চোরাবালী

অসীম কুমার কৌশিকঃ
প্রকাশ: ৩১ জুলাই ২০১৮ ১১:১৪ ।
শিল্প ও সাহিত্য
পঠিত হয়েছে ৫৯১ বার।

বৃদ্ধ সোমনাথ ঢুলতে ঢুলতে বাজারের ব্যাগ নিয়ে আসছিলো রাস্তার পাশ দিয়ে। তার বয়স সংসার কে ছেড়ে দিলেও সংসার এখনো তাকে ছাড়তে পারে নি। তাইতো এই বৃদ্ধ বয়সেও বাড়িতে পাশ করা শিক্ষিত ছেলে থাকতেও তাকে বাজারের ব্যাগ বহন করতে হয়। ছেলে ছাড়াও ছেলের বউ, নাতি-নাতনি রয়েছে। অনেক আগেই তার সহধর্মিণী জ্বরে পরে তাকে ছেড়ে চলে যায়। ব্যাগ নিয়ে আসতে আসতে হঠাৎ থমকে দাঁড়ায় সোমনাথ। তিনি দেখেন এক বৃদ্ধা মহিলা রাস্তার পাশে গাছতলায় বসে কাপছে। এগিয়ে গিয়ে বুঝতে পারেন মহিলাটি অন্ধ। ব্যাগে থাকা নাতি-নাতনির জন্য খাবার থেকে কিছু খাবার দিয়ে দিলেন অই বৃদ্ধা মহিলাকে। এভাবে রোজ তিনি যাওয়ার পথে খাবার দিয়ে যান। কিন্তু হঠাৎ একদিন তার ছেলের বউ নিশিতা নাথ দেখে ফেলেন ঘটনাটি। তার পর থেকে সোমনাথকে আর কখনো বাজারের ব্যাগ হাতে আসতে দেখা যায় নি। আরে সোমনাথ না! বলেই লাফিয়ে উঠলো সোমনাথের হরনাথ নামের এই বন্ধু। একি অবস্থা হয়েছে তোর? দাড়ি ভর্তি মুখ আর এমন বড় বড় চুল, তোকে তো প্রথমে চিনতেই পারিনি। আর সাথে এই কি সেই বৃদ্ধা মহিলাটি। কি যেন নাম! মোছা: কুলসুমা, বলল সোমনাথ। এই শেষ বয়সে কি দরকার ছিলো ভাই এসবের বলে একপ্রকার ক্ষোভ এর নিশ্বাস ফেলল হরনাথ মশায়। সোমনাথ মুচকি হাসলেন সঙ্গে কয়েক ফোটা অশ্রুপাত ও হলো। যে অশ্রুর ভাষা সৃষ্টিকর্তা ছাড়া কেউ বুঝতে পারল না। আহা ওদিকে না বলে কুলসুমা কে নয়ে বাস থেকে নামলো সোমনাথ। হরনাথ মশায় এদের দিকে জানালা দিয়ে তাকিয়ে ছিলেন যতদূর পর্যন্ত দেখা যায়। 

