বগুড়া সদর থানা পুলিশ যেভাবে উদ্ধার করলো জোহাকে

পুণ্ড্রকথা রিপোর্ট
প্রকাশ: ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ ০৯:৫৭ ।
প্রচ্ছদ
পঠিত হয়েছে ৬৫৬ বার।

[‘মানুষ সামাজিক জীব’- এটা সবার জানা। একজনের সহযোগীতায় অন্যরা পাশে দাঁড়াবে- ছুটে যাবে। অন্যকে বাঁচাতে প্রয়োজনে নিজের জীবনটাও উৎসর্গ করতে দ্বিধা করবে না- এমন গুণাবলী রয়েছে বলেই মানুষের উপাধি হয়েছে ‘আশরাফুল মাখলুকাত’ বা সৃষ্টির সেরা জীব। কিন্তু আজকাল অপরের বিপদ দেখে তাকে উদ্ধারে এগিয়ে যাওয়া তো দূরের কথা বরং দেখেও না দেখার ভান করা এমনকি মুখ ফিরিয়ে নেওয়ার ভয়ঙ্কর এক প্রবণতা তৈরি হয়েছে মানুষ নামক জীবের মধ্যে। 

এমন পরিস্থিতিতে আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থায় যত পেশা রয়েছে তার মধ্যে সুযোগ পেলেই যাদের প্রতি আমরা আমাদের সব ঘৃণা উগলে দিই- উর্দি পরা সেই মানুষগুলোকেই যখন দেবদূতের ভূমিকায় দেখা যায়- তখন ‘লজ্জা’ নামের অনুভূতিটাকেও যেন নতুন করে খুঁজতে হয়। বলছি একদল পুলিশ সদস্যের কথা। বগুড়া সদর থানার বেশ পরিচিত মুখ হয়ে উঠেছেন এসআই সোহেল রানা। যিনি সম্প্রতি একটি অপহরণ মামলার রহস্য উযঘাটনসহ মূল ভিমটিমকে জীবিত উদ্ধার করেছেন। 

যা তিনি নিজের ফেসবুক অ্যাকাউন্টে লিখে শেয়ার করেছেন। পুণ্ড্রকথার পাঠকদের জন্য এসআই  সোহেল রানার লেখাটি হুবহু তুলে ধরা হলো]

 

