নওগাঁর ইলেকট্রিক মিস্ত্রি ইদ্রিস আলীর উদ্ভাবন

পরিত্যক্ত পলিথিন ব্যবহারে জ্বালানী পদার্থ উৎপাদন

এম আর ইসলাম রতন,নওগাঁ
প্রকাশ: ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ ০৯:৪৫ ।
প্রচ্ছদ
পঠিত হয়েছে ৮১৫ বার।

মানুষের যান্ত্রিক জীবনে জায়গা দখল করেছে পলিথিন ও প্লাস্টিক। পলিথিনের স্থায়িত্ব বেশি। সহজে পচন ও পুড়িয়ে ফেলা সম্ভব হয় না। অল্প বাজার নিয়ে সহজেই পলিথিনে বহন করা সম্ভব। কিন্তু কাজ শেষে পলিথিনের স্থান হয় ডাস্টবিনে। এতে পরিবেশও হয় নষ্ট। আর সেই পরিত্যক্ত পলিথিনকে কাজে লাগিয়েছেন নওগাঁর মান্দা উপজেলার ৫৫ বছর বয়সী ইদ্রিস আলী। পলিথিনকে বিশেষ প্রক্রিয়ায় কাজে লাগিয়ে তা থেকে তৈরি করেছেন জ্বালানি পদার্থ, গ্যাস ও ফটোকপি মেশিনের কালি।
 

ইদ্রিস আলী ওই উপজেলার ভারশোঁ ইউনিয়নের হোসেনপুর গ্রামের বাসিন্দা। ৮ম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করেছেন। অভাবের কারণে পড়াশোনার পাঠ চুকিয়ে নেমে পড়েন জীবনযুদ্ধে। নিজের জমাজমি বলতে কিছুই নেই। শ্বশুরের দেয়া সামান্য জমিতে মাটির বাড়ি। সংসারে পাঁচ ছেলেমেয়ে। তিন ছেলে ও দুই মেয়ে। মেয়েদের বিয়ে দিয়েছেন। ছেলেরা কৃষিসহ অন্যান্য কাজ করেন। স্ত্রী নুরজাহান বিবি গৃহিনী।জীবিকার তাগিদে ইদ্রিস আলী কখনো ভ্যান চালিয়েছেন আবার কখনো করেছেন কৃষিকাজ। এছাড়া ইলেকট্রনিক মিস্ত্রি, সাইকেল মেরামতেরও কাজ করেছেন। সর্বশেষ ভটভটি চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করেন তিনি।
 

ইদ্রিস আলী বলেন, 'বাড়ির আশপাশে পড়ে থাকা ময়লা পলিথিন পোড়াতে গিয়ে আমি লক্ষ্য করি পোড়া পলিথিন থেকে টপটপ করে পানির মত কিছু ঝরে পড়ছে। এ ধরণের একটি ভিডিও আমি ইউটিউব চ্যানেলে দেখেছি। বিষয়টি নিয়ে গত তিন মাস ধরে ভাবছি। এরপর সেই ভাবনাকে আমি বাস্তবে রূপদান করি। মাত্র পাঁচ হাজার টাকা খরচ করে বাজার থেকে তেলের একটি বড় টিনের ড্রাম (ব্যারেল), একটি মাঝারি প্লাস্টিকের ড্রাম, ছোট দুইটি কন্টেইনার, প্রায় ১৫ ফুট স্টিলের সরু পাইপ ও কয়েক হাত প্লাস্টিকের ফিতা কিনে কাজ শুরু করি। প্রথম প্রথম সামান্য সমস্যা হলেও তা শুধরে নিয়ে ২১ ফেব্রুয়ারি (বৃহস্পতিবার) আমি সাফল্য লাভ করেছি।' 
 

তিনি আরো বলেন, 'নোংরা ও পরিত্যক্ত পলিথিন ১০ টাকা কেজি করে তিনি টোকাইদের কাছ থেকে কিনে নেন। এরপর বিশেষ প্রক্রিয়ায় পলিথিনগুলো টিনের ড্রামে ভরে প্রায় আধাঘণ্টা ড্রামের নিচে খড়ি দিয়ে জ্বাল দেন। এরপর ড্রাম থেকে নির্গত গ্যাস স্টিলের পাইপ দিয়ে এসে প্লাস্টিকের ড্রামের মধ্যে রাখা পানিতে ঠান্ডা হয়ে পেট্রোল ছোট কন্টেইনারে জমা হচ্ছে। ৭ কেজি পলিথিন থেকে প্রায় ৫ লিটার পেট্রোল জাতীয় পদার্থ, আধা লিটার ডিজেল বের করতে সক্ষম হয়েছেন তিনি।এই পেট্রোল ইতোমধ্যে মোটরসাইকেলে জ্বালানি হিসেবেও ব্যবহার করা হয়েছে। সব খরচ বাদ দিয়ে ৬০ টাকা লিটার হিসেবে বাজারজাত করা সম্ভব বলে মনে করেন তিনি। তবে টাকার অভাবে আধুনিক যন্ত্র কেনা সম্ভব হচ্ছে না। এ জন্য সরকারের সহযোগিতা কামনা করেন তিনি।'

