সুখ-অসুখের বই মেলা-৪

আমির খসরু সেলিম
প্রকাশ: ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ ১৩:৪০ ।
প্রচ্ছদ
পঠিত হয়েছে ২৩০ বার।

শুয়ে আছি ফুটপাতে। গায়ে কালো চাদর, পিঠের নিচে কয়েক স্তর প্লাস্টিকের বস্তা। মাথার নিচে ডেকোরেটরের কাপড় ভাঁজ করে তৈরি করা ‘ব্যর্থ-বালিশ’। হাত বাড়ালেই ছোঁয়া যায় বগুড়ার সার্কিট হাউজের সীমানা-দেয়ালের অংশ। শহরের ব্যস্ততম সড়ক দিয়ে তখন হাজারো মানুষের প্যারেড। পরিচিতরা আমাকে দেখে থমকে দাঁড়াচ্ছেন। অবাক হচ্ছেন। প্রশ্ন ছুড়ে দিচ্ছেন, তুমি এখানে শুয়ে আছো কেন?
ছোট্ট এই বগুড়া শহর। সবুজ-সুঠাম গ্রামের মতো সবাই সবাইকে চেনে। ফলে আমাকে ঘিরে ভিড় বাড়তে লাগলো। প্রশ্নের হালকা বাতাস পরিণত হলো প্রকাণ্ড ঝড়ে। ‘তুমি এখানে শুয়ে আছো কেন?’-এই প্রশ্ন আমার গলা টিপে ধরলো। উত্তর তো দেয়া হলই না, গলার চাপ আরো বাড়লো। প্রবল অক্সিজেন-তৃষ্ণায় আমি শোয়া অবস্থা থেকে  উঠে বসলাম। ঠিক তখনই উপর থেকে মাথায় কয়েকফোটা পানি ঝরে পড়লো।
স্বপ্ন ছিলা ওটা। কিন্তু এই বাস্তবে ফিরেও কোন বিশেষ পরিবর্তন চোখে পড়ল না। কালো চাদর-প্লাস্টিকের বস্তা-ব্যর্থ বালিশ-সার্কিট হাউজের দেয়াল সবই আছে। উপর থেকে পড়া পানির ফোটাগুলি ভোরের বৃষ্টির। আমি পাগলের মতো বন্ধুদের ফোন দিতে লাগলাম, জলদি আসো, বইগুলোকে বাঁচাই…।
আহা বইমেলা। প্রবল ভালোবাসা আর প্রচণ্ড কষ্টের বইমেলা। বগুড়ার বইমেলায় সবচেয়ে অবহেলায় পড়ে থাকা বইগুলো। তোমাদের বাঁচাতে মাথার উপর থাকে না নির্ভরতা। থাকে ডেকোরেটরের পাতলা কাপড়, কালো চাদর, প্লাস্টিকের বস্তা, সার্কিট হাউজের দেয়াল আর আমার বন্ধুদের ভালোবাসা।
**
বগুড়া বইমেলার সৌন্দর্য বাড়িয়েছেন কিছু মানুষ। তারাই সম্ভবত এই মেলায় সবচেয়ে আন্তরিক মানুষ। মেলার জটিলতা-যন্ত্রণা নিয়ে তারা মাথা ঘামান না। মেলার সামনের সড়কের বেয়াড়া ধুলিও তাদের বিন্দুমাত্র দমাতে পারে না। এই মানুষগুলি অনেক কষ্ট করে তাদের রচিত সাহিত্যকর্মকে দুই মলাটের মাঝে বাঁধাই করতে পেরেছেন। এখন শুধু চান, পাঠকের সাথে তাদের সংযোগ গড়ে উঠুক। এই মানুষগুলি তাদের স্টল সাজিয়েছেন শুধুমাত্র তাদেরই রচিত বই দিয়ে!
এই তালিকায় সবচেয়ে নিয়মিত হলেন জেসমিন জামান সাথী। নতুন গল্পগ্রন্থ ‘ভালোবাসার ওপারে’ নিয়ে বসছেন মেলায়। ‘আবিরা স্টল’-এ সময় দিচ্ছেন কবি-গল্পকার সারমিন সীমা। তার সাম্প্রতিক বইটির নাম ‘নৈঃশব্দের মোহনা’। ‘উজান গাঁও’ স্টলে বসছেন কবি গোলাপ। তার নতুন বইটির নাম ‘কৃষ্ণ ঊষা’।
তবে একক স্টল হিসেবে এবারের মেলায় সবচেয়ে বড় আকর্ষণ হলো কবি-সঙ্গীত শিল্পী শামীমা নাসরিন-এর স্টল। তিনি বেড়ে উঠেছেন ঢাকার খিলগাঁও-এ, কিন্তু বগুড়ার সাথে তার একটা যোগসূত্র গড়ে উঠেছে। সবাই তাকে বগুড়ার সদ্য-আগত জেলা প্রশাসকের স্ত্রী হিসেবেই পরিচয় দেবেন। কিন্তু আমার লিখতে ইচ্ছে করছে, বগুড়ার বর্তমান জেলা প্রশাসক ফয়েজ আহাম্মদ হলেন কবি-সঙ্গীতশিল্পী শামীমা নাসরিনের স্বামী। এসব ক্ষেত্রে পোশাকী  নারীবাচক শব্দ ‘সহধর্মীনি’ ব্যবহার করা হয়, এক্ষেত্রে হবে ‘সহধর্মী’। 
বিষয়টা হয়তো আমি পরিচ্ছন্ন রম্যতায় বর্ণনা করছি। কিন্তু সত্যি কথাটা হলো, এমন সংস্কৃতিমনা দম্পতি বিরল। আমাদের বগুড়ার স্বাগতম আপনাদের দুজনকেই।