''বৃহস্পতিবার রাত্রী অনুমান পৌনে নয়টা। ক্লান্ত শরীরে আমি চেয়ারে মাথা রেখে হাত দুটি উঁচু করে ফেসবুক প্রোমটের কাজ করছিলাম। হঠাৎ সদর সার্কেল, সনাতন চক্রবর্তী স্যার এর ছবি আমার মোবাইলে ভেসে উঠল সাথে ক্রিং ক্রিং শব্দ আর কল। আমি মস্তকটা নামিয়ে কল রিসিভ করে সালাম দিতেই তিনি তাঁর অফিসে ডাকলেন। আমি অফিসে গিয়ে স্যালুট দিলাম। স্যারের টেবিলের সামনে দাঁড়িওয়ালা এক ভদ্রলোক দেখলাম। স্যার আমাকে বেশি সময় না দিয়ে বললেন ইনার এক আত্মীয়কে আটক রেখে মুক্তিপণ চাচ্ছে। দেখেন, উদ্ধার করতে হবে। স্যারের সমীহ ভাষাগুলো আমাকে কাজের স্পৃহা দিল। দাঁড়িওয়ালা লোক সাথে পনের বিশজন বাইরে দাঁড়িয়ে। আমিও তাকে একা আমার চেম্বারে ডাকলাম। সকল বিষয়গুলো শুনলাম। একটা ডায়রীতে কথাগুলো লিখে রাখতে একটুও ভুল করলাম না। আমি অপহৃত ভিকটিম আবুল হাসানাত জোহা এর বাবাকে ডাকলাম। তার বাবা আসল হাউমাউ করতে করতে । জোহার মোবাইল ফোন দিয়েই আসামীরা জোহার বাবার সাথে কথা বলছে আর একলক্ষ টাকা মুক্তিপন দাবী করছে। সাথে লাঠি দিয়ে শপাং শপাং মারছে। টাকা না পেলে জোহাকে মেরে ফেলা হবে। জোহার বাবার আর্তনাদ দেখে আমি নিজেই পাগল প্রায়। আমি বাচ্চা হারানো বাবার কস্টটা বুঝি। এরকম অনেক বাবার আহাজারি দেখেছি। আসামীরা টাকার জন্য দুটি বিকাশ নম্বর দিল। আমি নিজেই আসামীদের সাথে কথা বললাম। ফেসবুকে কাজ করতে গিয়ে কিছু অভিজ্ঞতা হয়েছে তা প্রয়োগ করতে লাগলাম। কাজ হলো না। ওসি স্যারকে বললাম, স্যার আমাকে বের হতে বললেন। আমার সাথে এএসআই এনামুল, এএসআই আশরাফুল, জহুরুল, সঙ্গী ফোর্স আর জোহার এক আত্মীয়কে নিয়ে বের হলাম সিএনজি যোগে । প্রথমে তিনমাথা, তারপর পুরান বগুড়া, তারপর আজিজুল হক কলেজ। কিন্তু কিছুতেই কাজ হলো না। আমি ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসছি প্রায়। নিরাশ হয়ে এবার আসামীদের হাইয়ার এন্টিবায়টিক দিতে লাগলাম মোবাইল ফোনে। ( তদন্তের স্বার্থে বলছি না ঔষুধের নাম)। আসামীরা ক্যাত করে গিলে নিল আমার ঔষধটা। টাকা এক লাখই দিব। আমরা টাকা নিয়ে অপেক্ষা করছি তিনজন এল টাকা নিতে। তাগড়া শুয়োরের মত চেহারা ওদের। তারা আসলে আমি জালটা বিছিয়ে দুজনকে ধরতে পারলেও একজন পালিয়ে যায়। আমি ওসি স্যারকে জানালাম স্যার মুল আসামী গ্রেফতার। স্যার বললেন" গুড! ভিকটিম উদ্ধার করেন।" আমি আসামীসহ ভিকটিম উদ্ধারে নামলাম। ধৃত আসামী আমাদের যেদিক দিয়ে নিয়ে গেল তাতে ভয়ে বুক ধুকধুক করতে লাগল। প্রথমে একটা বড় বাঁশঝাড়। আমি আস্তে আস্তে পা ফেলাচ্ছি। পায়ের নিচে বাঁশের পাতা শপশপ করছে। এভাবেই পা টিপে টিপে সামনের দিকে এগুচ্ছি। কিছুদুর যেতেই আশরাফুলের চিৎকার! সাপে কেটেছে। আমি মোবাইলের আলোতে উনার কাটা জায়গা দেখলাম। সেখান থেকে তখনও রক্ত ঝড়ছে। আমি কাটার সাইজ দেখেই বুঝলাম, সাপ নয় কঞ্চিতে কেটেছে। কিন্তু আমরা পিছু হঠতে রাজি নয়। বাঁশ বাগান পার হতেই দেখি একাটা গোরস্থান। আসামী জিন্নাহ বলল, স্যার এখানেই আমি ওদের রেখে গেছি। ভিকটিম জোহা সাথে দশ বার জন আসামী। আমরা এলাকা তন্ন তন্ন করে খুঁজলাম। জোহাও নাই, নাই আসামীরাও। এনামুল সাইডে গেলেন। আমার মন মনে ভয় হচ্ছিল। আমি ভাবলাম জোহাকে কি তারা মেরে ফেলেছে কিনা? জোহা নাই কেন? জোহা কই? এখন আমার মাথা কাজ করছে না। এখন আমি আর আসামী পাই বা না পাই জোহাকে চাই। হঠাত পাশ থেকে জহুরুল চিৎকার দিল। স্যার এদিকে আসেন। আমরা দৌড়ে গেলাম। রাত্রী সাড়ে তিনটা গড়িয়ে শীতের রাত আধার ঘুটঘুটে। নিথর শরীরে বাঁশ ঝাড়ের নিচে পড়ে আছে একটা জলজ্যান্ত মানুষের শরীর। এ কি জোহা? নাকি অন্য কেউ? চিনার উপায় নাই। জোহার আত্মীয় বলছে এই তো আমাদের জোহা। জোহার শরীরের উপর হালকা শিশির। ঠান্ডায় কাঁপছে। উঠে দাঁড়ানোর শক্তি নাই। আশরাফুল জোড় করে ধরে দাঁড় করালেন। সে ভয়ে তখনও কাঁপছে। আমরা পরিচয় দিলেও তার ভয় যাচ্ছে না। তাকে ধরাধরি করে হাসপাতালে নেয়া হলো। ঘটনাটি ওসি স্যারকে জানালাম স্যার আমাদের ধন্যবাদ দিলেন। সার্কেল স্যারকে জানালাম তিনি আইনী পরামর্শ দিলেন। মামলা হলো। সকাল হতে না হতেই কিছু তদবীর। আমি নাছোড় বান্দা। কোন তদবীরের কাজ নাই। এজাহার হল, আসামী জেলখানায়। ভিকটিমের জবানবন্দি ১৬৪ ধারা মোতাবেক ম্যাজিস্ট্রেটের নিকট লিপিবদ্ধ করার ব্যবস্থা করতে করতে বিকেল পাঁচটা বাজলো বলব না। কারন তখন সোয়া পাঁচটা। আমি সেলিম হোটেলের সামনে দাঁড়িয়ে কেক কলা খেয়ে বাসায় ফিরে দিলাম ঘুম। ঘুম থেকে জেগে থানায় অন্যান্য কাজ সেরে বাড়ি ফিরতে ফিরতে রাত্রী সাড়ে তিনটা। ঘুম থেকে উঠেই আপনাদের সাথে শেয়ার করলাম এ পোস্টটি।''