রেশমা [ষষ্ঠ পর্ব]

সাজিয়া আফরিন সোমাঃ
প্রকাশ: ০১ অগাস্ট ২০১৮ ০৫:০৩ ।
শিল্প ও সাহিত্য
পঠিত হয়েছে ৬৩৫ বার।

বউ নামানোর কাজ শেষ,সালেহা শাশুড়ির ঘরের দিকে যাচ্ছে সুফিয়াকে নিয়ে। শাশুড়ি বউ এর মুখ না দেখে ঘুমাবে তা কি করে হয়!

অন্ধকার ঘরে শুয়ে আছে লাইলী। দরজা খুলে সালেহাকে হারিকেন হাতে দাঁড়াতে দেখলো লাইলী।

সালেহা- আম্মা ছোট বউ আসছে আপনার দোয়া নিতে।

সালেহা সুফিয়াকে ইশারায় বললো সালাম করতে। পায়ে হাত দিয়ে সালাম করতেই লাইলী উঠে বসলো। মাথায় হাত রেখে বললো- "দোয়া করি সুখে থাকো। সালেহা আমার খালি বউ না আমার মাইয়াও,সে তোমাক বড় শখ কইরা এই বাড়িত আনছে। খাঁ বংশে এড্যাই প্রত্থম কারো দুই বিয়া। খালি বউ এর ইচ্চাই এড্যা হলো। তুমি ছোট মানুষ,বড় বউ তোমার বোইন,ওর মতো কইরা চলবা। ও তোমারে যে ভালোবাসা দিছে সেডা সব সময় মনে রাখবা। তোমার কাচে আমার আর চাওয়ার কোন কিচু নাই।

সুফিয়া দুই দিকে মাথা নেড়ে সম্মতি জানালো। সালেহা এবার সুফিয়াকে বারান্দায় নিয়ে গেলো,সেখানে সবাই বসে আছে,বউ বাপের বাড়ি থেকে ননদ,জা দের জন্য কি কি আনছে সেগুলা দেখা হবে,দুধে আলতা মিশিয়ে আংটি খোঁজাবে। আর সব শেষে বর-বউ এর মাথায় পানি ঢেলে দিবে। এটাই এদিকের নিয়ম। সালেহা এসবে থাকবে না,কারন রইসকে ও থাকতে হবে নতুন বউ এর সাথে,সেখানে সালেহার থাকাটা শোভন দেখায় না।

সবাই খুঁজছে রইস কে। রইসকে দেখা যাচ্ছে না কোথাও। সে মাঝ পাথে বলেছে আমি কাজ সেরে আসি তোমরা যাও,তার পর থেকে এখনও ফিরেনি। সালেহা ওর মনের অবস্থা জানে তাই নিয়মগুলা শুরু করতে তাড়া দিয়ে সে দেখতে গেলো কাল ছোট বউ এর বাপের বাড়ির মেহমান আসবে তাদের খাবারের আয়োজন কতদূর।

অনেক রাত হয়ে গেছে,সব কাজ কর্ম শেষ। রইস এখনও ফিরেনি। সালেহা সবাইকে ঘুমাতে পাঠিয়ে সুফিয়ার কাছে গেলো। ক্লান্তিতে মেয়েটার মুখ ছোট হয়ে আছে।

সালেহা- সুফিয়া আমি উনাকে জানি,যত রাতই হোক বাড়ি ফিরবেন। তুই একটু শুয়ে থাক,আমি তোর ঘরের দরজার কাছেই বসে থাকবো উনি না আসা পর্যন্ত,তুই ভয় পাসনা। ঘরের হারিকেন এর আলো কম করে দিয়া গেলাম, দরকার হলে বুবু বলে ডাকিস আমি উঠে আসবো।

সালেহা রইস এর ঘরের দরজার কাছে রাখা জলচৌকি তে বসে আছে। রইস আসবে যত রাতই হোক,তাই সালেহা ঘুমাই গেলে কে খুলে দিবে? সালেহা জেগে থাকবে।

সালেহা যেদিন এই বাড়িতে এসেছিলো সেদিন সকাল থেকে খুব বৃষ্টি ছিলো। রাতে আকাশ একেবারে পরিষ্কার। রইস ঘরে এসে একটা বই নিয়ে বসলো। কিছুক্ষণ এদিক ওদিক করে সালেহার দিকে তাকালো। সালেহা বিছানায় বসে আছে,তার চেহারায় অজস্র প্রশ্ন।

