রেশমা [একাদশ পর্ব ]
সাজিয়া আফরিন সোমাঃ
সুফিয়ার বাবা বসির উদ্দিন,বড় ভাই,মেজো ভাই,চাচা আর রেশমার দাদী লাইলী বসে আছে। সুফিয়ার বিষয়ে তারা কথা বলতে এসেছে। ঘরের দরজার পাশে সালেহা দাঁড়িয়ে আছে, জলচৌকিতে বসে আছে সুফিয়া আর তাশলী।
বসির উদ্দিন- সালেহা মা বড় শখ করে আমার সুফিয়াকে এ বাড়ির বউ করছিলো। কপাল খারাপ তাই সুফির সুখ সয়নি।
লাইলী আঁচলে চোখ মুছতে মুছতে বলে, বিয়াই আপনারা কোন বিষয়ে কতা কবেন জানি না কিন্তু সালেহা,সুফিয়া কারো কপালে সুখ হলোনা। আর রেশমা তার বাপরে চিনলোই না ঠিক মতো। বাপের কতা ছোলের মনেই থাকবি না। কত শখের ছোল আছিলো রেশমা !!
বসির উদ্দিন- আমার ছেলেরা কয় এ বাড়িত তো কোন পুরুষ মানুষ থাকলো না,সেই জায়গাত কি করে আমার এই ১৮ বছরের বোন ডাক থুই। কতা কিন্ত ভুল না বিয়ান। আমার মাইয়া ছোট মানুষ,এখানে কে তাক দেখে থোবে,আপনের আর সালেহার মনের অবস্থা তো বুঝি আমি।
আমরা চাই সুফি আমাদের কাছে থাক। তারও তো বয়স কম,তার ভবিষ্যত নিয়াও তো ভাবতে হবি?
লাইলী- সেডা তো ঠিক কতা,কিন্তু রেশমা? বড় বউ সব ছাইড়া দিছে খালি রেশমার জন্যি।আপনেরা ছোট বউরে নিয়া যান,ওর পাওনা সব সালেহা বুঝাই দিবো কিন্তু রেশমারে নিয়া যাইয়েন না। রেশমাও ওর বড় মা ছাড়া থাকবি না। এই বাড়ি আবার ভুতের বাড়ি হয়্যা যাবি রেশমা চল্যা গেলে।
বসির উদ্দিন- রেশমা আপনাকেরে ছোল,আর মা সালেহাই রেশমা মা। খালি জন্মডাই হয়ত দেয়নি। আমার কোন আপত্তি নাই। রেশমা সালোহার কাছেই ভালো থাকবে।
কিন্তু বিয়ান এডা মনে করবেন না যে রেশমাকে আমরা নিবার চাই না। রেশমা উপর আগে অধিকার সালেহার,আর এই বাড়ির তাই চুপ করে আছি। তাছাড়া রেশমাও সুফির সাথে আমার কাছে থ্যাকবারই পারে।
সালেহা এবার কথা শুরু করে-
সালেহা- আব্বা আমি সুফির পাওনা সব বুঝাই দিবো। খালি সুফি য্যান বাড়ির অংশ দাবী না করে। সুফির আবার বিয়া দিবেন তখন ওই পক্ষের বাচ্চারা এই বাড়ির অংশীদার হবে। কিন্তু ভাবেন তখন রেশমা কেমন বিপদে পরবে? আমি চাইনা আমার ছোল বিপদের আশংকা নিয়া বড় হোক। এই বাড়ি,ভিটা মাটি আমি রেশমার নামে লিখা দিমু। আর বাড়ির অংশের বদলে আমি সুফির নামে দুই বিঘা ধানী জমি বেশী দিমু।
তাশলী বহুক্ষণ ধরে শুনছিলো এসব কথা। এবার সে কথা না বলে থাকতে পারলো না
তাশলী- এডা ক্যাংকা হিসাব। বাড়ির বউ সুফি তাক বাড়ির জাগা না দিয়া ভিউ দিবিন ক্যা। তার মানে-বিধবা হতে না হতে ওক আপনেরা বাড়িত থ্যাকাই বার করা দিচ্চেন। আবার ছোলও ক্যারা লিচ্চেন? ওই কি লিয়া থাকবি?
