দেশে দেশে বিমান ছিনতাইয়ের যত ঘটনা

পুণ্ড্রকথা ডেস্ক
প্রকাশ: ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ ০৮:৫৬ ।
প্রচ্ছদ
পঠিত হয়েছে ১৮৪ বার।

বিমান ছিনতাইয়ের বিশ্ব-ইতিহাসে নজর ফেরালে এর নেপথ্যে প্রেম কিংবা অরাজনৈতিক কারণের সন্ধান মেলে বটে। তবে বেশিরভাগ ঘটনার নেপথ্যে ছিল রাজনৈতিক কারণ। কখনও জিম্মি মুক্তি, কখনও আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার প্রতিষ্ঠা, কখনও আবার রাজনৈতিক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার স্বার্থে ছিনতাই করা হয়েছে বিমান। পুরুষের পাশাপাশি নারীরাও ছিলেন ছিনতাইকারীর তালিকায়।  ঘটনাগুলোর মধ্যে সবচেয়ে দীর্ঘ ছিল ১৯৬৮ সালের একটি জিম্মি দশা। এর অবসান ঘটতে সময় লেগেছিল ৪০ দিন। ইসরায়েলের বিমান সংস্থা এল আলের ফ্লাইট ৪২৬ ছিনতাই করেছিল ‘পপুলার ফ্রন্ট ফর দ্য লিবারেশন অব প্যালেস্টাইনের’ সদস্যরা। তারা ইতালির রোম থেকে বিমানটি ছিনতাই করে নিয়ে যায় আলজিয়ার্সে। সব জিম্মিকে ছেড়ে দিলেও ১২ ইসরায়েলি যাত্রী ও বিমানের কর্মীদের আটকে রাখা হয়েছিল। দেনদরবার শেষে জিম্মিদের সবাই মুক্তি পান। ছেড়ে দেওয়া হয় ছিনতাইকারীদেরও।

১৯৭০ সালে একই সংগঠনের সদস্যরা তিনটি বিমান ছিনতাই করে। যুক্তরাজ্য,যুক্তরাষ্ট্র ও সুইজারল্যান্ডের তিন বিমানে সব মিলিয়ে ছিলেন ৪০০ জিম্মি। বিমানগুলোকে নিয়ে যাওয়া হয় জর্ডানের মরুভূমি এলাকায় অবস্থিত এক এয়ারস্ট্রিপে। যাত্রীদের বেশিরভাগকেই পরে ছেড়ে দেওয়া হয়। অবশিষ্ট জিম্মিরা মুক্তি পান সাত ফিলিস্তিনি বন্দির মুক্তির বিনিময়ে।

১৯৭৬ সালে ‘পপুলার ফ্রন্ট ফর দ্য লিবারেশন অব প্যালেস্টাইনের’ সদস্যরা ইসরায়েল থেকে উড্ডয়ন করা একটি বিমান ছিনতাই করে। এয়ার ফ্রান্সের বিমানটিকে উগান্ডার এনতেবে বিমানবন্দরে অবতরণ করানো হয়। ১০৫ জিম্মির বেশিরভাগই ছিলেন ইসরায়েলি। ইসরায়েলি কমান্ডো বাহিনীর সদস্যরা অভিযান চালিয়ে জিম্মি পরিস্থিতির অবসান ঘটায়। অভিযানে সব ফিলিস্তিনি বিমান ছিনতাইকারী প্রাণ হারায়। অভিযানে প্রাণ যায় এক কমান্ডো সদস্য ও তিন যাত্রীর।

১৯৭৭ সালে লুফটহানসার একটি বিমান ছিনতাই করেছিল ফিলিস্তিনি গেরিলারা। সোমালিয়ার মোগাদিসু বিমানবন্দরে অবতরণ করা বিমানটিতে অভিযান চালায় জার্মান কমান্ডোরা। কমান্ডোদের হাতে নিহত হয় তিন ছিনতাইকারী। মুক্তি পান ৮৬ জন জিম্মি। কিন্তু ইতোমধ্যে ছিনতাইকারীদের হাতে নিহত হন বিমানের পাইলট।

১৯৮১ সালে পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইনসের একটি বিমান ছিনতাই করে নিয়ে যাওয়া হয় আফগানিস্তানের রাজধানী কাবুলে। আফগানিস্তান থেকে বিমানটি যায় সিরিয়ার দামেস্কে। ছিনতাইকারীদের সঙ্গে পাকিস্তান সরকারের দেনদরবারের পর ১৩ দিনের মাথায় মুক্তি পান জিম্মিরা। বদলে পাকিস্তান ৫০ জন বন্দিকে মুক্তি দেয় ছিনতাইকারীদের দাবি অনুযায়ী। এ ঘটনায় প্রাণ যায় এক যাত্রীর।

১৯৮৪ সালে কুয়েত এয়ারওয়েজের একটি বিমান ছিনতাই করে একজন সশস্ত্র শিয়া ব্যক্তি। বিমানটি নিয়ে যাওয়া হয় ইরানের তেহরানে। ইরানি নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা পরিচ্ছন্নতা কর্মীর ছদ্মবেশে বিমানে অভিযান চালায়। এতে নিহত হয় সংশ্লিষ্ট ছিনতাইকারী। কিন্তু এর মধ্যে প্রাণ যায় ২ মার্কিন নাগরিকের যারা বিমানের যাত্রী ছিলেন।