রইস- আমি বই পড়ি,পাখি শিকার করি এগুলা আমার শখ। আমি মাঝ রাতে পুকুর পাড়ে বসে আকাশ দেখি। এটা হয়ত তোমাকে কষ্ট দিবে,তবে আমি এরকমই।

সালেহা মাথা নেড়ে আচ্ছা বলার চেষ্টা করলো। এর পর সালেহাকে ঘুমাতে বলে রইস বের হয়ে গেলো ঘর থেকে। হাস্না নানী এসে বসলো সালেহার কাছে।

হাস্না - "শোন মা তুই তো লতুন বৌ তাই জানিস না। ছোল হামাকের খুবই ভালো। এখন মা এর কাছে গেলো,মা এর সেবা না করে ঘুমাবে না। মা এর ওষুধ-বড়ি খিলাবে,মাথাত হাত দিয়া দিবে,মাও ঘুমাবি তার পর ছোল এ্যাসা শুতপি। তুই ভয় করবু তাই হামি আনু এটি।"

সালেহা বিয়ের আগে তার সম্পর্কে যা শুনেছে আর সকাল থেকে যা দেখছে তাতে শুধু মুগ্ধই হচ্ছে। সালেহা নিজেও বই পড়তে ভালোবাসে। বাবা যখনই কোন কাজে ঢাকা যেতো সালেহার জন্য বই আনতো। সালেহা রাত জেগে আকাশ দেখতে ভালোবাসে। এখন এই মানুষটার সাথে বসে সে আকাশ দেখবে!

সালেহা জলচৌকিতেই ঘুমিয়ে পরে। দরজায় ধাক্কানোর শব্দে লাফিয়ে উঠে দেখে ফজরের আযান হচ্ছে। তাড়াতাড়ি উঠে দরজা খুলে দেয়। হায় আল্লাহ ছোট বউ কি বুঝতে পারলো নাকি যে রইস সারারাত বাড়ি ছিলো না? কেনো এমন করলো মানুষটা!!

দরজায় দাঁড়িয়ে রইস।

সালেহা- আপনার না হয় রাগ আমার উপর তাই বলে ওই মেয়েটার সাথে এমন করবেন? একা একা ঘুমাইছে নতুন জায়গায়!  

রইস- কেনো তার বড় বোন তো সর্বদা তার ছায়া হয়ে থাকবে বলে কথা দিয়েছে,তাহলে একা হয় কি করে?

সালেহা- থাক সে কথা,আপনি ঘরে যান, আজ নতুন মেহমান আসবে,বাহির বাড়িতে রান্না শুরু হলো কিনা দেখে আসি।

রইস- রান্নার জোগার করছে,একটু পর শুরু হবে। আমি ওখান থেকেই ফিরলাম।

সালেহা- বিষ্ময় নিয়ে লোকটার দিকে তাকালো। তার মানে সারারাত বাহির বাড়িতেই ছিলো?

সালেহা আজ নিজ হাতে চালের রুটি বানাবে। রইস তার হাতের চালের রুটি আর হাঁসের মাংস খুব পছন্দ করে। তারপর সুফিয়াকে যত্ন করে সাজাবে নিজের সব গহনা দিয়ে। আজ সুফিয়াকে নিয়ে যাবে সাথে রইসও যাবে, তার গোছগাছ করে দিতে হবে। আর এ বারের মতো সব করে দিবে এরপর সব দায়িত্ব সুফিয়াকে বুঝিয়ে দিবে সালেহা।

সালেহার বিয়ের একদিন পর বাবার বাড়ির লোকজন পাঁচকুটমিতে এসেছিলো। রইস -সালেহার জন্য একটা সাজানো গরুরগাড়ী নদীর ওপারে ছিলো। বাড়ি থেকে পালকি করে নদীর পাড়ে। এবার আর বাঁশের সাঁকো দিয়ে নদী পার হতে হয়নি, নৌকায় নদী পার হয়ে গাড়ীতে উঠেছিলো।

সারা পথ দুইজন কত কথা বলেছিলো। রবীন্দ্রনাথ আর বঙ্কিম দুজনেরই প্রিয়। দেবী চৌধুরানী,কৃষ্ণকান্তের উইল তাদের দীর্ঘ পথকে যেনো আনন্দময় করে তুলেছিলো। আর সেই থেকে গড়ে উঠলো দুজন মানুষের কাছে আসা আর বোঝাপড়ার এক দারুণ বন্ধন। (চলবে)