আক্রান্ত হচ্ছেন চিকিৎসকসহ স্বাস্থ্য কর্মীরা

বগুড়ায় উপজেলাগুলোতে করোনার সংক্রমণ বেড়েছেঃ তবে নমুনা সংগ্রহের গতি ধীর

পুণ্ড্রকথা রিপোর্ট
প্রকাশ: ১৯ এপ্রিল ২০২১ ০৬:৪০ ।
প্রচ্ছদ
পঠিত হয়েছে ৭৪৮ বার।

বগুড়ায় এবার শহরের পাশাপাশি উপজেলা পর্যায়েও করোনার সংক্রমণ বেড়েছে। তবে সংক্রমণ বাড়লেও উপজেলা পর্যায়ে করোনার নমুনা সংগ্রহ চলছে ধীর গতিতে। কোন উপজেলায় সপ্তাহে দু’দিন আবার কোন কোন উপজেলায় প্রতি সপ্তাহে মাত্র একদিন নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষার জন্য তা বগুড়ায় পাঠানো হচ্ছে।
সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, উপজেলাগুলোতে নমুনা সংগ্রহ বিলম্বিত হওয়ায় গ্রাম পর্যায়ে করোনা সক্রমণের প্রকৃত চিত্র জানা সম্ভব হচ্ছে না। এভাবে নমুনা পরীক্ষা বিলম্বিত হওয়ায় উপজেলা পর্যায়ের হাসপাতালে আসা সাধারণ মানুষকে চিকিৎসা সেবা দিতে গিয়ে চিকিৎসক এবং নার্সসহ স্বাস্থ্যকর্মীরা একে একে করোনায় আক্রান্ত হচ্ছেন। সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় হলো উপজেলা পর্যায়ের হাসপাতালগুলোতে গত এক বছরেও করোনা আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসা দেওয়ার মত ন্যূনতম কোন সুবিধা সৃষ্টি করা যায়নি। ফলে জেলা সদরের হাসপাতালগুলোতে রোগীদের ভিড় বাড়ছে আর তাদের চিকিৎসা দিতে গিয়ে কর্তৃপক্ষকে হিমশিম খেতে হচ্ছে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, নমুনা সংগ্রহ করে তা পরীক্ষার জন্য বগুড়ায় পাঠানোর জন্য যে খরচ হয় তা মেটানোর জন্য স্বাস্থ্য বিভাগের পক্ষ থেকে কোন বরাদ্দ না থাকায় এই জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে। গত বছর করোনার শুরুতে অনেক এলাকায় উপজেলা পরিষদ থেকে ওই খরচ যোগানো হয়। তবে কয়েক মাস পর তা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় স্থানীয় স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মকর্তারা বিপাকে পড়ে যান। ফলশ্রুতিতে এবং নমুনা সংগ্রহ ও পরীক্ষা কার্যক্রমের গতি মন্থর হয়ে পড়ে।
জেলা স্বাস্থ্য বিভাগের হিসাব বলছে, করোনাভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা এক মাসের ব্যবধানে ১০ গুণ বেড়েছে। বৈশ্বিক ওই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু বেড়েছে ৫গুণ। আক্রান্তের মধ্যে সুস্থতাও আগের তুলনায় ৪ ভাগ কমেছে। গত ১৬ ফেব্রæয়ারি থেকে ১৬ মার্চ এবং তার পর ১৬ এপ্রিল পর্যন্ত জেলা স্বাস্থ্য বিভাগের পরিসংখ্যানে এই চিত্র উঠে এসেছে। 
চলতি বছরের ১৬ ফেব্রæয়ারি থেকে ১৬ মার্চ পর্যন্ত বগুড়ায় মাত্র ১১৪জন করোনায় আক্রান্ত হয়েছিলেন। তবে পরবর্তী এক মাসে অর্থাৎ ১৬ এপ্রিল পর্যন্ত সেই সংখ্যা ১০গুণেরও বেশি বেড়ে ১ হাজার ২০০জনে দাঁড়িয়েছে। একই সময়ের ব্যবধানে মৃত্যুর সংখ্যা ৪জন থেকে প্রায় ৫গুণ বেড়ে ১৯জনে গিয়ে ঠেকেছে। আর ১৬ ফেব্রæয়ারি থেকে ১৬ মার্চ পর্যন্ত সুস্থতার যে হার ৯৪ দশমিক ১৩ শতাংশ ছিল পরবর্তী মাসে অর্থাৎ ১৬ এপ্রিলের মধ্যে তা ২৩ দশমিক ১৬ শতাংশে নেমে আসে।
বগুড়ায় ২০২০ সালের ১ এপ্রিল প্রথম কোন ব্যক্তির শরীরে করোনাভাইরাসের উপস্থিতি ধরা পড়ে। এরপর মে মাসের শেষ দিকে করোনার সংক্রমণ বাড়তে শুরু করে যা আগস্ট পর্যন্ত অব্যাহত থাকে। সেপ্টেম্বর অক্টোবর মাসে কিছুটা কমে এলেও আবার নভেম্বরে আক্রান্তের হার কিছু বাড়তে থাকে। অবশ্য ডিসেম্বর থেকে তা কমতে শুরু করে এবং চলতি বছরের ৩০ জানুয়ারি এক পর্যায়ে তা শূণ্যে নেমে আসে। তবে মার্চের মাঝামাঝি এসে সংক্রমণ আবার বাড়তে শুরু করে। গত ২ মার্চ সংক্রমণের হার ছিল ২ দশমিক ০২। ১৬ এপ্রিল আক্রান্তের হার প্রায় ১৫গুণ বেড়ে ৩০ দশমিক ২৬ শতাংশে গিয়ে ঠেকেছে। 