১৯৮৫ সালে ট্রান্স ওয়ার্ল্ড এয়ারলাইনসের একটি বিমান গ্রিসের এথেন্স থেকে ১৫৩ জন যাত্রী নিয়ে বৈরুতে যাচ্ছিল। লেবাননের একজন সশস্ত্র শিয়া ব্যক্তি বিমানটি ছিনতাই করে। ওই ঘটনার অবসান ঘটে যখন ইসরায়েল লেবাননের ৩১ জন শিয়া বন্দিকে মুক্তি দেয়।

১৯৮৫ সালে ফিলিস্তিনিরা ইজিপ্ট এয়ারের একটি বিমান ছিনতাই করে নিয়ে যায় মাল্টাতে। সেখানে মিসরীয় কমান্ডোরা অভিযান চালালে ৫৯ জন মৃত্যুবরণ করেন।

১৯৮৬ সালে প্যান অ্যাম বিমানসংস্থার একটি বিমান ছিনতাই করা হয়, যাতে ৪০০ যাত্রী ও বিমান কর্মী ছিলেন। ১৬ ঘণ্টা পর জিম্মি অবস্থার অবসান ঘটে পাকিস্তানি নিরাপত্তা বাহিনী অভিযানের মধ্য দিয়ে। সেই অভিযানে মারা যান ২২ জন।

১৯২৮ সালে কুয়েত এয়ারওয়েজের থাইল্যান্ডগামী একটি বিমান ছিনতাই করে সশস্ত্র এক শিয়া ব্যক্তি। বিমানটিকে নিয়ে যাওয়া হয় আলজেরিয়ায়। এতে যাত্রী ও বিমানকর্মী মিলিয়ে ছিলেন ১১০ জন জিম্মি। ১৬ দিন পরে জিম্মি অবস্থার অবসান ঘটে। ছিনতাইকারীকে আলজেরিয়া ছেড়ে চলে যেতে দেওয়া হয়। বদলে সে মুক্তি দেয় জিম্মিদের।

১৯৯১ সালে সিঙ্গাপুর এয়ারলাইনসের একটি বিমান ছিনতাইয়ের শিকার হয়। কিন্তু দেশটির কমান্ডো বাহিনীর অভিযানে নিহত হয় চার ছিনতাইকারীর সবাই।

১৯৯৩ সালে ইথিওপিয়ান বিমান সংস্থার একটি বিমান ছিনতাইয়ের শিকার হলে নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা অভিযান চালায়। এতে দুই ছিনতাইকারী মৃত্যুবরণ করে। প্রাণ হারান এক নারী যাত্রী।

১৯৯৮ সালে পাকিস্তানের হায়দরাবাদ বিমানবন্দরে দেশটির কমান্ডো বাহিনীর সদস্যরা অভিযান চালায় ছিনতাই হওয়া একটি বিমানে। সেটি পাকিস্তান এয়ারলাইনসেরই বিমান ছিল। অভিযানে তিন ছিনতাইকারী নিহত হয়। মুক্ত করা সম্ভব হয় ২৯ জিম্মিকে।

১৯৯৯ সালে কাশ্মিরি সশস্ত্র ব্যক্তিরা ইন্ডিয়ান এয়ারলাইনসের একটি বিমান ছিনতাই করে এবং সেটি নিয়ে যায় আফগানিস্তানের কান্দাহারে। সাত দিন ধরে চলতে থাকা জিম্মি পরিস্থিতিতে মৃত্যুবরণ করেন এক যাত্রী। পরে ভারত ছিনতাইকারীদের দাবি মেনে নিয়ে তিন কাশ্মিরি বন্দিকে মুক্তি দেয়। বিনিময়ে মুক্তি পান জিম্মিরা।

২০০০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে তালেবান শাসনের নিগড় থেকে মুক্তি পেতে কয়েকজন আফগান নাগরিক আরিয়ানা বিমানসংস্থার একটি অভ্যন্তরীণ ফ্লাইটে ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটায়। বিমানটিতে ১৬৪ জন যাত্রী ছিলেন। ছিনতাইকারীরা চেয়েছিল বিমানটিকে যুক্তরাজ্যে নিয়ে যেতে। তিন দিনের জিম্মি অবস্থার পরে তারা আত্মসমর্পণ করে।

২০০০ সালের অক্টোবর মাসে সৌদি আরবের শাসকপক্ষের মানবাধিকার হরণের বিষয়টি বিশ্ববাসীর নজরে আনতে দেশটির দুই ব্যক্তি একটি বিমান ছিনতাই করে। সৌদি আরবের সেই বিমানটিকে নিয়ে যাওয়া হয় ইরাকের বাগদাদে। সেখানে তারা কর্তৃপক্ষের কাছে আত্মসমর্পণ করে।

