রেশমা [দশম পর্ব]

সাজিয়া আফরিন সোমাঃ
প্রকাশ: ০৪ অগাস্ট ২০১৮ ১৫:৪৯ ।
শিল্প ও সাহিত্য
পঠিত হয়েছে ৬৮৮ বার।

শ্রাবণ মাসের ১৫ তারিখ,ভোররাত থেকে হেদায়েতের ছোটাছুটি,হেদায়েতের বউ এর সানু দাই কে ডাকতে যাওয়ায় সাবই জেনে গেছে আজ খাঁ বাড়িতে নতুন কেউ আসবে। তবে হঠাৎ সালেহার চিৎকার করে কান্নার শব্দে এ বাড়ি,ও বাড়ির বউরা ছুটে এলো। কে জানে এবারও হয়ত খাঁ বাড়ির বংশ প্রদীপকে বাঁচানো যায় নি!

সালেহা শিশুটিকে বুকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছে। তার কান্না দেখে বাড়ির প্রতিটা মানুষ নিজের চোখ মুছতে থাকে। লাইলী ছেলের বউ এর মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে পরম মমতায়।

সালেহা মানত করে রেখেছিলো,সুফিয়া সুস্থ সন্তান জন্মদিলে,সেই সন্তানের আকিকা করবে  মহাস্থানগড়ে। গড়ের মাজারের ফকির-মিসকিনদের খাওয়াবে তার পর গ্রামের প্রতিটা মানুষকে খাওয়াবে নিজে দাঁড়িয়ে থেকে।

২ মাসের বাচ্চা নিয়ে সালেহা রইস সুফিয়া হেদায়েত ও কিছু কাছের লোক আর রান্নার লোকজন নিয়ে রওনা হলো। আকিকা করে নাম রাখা হলো "রেশমা খানম"। এর পর পুরা গ্রামের লোকজনের জন্য খাবারের আয়োজন করলো রইস খাঁন।

রেশমার খাওয়া,গোসল,ঘুম যা কিছু সব সালেহার দায়িত্ব,কারণ সুফিয়ার অনেক কম বয়স,সে বাচ্চার যত্ন নিতে পারেনা আর সে নিজেও রেশমার সব দায়িত্ব সালেহার উপর দিয়ে নিঃশ্চিন্তে থাকে। রেশমার কাপড় সব আনানো হয় ঢাকা থেকে,রেশমার জন্য যা দরকার সব সালেহা শহর থেকে আনায়। রেশমার জন্য এখন থেকেই গহনা বানাতে শুরু করে সালেহা। মেয়ের গা ভরা গহনা থাকবে,সালেহা দেখবে তাকিয়ে,এতেই যেনো সুখ! রেশমা বড় হতে থাকে সালেহার আদর-যত্নে।

বাসেদের মা তাশলি সুফিয়ার মামাতো বোন। তারও একই গ্রামে বিয়ে হয়েছে। ১২ ছেলে-মেয়ের মা।  সুফিয়ার কান ভারি করার জন্য সে একাই যথেষ্ট।

তাশলি- সুফি আগে থ্যাকাই কছনু ছোলডাক তোর কাছে কাছে থো। একন দেক তোর কোল খালি। ছোল তোর কাছ ঘেসেনা। কে কবি ওডা তোর ছোল?

সুফিয়া- ছোল-ছোল করেই আমাক এই বাড়িত আনছে বড় বুবু। তার কি আচে কন? সবই তো রেশমা জন্যি করিচ্চে।

তাশলি- আরে পাগলী ওর কোল ভালো হলে কি আর সব মরা ছোল হলোনি? পরে বুজবু যকন ছোল আর তোক পুছবিও না!!

সুফিয়া- বুবু একটা মানুষ ওই ছোল লিয়া যদি সুখে থাকে,থাক। আর আমি ওগুলা কতা মানি না। এল্যা কতা জানলি পরে বড় বুবু কষ্ট পাবি। আপনি এল্যা কতা আর কবেন না।

তাশলি এসব কথা কানে তোলেনা। তার কাজই কথা এদিক ওদের করে বলা। সুফিয়া এসব জানে তাই তার কথায় কিছু মনে করেনা। সুখের দিনগুলো নষ্ট করতে চায় না সুফিয়া।