করোনা সংক্রমণের চলমান দ্বিতীয় ঢেউ যে এবার জেলা সদরের বাইরে উপজেলা পর্যায়েও গিয়ে পড়েছে তার প্রমাণ জেলা স্বাস্থ্য বিভাগের পরিসংখ্যানে উঠে এসেছে। কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, জেলা সদরের বাইরে করোনার সংক্রমণ সবেচেয় বেশি শেরপুর উপজেলায় সেখানে গত বছর থেকে এখন পর্যন্ত ৪৬৯জন আক্রান্ত হয়েছে। সেখানে ১৬ এপ্রিল পর্যন্ত ১৩জন নিজ বাড়িতে চিকিৎসা নিচ্ছিলেন। তালিকায় দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে শাজাহানপুর উপজেলায়। সেখানে ৪৫৫জন আক্রান্ত হয়েছেন এবং চিকিৎসাধীন রোগীর সংখ্যা ১৫জন। এছাড়া গাবতলীতে ৩০২জন, কাহালুতে ১৯০ এবং শিবগঞ্জ উপজেলায় আরও ১৮৩জন আক্রান্ত হয়েছেন। স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, করোনা আক্রান্তদের সংখ্যা অন্য উপজেলাগুলোতেও ক্রমশ বাড়ছে।
সংশ্লিষ্ট সুত্রগুলো বলছে, উপজেলা পর্যায়ে করোনার সংক্রমণের হার আরও বেশি। কারণ হিসেবে বলা হচ্ছে যেহেতু উপজেলাগুলো থেকে প্রতিদিনের পরিবর্তে শুধুমাত্র সপ্তাহে একদিন বা দুইদিন নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষার জন্য তা জেলা সদরে পাঠানো হচ্ছে সে কারণে গ্রাম পর্যায়ের করোনার প্রকৃত সংক্রমণ পরিস্থিতি জানা সম্ভব হচ্ছে না। জেলার ধুনট উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের প্রধান উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. হাসানুল হাসিব জানান, নমুনা সংগ্রহ করে তা পরীক্ষার জন্য জেলা সদরে পাঠানোর জন্য প্রতিদিন ৩৫০ টাকা প্রয়োজন। কিন্তু তার জন্য সরকারি কোন বরাদ্দ নেই। গত বছর শুরুর দিকে প্রথম দুই মাস উপজেলা পরিষদ থেকে কিছু অর্থ সহায়তা করা হলেও এখন তা আর করা হচ্ছে না। ফলে বাজেট স্বল্পতার কারণে এখন সপ্তাহে একদিন শনিবার নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষার জন্য বগুড়ায় পাঠাতে হচ্ছে। আর পরীক্ষা কম হওয়ার কারণে করোনায় আক্রান্তদের সংম্পর্শে গিয়ে ওই হাসপাতালের ৯জন চিকিৎসক কোভিড-১৯ পজিটিভ হয়েছিলেন বলেও জানান তিনি। আদমদীঘিতে সপ্তাহে দুইদিন নমুনা সংগ্রহ করা হচ্ছে।
খোঁজ নিয়ে জনা গেছে গত বছর করোনার শুরুতে প্রতিটি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে করোনা রোগীদের জন্য ৫টি করে শয্যা প্রস্তুত রাখার কথা বলা হলেও এখন পর্যন্ত তা গড়ে তোলা সম্ভব হয়নি। কারণ হাসপাতালগুলোতে পর্যাপ্ত শয্যা থাকলেও অক্সিজেন সরবরাহ ব্যবস্থা নিশ্চিত করা যায়নি। ফলে করোনায় আক্রান্তদের চিকিৎসার জন্য জেলা সদরের হাসপাতালগুলোতে পাঠানো হচ্ছে। এ সম্পর্কে ধুনট উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. হাসানুল হাসিব বলেন, ‘আমাদের হাসপাতালে শয্যা পর্যাপ্ত রয়েছে। তবে করোনা আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসার জন্য সার্বক্ষণিক অক্সিজেন সরবরাহের যে ব্যবস্থা দরকার তা নেই। আমার হাসপাতালে প্রতি মাসে মাত্র ৫টি সিলিন্ডার দেওয়া হয়। তা দিয়ে কি করোনা রোগীদের কি চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব?
বগুড়ার ডেপুটি সিভিল সার্জন ডা. মোস্তাফিজুর রহমান তুহিন উপজেলা পর্যায়ে করোনার সংক্রমণ বৃদ্ধির কথা স্বীকার করে বলেন, স্বাস্থ্যবিধি মেনে চললে সংক্রণ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। উপজেলা হাসপাতালগুলোতে অক্সিজেন সংকট প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আমরা ৫০ শয্যার উপজেলা হাসপাতলগুলোর জন্য প্রয়োজনীয় সিলিন্ডার সরবরাহের জন্য চাহিদাপত্র দিয়েছি। আশাকরি খুব দ্রুতই সেগুলো পেয়ে যাব।’