২০০১ সালের মার্চ মাসে সৌদি আরবের নিরাপত্তা বাহিনী ছিনতাইয়ের শিকার একটি বিমানে অভিযান চালায়। মদিনা বিমানবন্দরে সৌদি আরবের নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের অভিযানে মারা যায় ছিনতাইকারীদের একজন। সে চেচনিয়ার স্বাধীনতাকামী। বিমানটির তুরস্কের ইস্তানবুল থেকে রাশিয়ার মস্কোতে যাওয়ার কথা ছিল। বিমান ছিনতাইয়ের ওই ঘটনায় প্রাণ যায় রাশিয়ান এক বিমান কর্মী ও তুর্কি এক যাত্রীর।

২০০৩ সালের ২৯ মে ছিনতাইকারীর কবলে পড়ে কানতাস এয়ারলাইন্সের একটি বিমান। মেলবোর্ন থেকে লন্সেস্টন বিমানবন্দর অভিমুখে যাত্রা করেছিল প্লেনটি। উড্ডয়নের ১০ মিনিটের মাথায় এক ব্যক্তি এটি ছিনতাইয়ের চেষ্টা করে। তার পকেটে দুটি ধারালো কাঠের টুকরো ছিল। পরে বিমানের খাবার সরবরাহে নিয়োজিত কর্মী ও যাত্রীরা মিলে তাকে নিবৃত্ত করতে সক্ষম হয়।

২০০৬ সালের ৩ অক্টোবর আলবেনিয়ার রাজধানী তিরানা থেকে তুরস্কের রাজধানী ইস্তানবুলের উদ্দেশে যাত্রা করে তার্কিশ এয়ারলাইন্সের একটি ফ্লাইট। ফ্লাইটটিতে ১০৭ জন যাত্রী ও ছয়জন ক্রু ছিল। যাত্রাপথে গ্রিসের আকাশসীমায় হাকান ইকিঞ্চি নামের এক ব্যক্তি বিমানটি ছিনতাই করে। তবে গ্রিক বিমানবাহিনীর কাছে ছিনতাইয়ের বার্তা গেলে তাদের হস্তক্ষেপে প্লেনটি ইতালির ব্রিনদিসিতে নিরাপদে অবতরণ করে।

২০০৭ সালের ২৪ জানুয়ারি সুদানে এয়ার ওয়েস্টের একটি বোয়িং বিমান ছিনতাইয়ের কবলে পড়ে। তবে পরে এটি নিরাপদে মধ্য আফ্রিকার দেশ শাদে অবতরণ করে।

২০০৭ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি ৮৭ যাত্রী নিয়ে মৌরিতানিয়া রাজধানী নোয়াকচট থেকে স্পেনের লাস পালমাসের উদ্দেশে যাত্রা করে এয়ার মৌরিতানি-এর একটি বোয়িং বিমান। যাত্রাপথে এক ব্যক্তি বিমানটি ছিনতাই করে। সে ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসে যেতে চায়। তবে শেষ পর্যন্ত লাস পালমাসের একটি বিমান ঘাঁটির কাছে অবতরণ করে প্লেনটি। গ্রেফতার করা হয় মরোক্কান বংশোদ্ভূত ছিনতাইকারীকে।

২০০৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি নিউ জিল্যান্ডের ব্লেনহেইম থেকে দেশটির আরেক শহর ক্রাইস্টচার্চের উদ্দেশে যাত্রা করে ঈগল এয়ারওয়েজের একটি ফ্লাইট। উড্ডয়নের পর এক নারী ছিনতাইকারীর কবলে পড়ে ফ্লাইটটি। তার দাবি, ফ্লাইটটি অস্ট্রেলিয়া নিয়ে যেতে হবে। ক্রাইস্টচার্চ এয়ারপোর্টে নিরাপদে অবতরণের আগে প্লেনের উভয় পাইলট ও এক যাত্রীকে ছুরিকাঘাত করে ওই নারী। তার দাবি ছিল, বিমানে দুইটি বিস্ফোরক রয়েছে। তবে অবতরণের পর পুলিশের অনুসন্ধানে এমন কিছুর সন্ধান মেলেনি।

ভালোবাসার মানুষের কাছে বার্তা পৌঁছে দিতে ২০১৬ সালের মার্চে মিসরে ইজিপ্ট এয়ারের একটি বিমান ছিনতাই করে এক ব্যক্তি। জোরপূর্বক বিমানটি সাইপ্রাসে নিয়ে অবতরণ করানোর সময় মনে হয়েছিল এটি সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড। তবে পরে জানা যায়, ভুয়া বিস্ফোরক বেল্ট পরে বিমান ছিনতাই করা ওই ব্যক্তি আত্মসমর্পণের আগে তার সাবেক স্ত্রীকে একটি চিঠি পাঠাতে চেয়েছিলেন। সাইপ্রাসের প্রেসিডেন্ট জানান, শুধু সাবেক সাইপ্রিয়ট স্ত্রীর সঙ্গে পুনরায় সম্পর্ক স্থাপনের উদ্দেশ্যে এ কাজ করেছিল রোমিও ছিনতাইকারী।