিলের পাশেই আয়োজন
বগুড়ার ঐতিহ্যবাহী পোড়াদহ মেলায় ৭০ কেজি ওজনের বাঘাইড় মাছ
অরূপ রতন শীল ও মুজাহিদুল ইসলাম জাহিদ
‘মেলায় যাইরে.. মেলায় যাইরে..’ গানটি শুনলেই মন চনমনিয়ে ওঠে। যান্ত্রিকতার এ যুগে গ্রাম্য মেলার ঐতিহ্য যেন হারিয়ে যাওয়ার পথে। তবে বগুড়ার ঐতিহ্যবাহী পোড়াদহের মেলা তার জৌলুস এখনও ধরে রেখেছে। ঢাক ঢোল না পিটলে কি হবে! মুখেমুখে জেনেই মানুষের উপচে পড়া ভীড় থাকে মেলা প্রাঙ্গণে।
বুধবার সারাদেশে পহেলা ফাগুন পালিত হলেও সনাতনী পঞ্জিকা মতে ওইদিনটি ছিল মাষের শেষ দিন। প্রতি বছর মাঘের শেষ বুধবারেই বগুড়ায় বসে ঐতিহ্যবাহী ‘পোড়াদহের মেলা’। এবারও তার ব্যতিক্রম ছিল না। সূর্যোদয়ের পর থেকেই গতকাল মেলামুখী সব সড়কে মানুষের ঢল নামে।
শহর থেকে পূর্ব দিকে প্রায় ১৪ কিলোমিটার দূরে বসা প্রাচীন এই মেলায় শুধু বগুড়ারই নয় আশ-পাশের কয়েক জেলার মানুষ ভিড় করেন। প্রতি বছরের মত এবারও তাদের সবার দৃষ্টি ছিল নানা প্রজাতির বড় বড় মাছের দিকে। এরপর তারা ভিড় করেন মাছসহ নানা ফলের আকৃতির মিষ্টির দোকানে। খাট ও সোফাসহ কাঠের নানা আসবাবের দোকানগুলোতেও কেনা-কাটায় ব্যস্ত ছিলেন অনেকে।
পোড়াদহের মেলাটি একদিনের হলেও আশ-পাশের গ্রামে জামাই উৎসব চলে তিনদিন। মেলায় ওঠা বড় মাছ আর হরেক মিষ্টান্ন দিয়ে আপ্যায়নের পাশাপাশি উপহার হিসেবে তাদের জন্য কেনা হয় কাঠের আসবাব। বৃহস্পতিবার ওই স্থানেই বসবে ‘বউ মেলা’। সদ্য বিবাহিত নারী অর্থাৎ নতুন বউদের জন্য চুড়ি, ফিতা ও কানের দুল এবং ইমিটেশনের গহনাসহ রূপচর্চার নানা সামগ্রীতে ঠাসা থাকবে দোকানগুলো। পোড়াদহের মেলা উপলক্ষ্যে বাবার বাড়িতে নাইওরে আসা মহিলা এবং স্থানীয় নববধুরাই ‘বউ মেলা’র প্রধান ক্রেতা।
প্রবীণদের বর্ণনা মতে প্রায় দেড়শ’ বছর আগে পোড়াদহ এলাকায় আশ্রয় নেওয়া এক হিন্দু সন্যাসীর স্মরণে সেখানে প্রতি বছর মেলার আয়োজন চলে আসছে। সনাতন ধর্মের বিশ্বাস মতে ওই সন্যাসী যে মরা বটগাছের নিচে আশ্রয় নিয়ে ছিলেন দীর্ঘ সাধনার পর সেটি আবার জীবিত হয়। এজন্য ওই স্থানটি হিন্দু সম্প্রদায়ের কাছে আজও পূজনীয়। সে কারণে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের কাছে মেলাটি সন্যাস মেলা নামেও পরিচিত।
