রেশমা [পঞ্চম পর্ব]

সাজিয়া আফরিন সোমাঃ
প্রকাশ: ৩০ জুলাই ২০১৮ ১৬:৪৭ ।
শিল্প ও সাহিত্য
পঠিত হয়েছে ৭৪৮ বার।

সালেহার বিয়ের দিন ভীষণ বৃষ্টি ছিলো। শ্রাবন মাস,চারিদিকে পানি আর পানি। বৃষ্টির ভিতরই সবাই মিলে সকালে হলুদ মাখিয়ে নেচে গেয়ে তাকে গোসল করিয়ে লাল পেড়ে হলুদ শাড়ি পরিয়ে দিলো। বর্ষাকাল তাই চাচী খালারা বললো "মেন্দি য্যান দেসনা সালে,আষাঢ়-সাওন মাসোত মেন্দি দিলে সাপে কাটলে আর বিষ নামানা যাবি না"। তাই তো!! চারিদিকে পানিতে ভরে গেছে,সাপের উপদ্রব বেড়ে গেছে অনেক, তাই আর মেহেদি পরা হয়নি সালেহার। দুই হাত-পা ভরে আলতা দিয়ে দিলো বোনেরা।


বর যাত্রীরা সব এলো গরুগাড়ি করে। সবগুলা গাড়ি জড়ি আর বিভিন্ন রং এর কাগজের ফুল দিয়ে সাজানো। পালকি সাজিয়ে এনেছিলো সালেহার জন্য। সেই সময় কলকাতা থেকে আনা জামছিলা রং এর বিয়ের শাড়ি,কাঁচের চুড়ি আর সাথে মোটা ভারী ভারী সোনার বালা। পুরা গলা জুরে হার, টিকলি, টায়রা, বাজু,হাতপদ্ম,নোলক,কোমরে বিছা আরও কত কিছু! সবাই বলাবলি করছিলো " সালের কপাল দেকচু!আজআনীর লাকান লাগিচ্চে,কপাল দেক!!!!" সালেহার কানেও যাচ্ছিলো কথাগুলা।


যার সাথে বিয়ে সেই পাত্রকেই দেখেনি সালেহা। বাবা বলেছিলো "মা আমার উপর ভরসা রাখিস"।সালেহা ভরসা করে বাবাকে,জানে বাবা তার জন্য সব চেয়ে ভালো কিছুই আনবে। খালাতো,মামাতো বোনেরা বর দেখে এসে বললো " বুবু দুলাভাই প্যায়া তুমি তো আমাকেরেক আর মনে থুবানা"?


সবাই বলছে জামাই নাকি রাজপুত্র। সবাই বর-কনেকে দেখতে ভির জমিয়েছে। আয়নায় মুখ দেখা-দেখির এক ফাঁকে সালেহা রইসের দিকে তাকিয়েছিলো। ২৬ বছরের যুবক,গায়ের রং বেশ পরিষ্কার,সত্যিই আকর্ষনীয় চেহারার যুবক সে,যার এ বয়সেই অনেক নাম ডাক। সালেহা শুনেছে পাখি শিকারের খুব নেশা তার। সুযোগ পেলেই বন্দুক হাতে রইস পাখি শিকারে বের হয়। সে সব শুনে সালেহা মনে মনে যেমন চেহারা কল্পনা করে রেখেছিলো রইস তার চেয়েও সুদর্শন!


পালকিতে চড়ে যাচ্ছে সালেহা। বহু দূরের পথ,সে যেনো আর শেষ হয় না! রাত হয়ে গেছে,একটা জায়গায় এসে সবাই দাঁড়ালো। নদীর পাড়,পরে জেনেছে ওটা নাগর নদী। বর যাত্রীরা সবাই গরু গাড়ি থেকে নেমেছে নদী পার হতে হবে তাই। সালেহা পালকি থেকে মাথা বের করে দেখেই চমকে উঠলো!!! এ কেমন সাঁকো? অন্ধকারে যা চোখে পরলো তাতে সে দেখলো ভরা নদী। তার উপর দুইটা বাঁশ দিয়ে সেতু তৈরি আর ধরার জন্য একটা বাঁশ। সালেহার ভয়ে বুক কেঁপে উঠলো। সে তাড়াতাড়ি পালকি থেকে নেমে পরলো,পালকি করে সে সেতু পার হবে না কিছুতেই। শেষে ওর পায়ের জুতাজোড়া খুলে কে যেনো হাতে নিলো আর সে রইসের হাত ধরে বহু সময় নিয়ে ধীরে ধীরে নদী পার হলো। কেউ কেউ ডোঙায় করে নদী পার হলো। সালেহার জন্য নৌকা রাখা ছিলো কিন্তু মাঝি জানালো পাড়ে ওঠার জায়গাটা খুব পিচ্ছিল হয়ে গেছে একটু আগের বৃষ্টিতে তাই নতুন বৌ কোন ভাবেই উঠতে পারবে না। তাই শেষে হ্যাজাকের আলোয় বাঁশের সাকো দিয়ে নদী পার হলো ওরা। অনেকেই সেদিন সালেহার অবস্থা দেখে হেসেছিলো। সালেহার বাবা বাড়ির কয়েক মাইলের ভিতর কোন নদী নাই। তাই এ রকম সাঁকো পার হয়নি সে আগে।


