রণাঙ্গণের বীর যোদ্ধা

বগুড়ার সরিফুল মাসুদ যুদ্ধ করেছেন ঢাকায়

মোহন আখন্দ
প্রকাশ: ২৫ মার্চ ২০১৯ ১৪:৪৪ ।
প্রচ্ছদ
পঠিত হয়েছে ৬৭৮ বার।

খবরের খোঁজে কাছে-দূরে কত জায়গায় যেতে হয়। ‘যা শুনেছি তা সঠিক কি’না- তা নিশ্চিত হওয়ার জন্য কত মানুষের সঙ্গে যে কথা বলতে হয়! জনপ্রিয় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ‘ফেসবুক’ চালু হওয়ার পর অপরিচিত মানুষগুলোও এখন পরিচিত হতে শুরু করেছেন। কোথাও গেলে অনেকেই কাছে এসে বলেন, ‘আমি আপনার ফেসবুক ফ্রেন্ড’। শুরুতে ফেসবুকে বন্ধুত্ব করতাম বেছে বেছে। কিন্তু যখন দেখলাম ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট অ্যাকসেপ্ট না করলে অনেকে ক্ষুব্ধ ও ব্যথিত হন, এমনকি এ নিয়ে কেউ কেউ অহংবোধ খোঁজারও চেষ্টা করেন- এসব জেনে কিছুটা উদার হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। তারপর ফেসবুকে আমার বন্ধু সংখ্যা বেড়েই চলেছে। 
ভাল-মন্দের সেই ফেসবুকে এমন একজনের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছে যিনি রণাঙ্গণের একজন বীর যোদ্ধা। আদি নিবাস বগুড়ার সোনাতলা হলেও যুদ্ধ করেছেন ঢাকায়। বগুড়ার মানুষ অথচ যুদ্ধ করেছেন ঢাকায়! এমনটা শোনার পর তাঁকে জানার আগ্রহ বেড়ে যায়। কারণ মুক্তিযুদ্ধকালে বড় শহরে বসবাসরত অধিকাংশ মানুষ নিরাপদ ঠিকানার সন্ধানে গ্রামে ফিরে গেছেন বলেই জেনেছি। কিন্তু সরিফুল মাসুদ উল্টোটাই করেছেন! 
বগুড়ার সোনাতলা উপজেলার পাকুল্যা ইউনিয়নের পদ্মপাড়া গ্রামের সাবেক পুলিশ কর্মকর্তা লুৎফর রহমানের ছেলে সরিফুল মাসুদ নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধান না করে পাকিস্তানের বর্বর সেনাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। 
আসুন ভয়াবহ যুদ্ধের সেই দিনগুলির বর্ণনা আমরা তার মুখেই শুনি-
আমার আব্বা পুলিশ সুপার ছিলেন। ১৯৬৮ সালে তার মৃত্যু হয়। আমি তখন ঢাকা কলেজে উচ্চ মাধ্যমিকের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। পরের বছর উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করে পুর্ব পাকিস্তান ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে (বর্তমানে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়-বুয়েট) ভর্তি হই। আমি ইলেকট্রিক্যাল বিভাগের ছাত্র ছিলাম। শহীদ জননী জাহানারা ইমামের বড় ছেলে শাফি ইমাম রুমিও ওই কলেজের ছাত্র ছিলেন। দ্বিতীয় বর্ষে ওঠার আগেই যুদ্ধ শুরু হয়। তখন আমরা ঢাকার রায়ের বাজার এলাকায় থাকতাম। পঁচিশে মার্চ রাতে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী ঢাকা শহর জুড়ে গণহত্যা চালায়। হায়েনাদের মোকাবেলার জন্য ওই মহল্লার লোকজন পরদিন ভোরে বাড়ি বাড়ি গিয়ে অস্ত্র সংগ্রহে নেমে পড়েন। মূলত যাদের বাড়িতে বন্দুক ছিল সেগুলোই তারা নিচ্ছিল। তারা আমাদের বাড়িতেও এসেছিল।
২৮ মার্চ সান্ধ্য আইন শিথিল হলে মা আমাকে ফুফুর বাড়ি বিক্রমপুরে পাঠিয়ে দেন। কামরাঙ্গী চরে পৌঁছার পর পরিচিত অনেক বন্ধুর সঙ্গে দেখা হয়ে যায়। তখন সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নিই যে, আমরা ওপারে (আগরতলা, ভারত) যাব। রওনা হওয়ার পর পথে পথে বিভিন্ন স্থানে গ্রামের লোকজন আমাদের খাইয়েছেন এবং থাকতে দিয়েছেন। পথে ছাত্রলীগ এবং ছাত্র ইউনিয়নের (মেনন গ্রুপ) অনেক নেতা-কর্মীর সঙ্গেও দেখা হয়ে যায়। আমরা মোট ২৮জন আগরতলার উদ্দেশ্যে রওনা হলেও দু’জনকে হারিয়ে ফেলি। প্রায় পাঁচ দিন পর ২ এপ্রিল আমরা আগরতলা পৌঁছাই। সেখানে যাচাই-বাছাই শেষে আমাদের ২১জনকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে নথিভুক্ত করা হয়। ১৯ এপ্রিল এক্সারসাইজ দিয়ে আমাদের ট্রেনিং শুরু হয়। এরপর রাইফেল পরিচালনা, গ্রেনেড ছোঁড়া আর মর্টার অ্যাডজাস্টমেন্ট ট্রেনিং করানো হয়। ভারতীয় এক সেনা কর্মকর্তা আমাদের ট্রেনার ছিলেন। তাঁর পক্ষে ইপিআরের (ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস্্ পরবর্তীতে বিডিআর বর্তমানে বিজিবি) সুবেদার মেজর মহিউদ্দিন আমাদের সবকিছু শিখিয়ে দিতেন। আমরা তাকে ‘বড় ভাই’ ডাকতাম। 