কুলসুমা ভিক্ষে করে পাওয়া তার হাতের টাকাগুলো সোমনাথকে দিয়ে বলল কত হইছে?তখন সোমনাথ গুনে দেখলো ৩০ টাকার মতো।এভাবে তারা দুজন ভিক্ষে করে কোনো রকমে বেঁচে আছে।বস্তিতে ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা নেমে আসে।ছোট্ট একটা কুটিরে থাকে ওরা। এ বস্তির কেউ ওদের সাথে মেশে না কথা বলে না।দুজন দুই জাতি বলে।রাতে ভাত আর আলু ভর্তা তাদের রোজকার খাবার।সোমনাথ একটা থালে খাবার নিয়ে যায় কুলসুমার কাছে।তারপর কুলসুমাকে খাইয়ে দেয় এবং নিজেও খায়।খাওয়া শেষ হলে সুয়ে পরে।নিস্তব্ধ রাত ঝিঝি পোকার শব্দ আর জোৎস্নার আলো বাঁশের বেড়াকে ফাকি দিয়ে ওদের মখে এসে পড়ে।কুলসুমা কাঁদতে কাঁদতে বলে আমার নিজের মেয়ে আমায় বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছে আমি অন্ধ বলে।আর তুমি বিতাড়িত হয়েছো এই অন্ধকে সহানুভূতি দেখিয়ে।আর কত অপরাধী হব?সোমনাথের অশ্রুসিক্ত চোখে আজও ভাসে সেই দিনের ঘটনা।সেদিন বাজার থেকে বাড়িতে এলে ছেলের বউ এর এক প্রশ্নের মুখে পড়েছিলো সে।ঐ বৃদ্ধার সাথে আপনার কিসের এত ভাব যে রোজ রোজ খাবার দিতে হয়?এখানেই থেমে থাকে নি নিশিতা। বিপ্রনাথ ( সোমমাথের ছেলে) রাতে এলে নিশিতা ওকে এমন ভাবে সব বলে যে ছেলের মনে বাবার প্রতি ঘৃণা জন্মায়।পরদিন সোমনাথকে বাড়ি থেকে বের করে দেওয়া হয়।তারপর থেকে সে কুলসুমাকে নিয়ে এই বস্তিতে আসে।কুলসুমা এখানেই থকতো। সকলেই উৎসুক চোখে দেখতে থাকে কুলসুমার হাত ধরে রেখে পথ দেখানো এই মানুষটিকে।যখন সবাই জানতে পারে মানুষটি অন্য জাতের তখন থেকেই কুলসুমা আর সোমনাথ সমাজ থেকেও বিতাড়িত হয়।

আজ হঠাৎ সোমনাথ বলে উঠলো বলোতো তোমার সাথে আমার এতো ভাব কিসের?কাঁদোকাঁদো গলায় কুলসুমা হেসে উঠলো এমন কথা শুনে।তুমিও পারো বটে এ কেমন রসিকতা!কুলসুমা জানো আমার ছেলের বউ এর সেদিনের সেই প্রশ্নের উত্তর আজ আমি পেয়ে গেছি।তোমার সাথে আমার এত ভাব কিসের?আমাদের জাত, ধর্ম আলাদা অথচ আমাদের এতো ভাব কিসের? আমাদের দুজনের বড্ড মিল কোথায় জানো আমরা দুজনই পরিবার নামক রীতি থেকে বিতাড়িত, আমরা সমাজ নামক সংস্কার থেকে বিতাড়িত। তাই আজ আমাদের একটাই ধর্ম সেটা জীবিকা ধর্ম।জীবিকার জন্য আজ আমরা বিতাড়িত দুটি প্রাণ এক হয়ে আছি আর থাকবো। আর এজন্যই তোমার সাথে আমার এতো ভাব।বলে হুহু করে কেঁদে উঠে সোমনাথ। এভাবেই দিন কাটছিলে ওদের।হঠাৎ একদিন সকালে সোমনাথকে কাঁদতে দেখে লোকজন ভিড় জমালো।কুলসুমার নিথর দেহটি মাটতে পরে আছে।রাতে ঘুমের মধ্যেই হয়তো নতুন কোনো অচেনা দেশে হারিয়ে গেছে সে।সোমনাথের কানে এলো লোকজন বলা বলি করছিলো এ লাশ কবর দিতে দেবো না, কেউ কেউ বলছিলো এ লাশ পুড়তেও দেবো না। এসব শুনে পলকহীন চোখে তাকিয়ে কুলসুমার মুখপণে চেয়ে আছে সে।সকাল গড়িয়ে সন্ধ্যা হলো। সোমনাথ উঠে ঘরে গেলো ইঁদুর মারা বিষের প্যাকেট দেখে কুলসুমার সেই কথাটা আবার কানে বেজে উঠলো।ইঁদুর বেটারা খুব জ্বালাচ্ছে একটু বিষ নিয়ে এসো তো, ভয় নেই আমি খাবো না।কুলসুমা ওর কথা রেখেছে তাই সোমনাথ সেই বিষগুলো পরম যত্নে মুখে পুরে বাহিরে এলো।কুলসুমাকে কাধে নিয়ে নদীর ধারের ব্রিজে উঠলো।বিষ কাজ করতে শুরু করেছে টলতে টলতে কুলসুমাকে জড়িয়ে থাকা সোমনাথ হাওয়ায় ভাসতে থাকলো।ক্ষণিক পর জলের আওয়াজ পাওয়া গেলো।অবহেলিত দুটি প্রাণ অবশেষে মাতার গহ্বরে হারিয়ে গেলো।