‘পরিবহন শ্রমিক নেতাদের ধমক দিয়ে বলুন ওরা যাতে শিশুদের সাথে যুদ্ধে না নামে’

শান্ত মাহমুদঃ
প্রকাশ: ০৩ অগাস্ট ২০১৮ ১০:১১ ।
আলোচনা
পঠিত হয়েছে ৪৫৪ বার।

একজন সাবেক ছাত্রলীগ কর্মী হিসেবে নয়,নব্বইএর গণঅভভুত্থানে পুলিশ নির্যাতনে গুরুতর আহত হয়ে দীর্ঘ ছয় মাস কারাগারে থাকা একজন নিবেদিতপ্রাণ কর্মী হিসেবেও নয়- আজ একজন বাবা হয়ে আপনার কাছে করজোড়ে আবেদন করছি, আমাদের সন্তানদের রক্ষা করুন। গত কয়েকদিন ধরে ওরা নির্দিষ্ট একটি বিষয় নিয়েই রাজপথে আছে।ওরা আপনার বিরুদ্ধে নয়,কোনো ব্যক্তি,গোষ্ঠী বা দলের বিরুদ্ধেও নয়।ওরা একটা সিস্টেমের বিরুদ্ধে,অন্যায়ের বিরুদ্ধে শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ জানিয়ে আসছে।এই প্রতিবাদের ভাষা প্রয়োগে ওদের অধিকাংশই নিয়মতান্ত্রিক ছিল।কোথাও কোথাও বিচ্ছিন্ন দুই একটি অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেছে,অস্বীকার করিনা। ওরা কোনো রাজনৈতিক দলের এজেন্ডা বাস্তবায়নেও রাজপথে ছিলনা,এখনো নেই।

কিন্তু গতকাল থেকে আমি ঘুমাতে পারছিনা আতংকে। আমার দুই ছেলে রাজনীতি সচেতন।আমার মত রাজনীতির মাঠ ওরা দাপিয়ে বেড়ায়নি ঠিকই কিন্তু, বঙ্গবন্ধু,মুক্তিযুদ্ধ আর বাংলাদেশ ওদের ভালবাসা। ছাত্র হিসেবেও ওরা ভাল। আমার মধ্যবিত্ব টানাপোড়েনের জীবনে ওরাই আশার আলো। সাম্প্রতিক এই আন্দোলনে ওদের মানসিক জরালো সমর্থনের পাশাপাশি সাময়িক শারীরিক উপস্থিতিকেও আমি নিষেধ করতে পারিনি। গতকাল মিরপুরে কে বা কারা পুলিশের সাথে সম্মিলিতভাবে ছোট ছোট এই কিশোর ছেলে মেয়েদের উপর উপর লাঠিসোটা নিয়ে আক্রমণ করেছে আমি জানি না। ওরা কোন দলের আমি জানিনা।ওরা ছাত্রলীগ, যুবলীগ, শিবির,ছাত্রদল,বিএনপি- জামাত, নাকি কুচক্রী কোনো মহল তাও জানি না। আমি শুধু ছবি দেখেছি। গতকাল এই মিছিলে বা জমায়েতে থাকতে পারেনি বলে আমার দুই ছেলের আফসোসের শেষ নেই। 

প্রতিদিন,প্রতি মুহুর্তের এই আন্দোলনে থাকার জন্যে ওদের চোখে মুখে চাপা উত্তেজনা আমি দেখেছি। গতকাল রাতে বিভিন্ন গ্রুপে ফেসবুকে ওদের সক্রীয় থাকার বিষয়টি আমাকে ভাবিয়ে তুলেছে। ওদের অনেক বন্ধু এটাকে শুধু আন্দোলন নয় হিরোইজম হিসেবেও দেখছে। আমি জানি পৃথিবীতে সঠিক নেতৃত্ব ছাড়া কোনো আন্দোলনই আলোর মুখ দেখে না। শুধু রক্ত ঝরে কিন্তু সেই রক্তের উপর সফলতার টকটকে রক্তজবা ফোটেনা। কিন্তু ওরা সেই রক্তজবার কুড়িটা দেখতে শুরু করেছিল আপনার বেশ কিছু উদ্যোগকে দেখে। 

