বঙ্গবন্ধুর নৃশংস হত্যাকাণ্ডঃ শোকাবহ সেই পনেরই আগস্টে যেমন ছিল বগুড়া

অসীম কুমার কৌশিক ও আব্দুল আউয়ালঃ
প্রকাশ: ১৫ অগাস্ট ২০১৮ ০৬:৩৩ ।
প্রচ্ছদ
পঠিত হয়েছে ৮৫৬ বার।

‘যদি রাত পোহালে শোনা যেত,
বঙ্গবন্ধু মরে নাই।
যদি রাজপথে আবার মিছিল হত,
বঙ্গবন্ধুর মুক্তি চাই।
তবে বিশ্ব পেত এক মহান নেতা,
আমরা পেতাম ফিরে জাতির পিতা।’
বাংলাদেশের স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হারিয়ে বাঙালির ঘরে ঘরে যে হাহাকার পড়ে গিয়েছিল গীতিকার ও সঙ্গীত পরিচালক হাসান মতিউর রহমান গানের সুরে তা-ই যেন তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন।
সেই হাহাকারের দিনে রাজধানী ঢাকার পরিস্থিতি নিয়ে অনেক লেখালেখি হয়েছে। কিন্তু সেদিন বগুড়ার অবস্থা কেমন ছিল-সেটা নিয়ে তথ্য নির্ভর কোন লেখা কোথাও খুঁজে পাওয়া যায় না। তবে পঁচাত্তরে যাদের জন্ম এবং তার পরবর্তী আরও তিন দশকের মধ্যে যারা জন্মগ্রহণ করেছেন তারা সেই পনের আগস্ট এবং তার পরবর্তী দিনগুলোতে নিজ জেলা বগুড়ার পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে চান। তাদের আগ্রহের কথা বিবেচনায় রেখেই পুণ্ড্রকথা মুখোমুখি হয়েছে সেই সময়ে বগুড়ার রাজপথে সক্রিয় ছাত্র-জনতা ও রাজনীতিবিদদের।

পঁচাত্তরের পনের আগস্ট। দিনটি ছিল শুক্রবার। যথানিয়মে বগুড়ার আকাশে সেদিনও সূর্যের দেখা মিলেছিল। তবে আলোর প্রখরতা ছড়ানোর আগেই ইথারে ভেসে আসে একটি দুঃসংবাদ। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আর নেই। তাকে হত্যা করা হয়েছে। সেই খবর রেডিওতেই প্রথম জানতে পারেন বগুড়াবাসী। আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ এবং যুবলীগের নেতা-কর্মীসহ বঙ্গবন্ধুভক্ত জনগণ কিংকর্তব্য বিমূঢ় হয়ে পড়েন। তাদের কেউ কেউ রাজপথে প্রতিবাদ মিছিল বের করার জন্য নানামুখি চেষ্টা চালান। কিন্তু সে সময় সামারিক বাহিনীর সদস্যদের তৎপরতার কারণে সেটি আর সম্ভব হয়নি। তবে শহরের কোন কোন স্থানে আওয়ামী লীগ বিরোধী গুটি কয়েক মানুষ উল্লাস ধ্বনি দিয়ে মিছিল করেছিল বলে জানিয়েছেন তৎকালীন ছাত্রলীগের কয়েকজন নেতা।


তৎকালীন বগুড়া  জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মমতাজ উদ্দিন (বর্তমানে সভাপতি বগুড়া জেলা আওয়ামী লীগ) পুণ্ড্রকথাকে জানান, তিনি শহরের কালিতলায় (আলোর মেলা স্কুলের বিপরীতে) তার বাড়িতে বসেই বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের খবর পান। তিনি বলেন, এমন পরিস্থিতিতে আমি কয়েকজনকে সঙ্গে নিয়ে রক্ষীবাহিনীর অফিসের (তাঁর বর্ণনা অনুযায়ী বর্তমানে বনানীর পশ্চিমে উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় ভবন এলাকাতেই রক্ষীবাহিনীর অফিস ছিল) দিকে রওনা হই। কিন্তু পলিটেকনিক ইন্সটিটিউটের কাছাকাছি যাওয়ার পর আমাদের কাছে খবর এলো সেখানে যাওয়া যাবে না। বাধ্য হয়ে আমরা ফিরে আসি। মমতাজ উদ্দিন বলেন, ১৬ আগস্ট সেনাবাহিনীর একদল সদস্য আমাকে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে সার্কিট হাউসে তাদের ক্যাম্পে নিয়ে যায়। সেখানে গিয়ে তৎকালীন যুবলীগ নেতা শোকরানাকেও (বর্তমানে বিএনপি নেতা) দেখতে পাই। শুনলাম তাকে আমারও আগে আটক করা হয়েছে। সেনা সদস্যরা মনে করেছিলেন আমার কাছে অনেক অস্ত্রের মজুদ রয়েছে। তাই তারা বার বার আমাকে বলছিলেন অস্ত্রগুলো কেথায় রেখেছেন বের করে দিন। তখন আমি তাদের বলি আপনাদের কোথাও ভুল হচ্ছে। আমার কাছে অস্ত্রের কোন মজুদ নেই। তবে দামি একটি পিস্তল রয়েছে। যেটি ব্যবহারের জন্য প্রধানমন্ত্রীর লিখিত অনুমতি (মমতাজ উদ্দিনের বর্ণনা অনুযায়ী তার কাছে অস্ত্রের লাইসেন্স থাকলেও দেশে আগ্নেয়াস্ত্রের সংকট থাকায় প্রধানমন্ত্রীর লিখিত অনুমতি নিয়ে ওই পিস্তল তিনি নিজের কাছে রেখেছিলেন) তার রয়েছে। পরে তারা নিজস্ব লোকজন দিয়ে সেই অস্ত্র আমার বাড়ি থেকে নিয়ে আসে এবং সন্ধ্যার পর আমাকে ছেড়ে দেয়।