বোরো আবাদের কারণে এবার স্থান পরিবর্তন করে বরেণ্য কথা সাহিত্যিক আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের বিখ্যাত উপন্যাস ‘খোয়াবনামা’য় উল্লেখিত কাতলাহার বিলের পাশের নিচু জমিতে মেলার আয়োজন করা হয়। তবে স্থান পরিবর্তন করা হলেও মেলায় মানুষের সমাগম কমেনি এতটুকু। ঐতিহাসিক কাতলাহার বিলের পাশে আয়োজন করায় এবারের মেলায় আসা স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থী, সাংবাদিক ও কবি-সাহিত্যিকদের কাছে আখতারুজ্জামান ইলিয়াস যেন প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছিলেন। যদিও খোয়াবনামায় বর্ণিত সেই কাতলাহার বিল শুকিয়ে এখন ধান ক্ষেতে পরিণত হয়েছে কিন্তু তাতেও আগ্রহের কমতি ছিল না সাহিত্য প্রেমীদের। অনেকে মেলায় প্রবেশের মুহুর্তে নয়তো ফেরার সময় ওই বিলের পাশে দাঁড়িয়ে সেলফি তুলেছেন।
পোড়াদহের মেলায় এবার সবচেয়ে বড় মাছটি ছিল বাঘাইড়। যার ওজন ছিল ৭০ কেজি। মেলার পাশে গোলাবাড়ি এলাকার বিফল মণ্ডল মাছটি ক’দিন আগে বগুড়ার সারিয়াকান্দিতে যমুনা নদী থেকে ধরেছেন। মেলা উপলক্ষ্যে ক’দিন জিইয়ে রেখে গতকাল মেলায় এনেছিলেন। প্রতি কেজি ১ হাজার ৫০০ টাকা হিসেবে মাছটির দাম হাঁকেন ১ লাখ ৫ হাজার টাকা। তবে দুপুর পর্যন্ত একক ভাবে কেউ সেটি না কেনায় পরে তিনি সেটি কেটে বিক্রি করেন। তবে পাশের দোকানে ওঠা শরফাত আলীর কাছ থেকে ৪০ কেজি ওজনের বাঘাইড় মাছটি ৪৬ হাজার টাকায় কিনেছেন নওগাঁর ব্যবসায়ী মোসারব হোসেন। পোড়াদহ মেলায় প্রথম আসার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আমি এই মেলার কথা অনেক শুনেছি। এখানে অনেক বড় বড় মাছ পাওয়া যায়-এমন কথা শোনার পরই আমি এসেছি এবং ওজনের দিক থেকে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বড় মাছটিই আমি কিনেছি। খুব ভাল লাগছে।’
মেলায় বাঘাইড়ের পাশাপাশি রুই,কাতলা, মৃগেল, ব্রিগেড, চিতল, সিলভার কাপ এবং বোয়ালসহ অর্ধশত প্রজাতির মাছ কেনা-বেচা হয়েছে। সাইজ অনুযায়ী প্রতি কেজি রুই ২০০ থেকে ২৫০টাকা, কাতলা ৩০০ থেকে ৩৫০ টাকা, ব্রিগেড ৩০০ থেকে ৩৫০ টাকা এবং বোয়াল মাছ বিক্রি হয়েছে ৮০০ থেকে ১ হাজার টাকায়। তবে মেলায় মাছের ক্রেতার চেয়ে দর্শক বেশি ছিল। অনেকে মোবাইল ফোনে ছবি সংগ্রহ ছাড়াও সেলফি তুলেছেন। এছাড়া মাছ এবং বিভিন্ন ফল আকৃতির বড় বড় মিষ্টিও ভোজনরসিকদের জিহ্বায় জল এনেছে। প্রতি কেজি মিষ্টি ২০০ থেকে ৩০০ টাকায় বিক্রি হয়। ৮ কেজি ওজনের একটি মাছ আকৃতি মিষ্টি বিক্রি হয় ৫ হাজার টাকায়।