আপনি জানেন ডিজিটাল এই যুগে মাইকিং করে কিংবা প্রেস রিলিজ দিয়ে আর ওরা নিজেদের সংগঠিত করেনা। না না ধরণের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এখন এক ঘন্টার নোটিশে এক করে দেয় ওদের। একেকটা পাড়া-মহল্লা নয়,শহর নয়,জেলা নয়,সারাদেশ নয়,পুরো পৃথিবীর নেটওয়ার্ক এখন ওদের হাতের মুঠোয়। ওদেরকে ঘরে আটকাবো কি দিয়ে?গত দুই একদিনের আন্দোলনের জোয়ার ওদেরকে আরো বেশি সাহসী করে তুলেছে। ওরা দেখেছে কিভাবে ডাকসাইটে মন্ত্রী,আমলা,পুলিশ কর্মকর্তা, নেতা, ব্যবসায়ী,মাথা নিচু করে ওদের কথা শুনে গাড়ির কাগজ দেখাতে বাধ্য হয়েছেন। নিজের গাড়ি ছেড়ে হেটে অন্য গাড়িতে উঠেছেন। বিনা বাক্যব্যয়ে ওদের কথা শুনে ট্রাফিক আইন মেনে চলেছে হাজার হাজার যানবাহন। ঠিক রুপকথার গল্পের মত,কিংবা সিনেমার মত হঠাৎ নায়ক হয়ে উঠেছে ওরা। আর আমরা বিগত যৌবনা,দায়সারা,অপদার্থ বুড়োরা,পোড় খাওয়া সাধারণ মানুষরা,প্রেস রিলিজ সর্বস্য ক্ষমতালোভী রাজনীতিকরা,ফেসবুক কাঁপানো আঁতেল,সেলিব্রেটিরা, মনে মনে যে যার মতলবের জাল বোনা শুরু করেছি। 

এই আন্দোলনে ওদের নিরাপদ প্রত্যাবর্তনটা নিয়ে কেউ ভাবছিনা। আমরা বুঝতে পারছিনা ওদের অজান্তেই কি ভয়ংকর গোষ্ঠী বা শ্রেণি সংগ্রামে ওরা জড়িয়ে গেছে। ওরা সব সময় সংঘবদ্ধ নয়,ওরা নেতৃত্বশূন্য, ওরা কোনো নির্দিষ্ট দলের ছত্রছায়ায় নেই।দুদিন পর ওরা যে যার মত দিনশেষে একা।ওদের মাথার উপরে বিধাতা বলতে না না সমস্যায় জর্জরিত মধ্যবিত্ত্ব বাবা মা আর এক টুকরো ছাদ। কিন্তু যে মন্ত্রী ড্রাইভারের কাগজ না রাখার দায় মাথায় নিয়ে নিরবে হেটে নেমে অন্য গাড়িতে উঠেছেন,যে আমলা,যে রাজনীতিবীদ, পুলিশ,ব্যবসায়ী, খেটে খাওয়া শ্রমিক,ড্রাইভার,প্রবল গণজোয়ারের মুখে নিরবে ভুল স্বীকার করেছেন, তারা তো এই কমল শিশুদের মনে মনে প্রতিদ্বন্দ্বী ভেবে বসে আছেন। তাদেরই প্রাপ্য অপমানের প্রতিশোধের আগুন তারা কি নিভিয়ে ফেলবেন অপার ক্ষমায়? তারা কি মেনে নেবেন এই ভেবে যে এই শিশুরা কেউ তাদের শত্রু নয়,তারা যা করেছে তাতে অপমানের চেয়ে শিক্ষণীয় ছিল অনেক বেশি।

আপা,আপনিই পারেন সবাইকে নিয়ন্ত্রণ করতে।আমি এখনো বিশ্বাস করি, এই প্রজন্ম আপনাকে শুধু আওয়ামীলীগ নেত্রী হিসেবে নয়,বঙ্গবন্ধু কন্যা হিসেবে নয়,দক্ষিণ এশিয়া তথা সারাবিশ্বের ক্ষমতাধর নারী নেত্রী হিসেবেও নয়,স্বজন হারানো একজন মমতাময়ী মা হিসেবে ভালবাসে।সেই বিশ্বাস থেকে বলছি,আমাদের এই সন্তানরা যেন নিরাপদে প্রতিদিন আমাদের বুকে ফিরে আসতে পারে দিন শেষে স্কুল কলেজ থেকে সেই নিশ্চয়তা দিন। সুযোগ সন্ধানীদের কঠোরভাবে দমন করুন। পুলিশ বাহিনীকে শান্ত থাকার নির্দেশ দিন,আর আপনার পরিবহন শ্রমিক নেতাদের ধমক দিয়ে বলুন ওরা যাতে কোনোভাবেই এই কোমলমতি শিশুদের সাথে যুদ্ধে না নামে। নিশ্চয় আমার মত সারা বাংলার অসংখ্য বাবা মা নিজের শিশুদের সাথে সাথে আপনার সাথেও আছে।