আমরা ছিলাম ২নং সেক্টরের অধীন। আমাদের কমাণ্ডার ছিলেন ‘কে ফোর্সের’ প্রধান মেজর খালেদ মোশাররফ। আমাদের গ্রুপ কমাণ্ডার ছিলেন ক্যাপ্টেন হায়দার (স্বাধীনতার পর মেজর পদে পদোন্নতি পান এবং ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর মেজর জেনারেল খালেদ মোশাররফের সঙ্গে নিহত হন)। প্রায় পনের দিনের গেরিলা ট্রেনিং দেওয়ার পর আমাদের পাঠানো হয় তিরিশ মাইল দূরে কুমিল্লার দেবিদ্বারে। অপারেশন শেষে আমরা আবার ফিরে যাই আগরতলা। এভাবে একাধিকবার অপারেশন চালিয়েছি। পরে জুন মাসে একবার ঢাকায় আসি। প্রায় তিন মাস পর বাসায় গিয়ে আম্মার সঙ্গে দেখা হয়। তিনি জানান, কয়েকজন রাজাকার বাসায় এসে আমার আব্বার রেখে যাওয়া পুলিশের পোষাকগুলো নিয়ে গেছেন। কয়েকদিন পর আবার ফিরে যাই আগরতলা।
এরপর আমাদের সিদ্ধিরগঞ্জে যেতে বলা হয়। সেখানে গিয়ে আমরা মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়ার (রণাঙ্গণে বীরত্ব দেখানোয় তাকে বীরবিক্রম খেতাব দেওয়া হয়) গ্রুপে যোগ দিই। ওই গ্রুপে ৩২জন ছিলেন। আমাদেরকে সিদ্ধিরগঞ্জ পাওয়ার স্টেশন এবং উলান পাওয়ার স্টেশন উড়িয়ে দিতে বলা হয়। কিন্তু সিদ্ধিরগঞ্জ পাওয়ার স্টেশনের দিকে যেতেই পাাকিস্তান সেনাবাহিনীর আক্রমণের মুখে পড়ি। সবাই ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ি। আমি একটি পুকুরের লাফ দিই। কচুরিপানার ভেতরে লুকিয়ে পড়ি। দীর্ঘ সময় পানিতে থাকার কারণে আমার হাত-পা সাদা হয়ে গিয়েছিল। পরে ওই গ্রামে আব্দুর রহিম নামে সড়ক বিভাগের চতুর্থ শ্রেণির এক কর্মচারীর বাড়িতে আশ্রয় নিই। তার স্ত্রীর নাম ছিল হালিমা। তাদের বাড়িতে তিনদিন অবস্থান করেছিলাম। সিদ্ধিরগঞ্জ পাওয়ার স্টেশন উড়িয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা ব্যর্থ হলেও উলান পাওয়ার স্টেশন আমরা ঠিকই গুঁড়িয়ে দিতে সক্ষম হয়েছিলাম। স্পষ্ট মনে আছে, মায়া ভাই (মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া) বলেছিলেন, এবার কৌশল পাল্টাতে হবে। পাকিস্তান বাহিনীকে ধোঁকা দিতে হবে। তার পরিকল্পনাতেই আমরা উলান পাওয়ার স্টেশনের উত্তর দিকে আক্রমণের নাটক সাজাই। সিদ্ধান্ত হয় যে, উত্তর দিকে গ্রেনেড চার্জ করার পর যখন হায়েনারা সেদিকে ছুটবে তখন সুযোগ বুঝে দক্ষিণ দিক থেকে আক্রমণ করা হবে। পরে সেই অনুযায়ী আক্রমণ পরিচালনা করে উলান পাওয়ার হাউজ উড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল।
এরপর আমরা ঝিকিমিকি এলাকায় একটি ব্রীজ উড়িয়ে দিতে যাই। কিন্তু সেখানে স্থানীয় রাজাকাররা আমাদের প্রতিরোধের চেষ্টা করে। আমরাও আক্রমণ শানিত করি। অল্প সময়ের মধ্যে তারা নিরস্ত্র হয়। সেখানে রাইফেলের গুলি ও বেয়নেট দিয়ে ৪২জন রাজাকারকে হত্যা করা হয়। পরে আগরতলার দিক থেকে আসা ভারতীয় মিত্র বাহিনীকে সঙ্গে নিয়ে ঢাকার দিকে রওনা হই। আমরা মুক্তিযোদ্ধারা আগে আগে আর ভারতীয় মিত্রবাহিনী পেছনে। পরে তাদের গাড়িতে করে আমিসহ ৪ জন ১৬ ডিসেম্বর দুপুর নাগাদ ঢাকার হাটখোলায় পৌঁছে যাই। এরপর সেখান থেকে রায়ের বাজার আমাদের বাসায় যাই। আসার সময় পথে পথে জনগণের বিজয়োল্লাস দেখতে পাই।