রেশমা মাঝে-মাঝে ছোট মা সুফিয়ার সাথে নানা বাড়ি গেলে সালেহা- চাল,ডাল,ঘানির তেল,মুড়ি আর পানি বেধে দিতো। যেনো নতুন জায়গায় গিয়ে নতুন কিছু খেয়ে মেয়ে অসুস্থ না হয়। মেয়ের জন্য প্রতিদিন সকাল বিকেল দুইবেলা নদীর পাড়ে লোক পাঠাতো দেখতে যে তারা এলো কিনা। মেয়ের গোসল করানোর সময় কানে যেনো পানি না ঢোকে,খাওয়ার সময় খাবার যেনো গলায় আটকে না যায়,বাহিরে যেনো খেলতে না যায় কারো সাথে। এরকম কত কথা শিখিয়ে দেয় সুফিয়াকে সে। কারণ সুফিয়ার বাবার বাড়ির পাশেই "ছিকল পুকুর", যে পুকুরে নামলে মাঝে মাঝেই ছিকল পা টেনে ধরে। কত বাচ্চা যে এ ভাবে ডুবে গেছে!! সালেহার এই একটায় ভয় সব সময়। আরো কত-কত কথা যে সুফিয়াকে শিখিয়ে দেয় সালেহা!

সুফিয়া সব কথা মানার চেষ্টা করে, কারণ রেশমা খাঁ বাড়ির প্রাণ। শুধু বাড়ির না,গ্রামের মানুষ এখন বলতে শুরু করেছে ওটা রেশমাদের বাড়ি,ওটা রেশমাদের পুকুর,ওটা রেশমার মা,রেশমা গ্রামেরও এক প্রিয় নাম।

সাড়ে চার বছর জীবনটা সুন্দর কেটেছে সুফিয়ার। একবারও মনে হয়নি তার সংসারে সতীন আছে। কোন কষ্ট তাকে পেতে হয়নি।.............. কিন্তু চোখের পলকে যেনো সব শেষ হয়ে গেলো! সাদা কাফনে মুড়ে তাদের স্বপ্ন পাশের পুরানো কবরস্থান এ দাফল হয়ে গেলো।
সুফিয়ার এতো বুঝে উঠার বয়স নয় তখন। তবুও বোঝে  যে তার জীবনের রঙ্গীন দিন এখন শেষ।

গ্রামের একেক মানুষ একেক কথা বলে, কেউ বলে বাচ্চা মানুষ,বাপের বাড়ি যেয়ে থাকো। কেউ বলে বাচ্চা আছে একটা এটাই তো বেঁচে থাকার উপায়। কেউ বলে মন্দ কপালের মেয়ে।

তাশলী বলে- সুফি শোন এ বাড়ি য্যান ছাড়িস না। কিচুই কেলে পাবু না তালে। ছোলডাকও কাচে পাবু না।

সুফিয়ার চোখে তখন  অন্ধকার সাড়ে ৫ বছরের সংসার। মানুষটার সাথে হলোনা তার কোন কথা,কোন বোঝাপড়া। চিনলো না কেউ কাউকে। বয়সে অনেক বড় বলে সুফিয়া একটু  ভয় ভয় করেই দূরে থাকতো। লজ্জায় প্রয়োজনের বেশী কথা বলতো না। মানুষটা রাতে বই নিয়ে বসে পড়তো,সুফিয়া কখনও জানতে চায়নি কি পড়ে?

কটা দিনের সংসার!!!! সংসার বলা ভুল। ছোট মানুষ জন্য তার কোন দায়িত্ব ছিলোলা। সব সালেহায় করতো,দেখতো। শুধু রইস এর খাওয়া বা আর কিছু দেখাশুনা সুফিয়া করতো।এর বাহিরে তার সমবয়সী মেয়ে-বউদের সাথে গল্প,শেলাই শেখা এসব করেই দিন পার করতো।

চোখের পলকে শেষ হয়ে গেলো সব। লাইলী বিছানা ছাড়া উঠেনি কয়দিন। সালেহা প্রায় সারাদিন কবরস্থান এর দিকে তাকিয়ে থাকে। হাস্না নানী সুফিয়ার ঘরের দরজার কাছে বসে থাকে। রেশমা ছাড়া বাড়ির কোন মানুষের মুখে দানা-পানি পরেনি কদিন। সুফিয়ার কাছে স্বপ্নের মতো মনে হচ্ছে সব।  (চলবে)