এর পর আবার পালকি করে রওনা আর বাকী সবাই হেঁটে চললো। বাড়ির সামনে গ্রামের সব বউ-ঝি রা হাতে হারিকেন,বাতি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে বউ দেখবে বলে।


হাকিমের বউ এর ডাকে ভাবনার ঘোর কাটে সালেহার।" মামী ভিতরে চলেন,আন্ধারেত বস্যা আছেন ক্যা"? সালেহা চমকে উঠে! তাই তো অন্ধকার কেনো? আজ বাড়ি হবে আলো ঝলমলে,কোন অন্ধকার থাকবেনা। এই তোরা সব বাতি জ্বলা,হ্যাজাক,হারিকেন জ্বলা। নতুন বউ আসবে তোরা কি ভুলে গেছিস?


আজও খাঁ বাড়ির সামনে বউ-ঝি রা অপেক্ষা করছে কখন নতুন বউ আসবে? শিরিন,বকুল,লুতফা কে দিয়ে সালেহা বউ এর ঘর সাজিয়ে নিয়েছে। কলকাতা থেকে আনা নতুন চাদর বিছিয়ে দিয়েছে ওদের জন্য। ময়না ভাবী- সোলাইমান ভাই এর বউ,সেতো বলেই বসলো- " সালে তোর গোষ্টিত কেউ ব্যান পাগলা আচলো,না হলি তুই পাগলী হলি ক্যাংকারা? কেউ ছোল ছোল করে এ্যাংকা কাজ করে তা হামি বাপের জন্মে শুনি নি"।


সালেহার কিছু শুনতে মন চাচ্ছে না,কারো কথা কানে গেলেও মাথায় যাচ্ছে না। সে শুধু দূর কালো অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে ওদের অপেক্ষা করছে।


দূর থেকে মিট মিট আলো দেখা যাচ্ছে। সালোহা প্রায় চিৎকার দিয়ে বলে উঠলো-" হাস্না নানী দেকো দেকো,আলো দেকা যাচ্চে। কুদ্দুসরে পাঠাও ওদের আলো ধরুক,ও ময়না ভাবী আম্মকে ডাকেন,কন ছোট বউ আসিচে"।


লাইলী সব শুনতে পাচ্ছে,কিন্তু তার উঠার কোন ইচ্ছা নাই,সে সালেহার সামনে গিয়ে ছোট বউকে বরণ করে ঘরে তুলতে পারবে না,এতো বড় পাষাণ সে হতে পারবে না। লাইলী ঘুমের ভান করে শুয়ে আছে।


ময়না- "ও চাচী ওটেন,ছোটবউ আচ্চে,ডালা কুলা সাজান আচে খালি নামালেই হবি"


"সালে এ্যাংকা কাম করলো যে খাঁ বাড়ির নামই লষ্ট হয়্যা গেলো। কত শক আচলো আপনের সালেক লিয়া সিডাও থুব্যার পারলো না,বউরাই সংসার লষ্ট করে "।


লাইলী আর চুপ থাকতে পারলো না,উঠে বসতে বসতে বললো-" ময়না? শোন মা তোর তো বয়স কম হয়নি! কতাবার্তা এন্যা সামাল দিয়া কস্। স্বভাব বদল কর,তোর ও বেটা আছে,বেটি আছে। "


"সালেহা ডাকলে কস্ আজ আর উঠবার পারমু না, শরীরডা খারাপ-খারাপ লাগিচ্চে"


ময়না মুখ কালো করে ঘর থেকে বের হয়ে গেলো। বর যাত্রীরা দরজার কাছে এসে দাঁড়িয়েছে। হাস্না নানী সাজানো ডালা হাতে নিয়ে সালেহার পাশে দাঁড়িয়ে আছে,সালেহা আজ নিজের বাজু আর হাতপদ্ম দিয়ে সুফিয়াকে নামাবে। (চলবে)