বনানী ট্রাজেডিঃ হুইল চেয়ার ছেড়ে উঠতে পারেননি নওগাঁর মঞ্জুর

নওগাঁ জেলা প্রতিনিধি
প্রকাশ: ২৯ মার্চ ২০১৯ ১২:২৩ ।
প্রচ্ছদ
পঠিত হয়েছে ২৭২ বার।

আগুন থেকে বাঁচতে সবাই যখন ছোটাছুটি করছিল তখন হুইল চেয়ারে বসে থাকা ছাড়া আর কিছুই করার ছিল না মঞ্জুর হাসানের (৫০)। তাই ছোট ভাইকে ফোন করে মৃত্যুর পূর্ব মুহুর্তের পরিস্থিতির বর্ণনা দিয়ে তার মাধ্যমে সবার কাছে দোয়া চেয়ে নেন তিনি। বলেন, ‘আমিতো অফিস থেকে বের হতে পারছিনা। পঙ্গু মানুষ। আমি মনে হয় আর বাঁচবো না। সবাই অফিস থেকে বের হয়ে যাচ্ছে। আমি কোন উপায় না পেয়ে অফিসের চেয়ারে বসে আছি। সবাই আমার জন্য দোয়া করিস। তোরা ভালো থাকিস।’  বৃহস্পতিবার দুপুরে ঢাকার বনানীতে এফআর টাওয়ারে আগুনে তিনিও মারা যান। তার বাড়ি নওগাঁ সদর উপজেলার বোয়ালিয়া পূর্বপাড়া গ্রামে। তিনি ওই গ্রামের মৃত মুনছুর রহমানের ছেলে। পাঁচ ভাইয়ের মধ্যে তিনি ছিলেন তৃতীয়। 

নিহতের পারিবারিক সূত্রে জানা যায়, মঞ্জুর হাসান ছাত্রজীবন (১৯৮৭-৮৮ সাল) থেকে ঢাকায় থাকতেন। ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে লেখাপড়া করে ছাত্রজীবন শেষে চাকরি শুরু করেন। এরপর সংসার। পরিবার নিয়ে ঢাকার ইব্রাহিমপুরে বসবাস শুরু করেন। তার এক ছেলে ও এক মেয়ে। তিনি কাশেম গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রি লিমিটেডে প্রশাসনিক কর্মকর্তা পদে চাকুরি করতেন। ঘটনার দিন মঞ্জুর হাসান ভবনের ২১ তলায় কোম্পানির প্রধান কার্যালয়ে অবস্থান করছিলেন। আগুন থেকে বাঁচতে সবাই যখন ছুটাছুটি করছিলেন তিনি কোন উপায়ন্তর না পেয়ে অফিসের চেয়ারে বসে ছিলেন। আর জীবনের শেষ সময়টুকুর স্বজনদের সাথে মোবাইল ফোনে কথা বলছিলেন। এক সময় ফোনে কথা বলা বন্ধ হয়ে যায়। বার বার রিং হলেও অপর প্রান্ত থেকে কোন সাড়া পাওয়া যাচ্ছিল না। 
শুক্রবার সকালে নিহতের গ্রামের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায় লোকজন মঞ্জুর হাসানের বিষয়ে কথা বলছিলেন। নিহতের পরিবারের সবাই ঢাকায় থাকেন। তবে তার ছোট ভাই মোনাক হাসান অরুফে শিমুল নওগাঁ মাল্টিপারপাস কোঅপারেটিভ সোসাইটির বগুড়া ব্রাঞ্চ অফিসে চাকুরী করেন। সেখান থেকে প্রতি বৃহস্পতিবার গ্রামের বাড়িতে আসেন। বৃহস্পতিবার বিকেলে ভাইয়ের মৃত্যুর কথা জানতে পান তিনি। বাড়িতে কাঁন্না করার মতো কেউ নাই। শুধু গ্রামের লোকজন মঞ্জুরের মরদেহ দেখার জন্য অপেক্ষা করছেন।
নিহতের ছোট ভাই মোনাক হাসান অরুফে শিমুল বলেন, ভাই চাকরিরত অবস্থায় ২০০০ সালে কাশেম গ্রুপের মতিঝিল অফিসের সামনের রাস্তায় এক সড়ক দূর্ঘটনায় পঙ্গু হন। এরপর থেকে ঠিকমতো চলাফেরা করতে পারতেন না। এক প্রকার পঙ্গু জীবন যাপন করতেন। কিন্তু তারপরও কোম্পানি ভাইকে চাকরি থেকে বাদ দেয়নি। পরবর্তীতে তাকে বনানীর হেড চাকুরিতে রেখে দিয়েছিলেন। অফিসে যখন আগুন লাগে সবাই বাঁচার জন্য ছুটাছুটি করছিল। কিন্তু ভাই পঙ্গু হওয়ায় কিছু করার উপায় ছিলনা। অফিসে বসেই মোবাইল ফোনে আমাদের সাথে কথা বলছিল। আর দোয়া চেয়েছিল। তার শেষ কথা ছিল ‘আমি তো বের হতে পারছিনা- এখানে হয়ত আমার শেষ সময় যাবে।’ এক সময় তার ফোনের সংযোগ কেটে যায়। এরপর ফোনে রিং হলেও রিসিভ হয়নি।
নিহতের চাচাতো ভাই সাবেক সেনা সদস্য ফজলুর রহমান বলেন, যখন ঢাকায় থাকতাম নিয়মিত তার (মঞ্জুরের) সাথে দেখা করতাম। তার অফিসে যেতাম। তাকে ধরে উঠা বসাতে করাতে হতো। যখন আগুন লাগার সংবাদ পেলাম তখন ধারনা করেছি হয়ত সে আর বের হতে পারবে না।
বিকেল আড়াইটার দিকে শেষ কথা হয় স্বজনদের সঙ্গে। উদ্ধার কর্মীরা তার মরদেহ উদ্ধার করে হাসপাতালে নিলে সেখানে তাকে সনাক্ত করা হয়। তার পরিবার ও সন্তানদের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী নিহতের মরদেহ ঢাকায় দাফন করা হবে বলে জানান তিনি।