 

সরিফুল মাসুদকে প্রশ্ন করেছিলাম বগুড়ার মানুষ হয়েও আপনি ঢাকা অঞ্চলে যুদ্ধ করেছেন- এজন্য আপনার গর্ব হয় না? একগাল হেসে তিনি বলেছিলেন, ‘তখন এসব ভাবার কোন সময় ছিল না। তোমরা যখন বল তখনই কেবল মনে হয়’।

যুদ্ধ শেষে সরিফুল মাসুদ ১৯৭২ সালের প্রথম দিকে আবারও ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে ফিরে যান। পড়ালেখা শেষে তিনি বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডে সহকারি প্রকৌশলী হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। তবে সেই চাকরি ছেড়ে ১৯৭৮ সালে তিনি ইতালিতে পাড়ি জমান। পরে তিনি জার্মানীতে চলে যান। এরপর দেশে ফিরে তিনি ব্যবসা শুরু করেন। হাতে গোন যে ক’জন ব্যবসায়ীর মাধ্যমে বগুড়ায় পোল্ট্রি শিল্পের বিকাশ ঘটে সরিফুল মাসুদ তাদের অন্যতম। আদি নিবাস যমুনা নদী তীরবর্তী পদ্মপাড়াসহ আশ-পাশের গ্রামে নারী শিক্ষার প্রসারে তিনি ১৯৯৩ সালে ‘লুৎফর রহমান বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়’ নামে একটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। মুক্তিবার্তা’র তালিকায় ৩৯৪৫ নম্বরধারী সরিফুল মাসুদ মুক্তিযোদ্ধা ভাতা নেন না। তার দেওয়া তথ্য অনুযায়ী তিনিসহ বাংলাদেশে মোট ৩জন ভাতা নেন না। অপর দু’জনে হলেন কুমিল্লার দুই মুক্তিযোদ্ধা নজরুল ইসলাম ও আব্দুল ওদুদ। সরিফুল মাসুদ মনে করেন, নীতিমালা অনুযায়ী শুধু অস্বচ্ছল মুক্তিযোদ্ধারাই ভাতা পাওয়ার যোগ্য। শহরের সুত্রাপুরে অবসর জীবন কাটানো সরিফুল মাসুদ মুক্তিযোদ্ধা এবং তাদের পরিবারের কল্যাণে এখনও নানাভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। বাংলাদেশকে নিয়ে তিনি স্বপ্ন দেখেন। তার বিশ্বাস মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে জন্ম নেওয়া এই দেশ একদিন উন্নত দেশ হিসেবেই বিশ্বের বুকে ঠাঁই করে নিবে।