সালেহা- তাশলী ভাবী,সুফির বয়স কম চাইলেই ওর বিয়া দেওয়া যাবে,আমিও চাই ওর বিয়া হোক সংসার করুক। দরকার হলে ওর বিয়ার খরচ আমি দিমু। কিন্তু সুফি সুখে থাকুক। এই বাড়ির বউ হিসাবে কন আর রেশমার মা হিসাবে কন,ওর জন্যি এই বাড়িত জায়গা সব সময় থাকবি।
আর রেশমা সাথে থাকলে সবাই ওরে বিয়া করতে চাবে না,আবার কেউ যদি চায়ও রেশমাকে নিতে কিন্তু আমরা কি জন্য এ বাড়ির ছোলডাক মানুষের কাছে দিমু? রইস খাঁন বেঁচে থাকলে যে ভাবে ছোল মানুষ হতো আমিও সেই ভাবেই রেশমাক মানুষ করমু। এ বাড়ির ছোল কারো কাছে থাকবে না।
বসির উদ্দিন- মা সলেহা আমরা তালে আজই সুফিক নিয়া যাই,ছোলডা আমার শোকে মরা মরা হয়্যা গেছে।
সালেহা- যা আপনেরা ভলো মনে করেন, তবে সুফিয়ার যতদিন অন্য জায়গায় বিয়া না হয় ততদিন ওর সব খরচা খাঁ বাড়ি দিবে। আর বিয়া ঠিক হলে বিয়ার সব খরচও।
বসির উদ্দিন- মা সুফি তোমার গোছগাছ করো মা,বেলা থাকতে থাকতে আমরা বারামু।
সুফিয়া- আব্বা আমাকে নিয়া গেলে রেশমাকেও সাথে নিতে হবি। রেশমা ছাড়া আমি যামু না। আমার ছোল থুয়্যা আমি কোথাও যামুনা। আমার জমি জমা লাগবে না, আমার খালি ছোল চাই।
সালেহা- এ কি কতা কস্ তুই সুফি? এই ছোলের জন্য আমি জীবনের সব ছাড়ছি আর সেই ছোল তুই লিয়া যাবু? সুফি তুই কি করে এই কতা কলু? তুই কি জানিস না রেশমার বাপে কিসের জন্যি তোক বিয়া করছিলো? তার ছোল তুই নিয়া যাবু? সুফি এমন করিস না। তোর যখন ইচ্ছা এস্যা ছোলেক দেক্যা যাবু,ঘুরব্যার লিয়া যাবু,কিন্তু ছোল লিয়া যাবু এ কতা কস না।
সুফিয়া- বুবু আমার কিচুই লাগবেনা। ছোল দেন, যকন মন চায় আপনি দেকে আসবেন। আমি ওর দেকভালে কোন কমতি করবো না। কিন্তু আপনার পায়ে পরি ছোল লিয়েন না। স্বামীর বাড়ি,ভিটা আমি সব থুয়্যা যাচ্চি কিন্তু ছোলডা লিয়েন না,আপনের কাছে ভিটা মাটি সব থাকলো,মন চ্যালে ওর বাপের কবরটাও দেখবার পারবেন,কিন্তু আমি? আমার কি থাকলো? এক রেশমাই সম্বল। ওটা আপনি নিয়েন না বুবু। আমার সব গয়না,পাওনা জমি সব আপনি নেন কিন্তু রেশমাক নিয়েন না।
সুফিয়ার কান্নায় সালেহা যেনো বাকরুদ্ধ। কি করে সে একটা মা হয়ে আরেক মায়ের কাছে তার সন্তান কেড়ে নিবে?
সালেহা নিজ হাতে রেশমাকে কাপড় পরালো,চুল বেধে দিলো। ব্যাগ গুছিয়ে দিলো। সুফিয়ার সব গহনা ছিলো সালেহার কাছে,সেগুলা সব বুঝিয়ে দিলো।
সালেহা- আব্বার জমির কাগজ পত্র হয়ে গেলে খবর দিবো একবার কষ্ট করে আসবেন। আর আমার সবচেয়ে বড় সম্পদ দিয়ে দিলাম আপনার কাছে। আমার জীবনে হয়ত সন্তান সুখ নাই আব্বা,তাই জোর করে ধরে রাখার চেষ্টা করলাম না।
সালেহা চোখ মুছতে মুছতে ঘরে চলে গেলো।লাইলী আঁচলে মুখ চেপে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে।
সুফিয়া সালেহাকে সালাম করে দরজা দিয়ে বের হয়ে গেলো। সালেহা ঘর থেকে বেরিয়ে দরজার কাছে বসে পরলো। লাইলী কাঁদছে,সালেহা পাথর হয়ে দরজার সামনে বসে আছে। হাস্না নানী লাইলীর পাশে নির্বাক তাকিয়ে।
কদিনের ভিতর পুরা সংসার তছনছ হয়ে গেলো।স্বামী,সন্তান হারিয়ে সালেহা পাথর,সুফিয়া দিশেহারা,সে বুঝতে পারছেনা যে সে ঠিক করলো নাকি ভুল। লাইলী নিজেকে ছেলের কবরের পাশের জায়গায় আজ দেখছে। ছেলে চলে গেছে সুফিয়া,রেশমাও গেলো বাড়ি ছেড়ো, সে বাঁচবে কি নিয়ে? আর কত চলে যাওয়া দেখতে হবে তাকে!! (চলবে)