মেলায় আরও ছিল কুল (বরই), নানা ধরনের আচার, কৃষি সামগ্রী, গরু, মহিষ ও খাসির গোশত, পিঁয়াজ ও মরিচসহ মশলাজাতীয় দ্রব্য। শিশুদের বিনোদনের জন্য মেলায় ছিল মোটরসাইকেল খেলা, সার্কাস, যাদু ও নাগরদোলা। এছাড়া কাঠ-বাঁশ ও মাটির তৈরি খেলনা-পুতুলসহ রঙ- বেরঙের বেলুনও ছিল।
বাবা-মার সঙ্গে গতকাল মেলায় গিয়েছিলেন বগুড়া বিয়াম মডেল স্কুল ও কলেজের শিক্ষার্থী নাফিস আব্দুল্লাহ। এক সঙ্গে অনেকগুলো বড় মাছ আর বিশাল সাইজের মিষ্টি দেখে সে দারুণ খুশি। নাফিস বলে, ‘এত্ত বড় মাছ আর মিষ্টি আগে কখনও দেখিনি। মেলাটা অনেক মজার।’ সিরাজগঞ্জ থেকে আসা ইসমাইল হোসেন নামে এক ব্যক্তি বলেন, ‘গেল পাঁচ বছর ধরে আমি বগুড়ার পোড়াদহের মেলায় আসছি। বড় বড় মাছ আর মিষ্টি দেখতে খুব ভাল লাগে। তবে আগের মত জ্যন্ত মাছ আর দেখিনা। এখন ফ্রিজে রাখা মাছ আনা হয়।’
মেলার পার্শ্ববর্তী গোলাবাড়ি এলাকার আছিয়া সুলতানা জানান, মেলা উপলক্ষ্যে জামাইদের দাওয়াত দেওয়া বাধ্যতামূলক। তিনি বলেন, ‘ঈদে দাওয়াত না করলেও জামাইরা মন খারাপ করে না কিন্তু মেলায় না ডাকলে তারা কষ্ট পায়।’ মেলা সংলগ্ন রাণীরপাড়া এলাকার প্রবীণ ব্যবসায়ী আব্দুল জলিল ম-ল জানান, বুধবার একদিনের মেলা শেষে বৃহস্পতিবার মেলা প্রাঙ্গণে বসবে বউ মেলা।
বগুড়া লেখক চক্রের সভাপতি ইসলাম রফিক পোড়াদহের মেলাকে এ অঞ্চলের মানুষের ‘প্রাণের মেলা’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেন, ‘আমাদের এই গ্রামীণ মেলাগুলো বাঙালি সংস্কৃতিরই একটি অংশ। পোড়াদহের মেলার জৌলুস হয়তো আগের মত নেই কিন্তু তারপরেও মেলাটিকে ঘিরে এ অঞ্চলের ঘরে ঘরে আনন্দ-উৎসব ছড়িয়ে পড়ে। তবে এবার স্থান পরিবর্তন করে মেলাটি কাতলাহার বিলের পাশে আয়োজন করায় এবার আমাদের সাহিত্য প্রেমীরা আখতারুজ্জামান ইলিয়াসসে স্মরণ করেছেন। তার উপন্যাস খোয়াবনামায় বর্ণিত সেই বিলটিকে চোখ ভরে দেখেছেন।’
মেলার আয়োজক পোড়াদহ সার্বজনীন পূজা কমিটির সাধারণ সম্পাদক শঙ্কও কুমার রায় জানান, সামাজিকভাবে এই মেলার গুরুত্ব অনেক বেশি। কারণ এই মেলাকে ঘিরেই ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে এ অঞ্চলের সব শ্রেণি পেশার মানুষ ভেদাভেদ ভুলে উৎসবের রঙে রঙিন হয়ে ওঠে। যা ঈদ কিংবা পূজাতেও দেখা যায় না। তিনি মেলাটিকে আগের স্থানে আয়োজনের দাবি জানিয়ে বলেন, ‘সেখানে আমাদের যে মন্দির রয়েছে আমরা চাই সেখানেই মেলাটি হোক।’