 

স্বল্প শিক্ষিত এ মানুষটি তার প্রতিভাকে কাজে লাগিয়ে তৈরি করেছেন জ্বালানি তেল ও বিদ্যুৎ সংযোগ ছাড়াই ওয়েল্ডিং বা ঝালাই মেশিন। তার এ প্রতিভাকে এক নজর দেখতে বাড়িতে ভিড় করছেন এলাকার সব বয়সী নারী-পুরুষ। তার এ উদ্ভাবন এলাকাজুড়ে ব্যাপক কৌতুহলের সৃষ্টি করেছে। সরকারি পৃষ্টপোষকতা পেলে তার এ প্রতিভা বিকশিত করা সম্ভব বলে মনে করছেন সচেতন এলাকাবাসি। পলিথিন থেকে শুধু জ্বালানি তেলই নয়, বিদ্যুৎ সাশ্রয়ী ওয়েল্ডিং মেশিনও (ঝালাই মেশিন) তৈরি করছেন তিনি। ১২ ভোল্টের তিনটি ড্রাইসেল (শুষ্ক) ব্যাটারি দিয়ে তৈরি এ মেশিনে প্রায় ৫০টি স্টিক ঝালাই করা সম্ভব। নিজস্ব প্রযুক্তিতে তৈরি এ মেশিনটি তৈরিতে খরচ পড়েছে প্রায় ৪২ হাজার টাকা।

চৌবাড়িয়া বাজারের মোটর মেকানিক রাসেল ও রিপন জানান, ইদ্রিস আলীর উৎপাদিত জ্বালানী মোটরসাইকেলে তুলে আমরা পরীক্ষা করেছি। এতে মোটরসাইকেল চালাতে কোনো সমস্যা হচ্ছে না বলেও দাবি করেন তারা। 

 

রোববার বিকেলে ইদ্রিস আলীর এ উদ্ভাবন দেখতে তার বাড়িতে কৌতুহলী শিশু, নারী ও পুরুষের ভিড় গিয়ে দেখা গেছে। অনেকে তার এ উদ্ভাবনে বিস্ময় প্রকাশ করেন। উপজেলার আইওরপাড়া গ্রামের ফারুক হোসেন এবং ইউনিয়ন ছাত্রলীগের সভাপতি জামাল উদ্দিন জানান, পলিথিন পরিবেশের মারাত্মক ক্ষতিসাধন করে। সেই পলিথিন পুড়িয়ে ইদ্রিস আলী জ্বালানী তৈল উৎপাদন করছেন। এতে করে একদিকে যেমন ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা পাচ্ছে পরিবেশ। অন্যদিকে উৎপাদিত হচ্ছে জ্বালানী তৈল। তার প্রযুক্তি কাজে লাগিয়ে বানিজ্যিকভাবে এর উৎপাদন শুরু করা যেতে পারে। এ জন্য সরকারি পৃষ্টপোষকতা প্রয়োজন বলে মনে করেন তারা। 
 

স্থানীয় মিজানুর রহমান, শামীম রেজা এবং ফাইজুর সোনারসহ আরও অনেকে জানান, আমরা জানতাম পলিথিন পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর। কিন্তু এ পলিথিন থেকে যে জ্বালানি তেল তৈরি করা যায় সেটা জানতাম না। নিজ চোখে না দেখলে বিশ্বাসই করতাম না।
 

মান্দা উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) খন্দকার মুশফিকুর রহমান বলেন, ইদ্রিস আলীর উদ্ভাবনের কথা শুনেছি। তবে এর কার্যকারিতা কতটা পরিবেশবান্ধব তা এই মুহুর্তে বলতে পারছি না। তবে তার এ উদ্ভাবনের বিষয়টি উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবহিত করা হবে। স্থানীয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে তাকে স্বাগত জানাই।