জাতীয় ছাত্রলীগ বগুড়া জেলা শাখার তৎকালীন সভাপতি আব্দুল মোত্তালিব মানিক (বর্তমানে প্রধান সম্পাদক দৈনিক কালের খবর) পনের আগস্টে বগুড়ার অবস্থা সম্পর্কে বলতে গিয়ে পুণ্ড্রকথাকে বলেন, ১৪ আগস্ট রাতে আমি গালাপট্টি আকরাম ছাত্রাবাসে ঘুমিয়ে ছিলাম। ফজরের আযানের সময় আমার বন্ধু  ফেরদৌস জামান মুকুল (প্রয়াত ফেরদৌস জামান মুকুল তৎকালীন ছাত্রলীগ নেতা ছিলেন। পরবর্তীতে সাংসদ এবং জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হয়েছিলেন) তার বাড়ি শিববাটী থেকে আমার ছাত্রাবাসের গেটে এসে কেয়ারটেকারের মাধ্যমে আমাকে ডেকে পাঠান। আমি সামনে দাঁড়াতেই তিনি আমাকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে। তারপর আমাকে কিছু না বলেই এক সাইডে নিয়ে বসার পর সে পকেট থেকে রেডিও সেট বের করে। সেটি চালু করার পর যা শুনি তা অবিশ্বাস্য। মনে হচ্ছিল আমার পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে যাচ্ছে। ডালিম নামে একজন নিজেকে মেজর পরিচয় দিয়ে রেডিওতে বঙ্গবন্ধু হত্যার কথা ঘোষণা করছিল। আমার সহযোদ্ধা রেজাউল করিম বাকীকে (প্রয়াত রেজাউল করিম বাকী তৎকালীন ছাত্রলীগ নেতা ছিলেন) ডেকে তুলি। এরপর বাকীকে ঘটে যাওয়া সমস্ত ঘটনা খুলে বলি। তখনি আমরা তিনজন মিলে তৎকালীন সংসদ সদস্য মোস্তাফিজুর রহমান পটল ভাইয়ের বাড়ির দিকে রওনা দেই। সেখানে যেয়ে দেখি তিনি ঘটনাটি তখন জানেন না। আমাদের মাধ্যমে তিনি খবরটি শুনে সত্যতা যাচাইয়ের জন্য উনার বাড়ির  ট্রানজিস্টর চালু করে দেন। এরপর তিনি সেখানে মেজর ডালিমের দেয়া বক্তব্য শুনে থমকে যান। তার কিছু সময় পরে তিনি তার টেলিফোন ঘুড়িয়ে ঢাকার সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেন। তবে তিনি বার বার চেষ্টা করেও যোগাযোগ করতে ব্যর্থ হোন। এরপর  তৎকালীন রক্ষীবাহিনীর এক অফিসারের সাথে যোগাযোগ করলে তিনি তার সাথে দেখা করেন এবং পরবর্তী নির্দেশ না পাওয়া পর্যন্ত যেকোন পদক্ষেপ থেকে আমাদেরকে বিরত থাকতে বলেন। এর কিছুক্ষণ পর সেনাবাহিনীর একটি গাড়ী এসে পটল ভাইকে জিজ্ঞাসাবাদের কথা বলে তুলে নিয়ে যায়।  ভাইকে তুলে নিয়ে যাওয়ার পরে আমরা তিন জন মিলে ফুলবাড়ী নদীর পাশ ও মাটিডালি হয়ে দুপুর নাগাদ পুরান বগুড়ায় অবস্থান করি। সেখানে গিয়ে তৎকালীন ছাত্র ইউনিয়ন নেতা জিন্নাহর সাথে দেখা হলে সেখানেই দুপুরের খাবার খাই। এরপর সেখানে বিকেল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে থাকি। তখন বিভিন্ন মাধ্যমে আমাদের কাছে খবর আসতে থাকে যে রাস্তায় সেনাবাহিনীর গাড়ি দেখা যাচ্ছে এবং আওয়ামী বিরোধী সংগঠনগুলো মিছিল করছে। এরপর রাতে আমি ও  রেজাউল করিম বাকীর শিববাটী সেবক সমিতির বাড়িতে যেয়ে উঠি এবং মুকুল তার কোন আত্মীয়ের বাড়িতে চলে যায়। সেইদিন রাত ২টা ৩০ মিনিটের দিকে বুটের শব্দ শুনতে পাই। এর কিছুক্ষণ পর দরজার ওপার থেকে পটল ভাইয়ের ডাক শুনতে পাই। দরজা খুলতেই সেনাবাহিনীর কিছু সদস্য আমাদের দিকে বন্দুক তাক করে আছে। এরপর আমাদের তিনজনকে নিয়ে তাদের গাড়িতে তোলার জন্য রওনা হয়। হাঁটার সময় পটল ভাইয়ের ইশারায় রাতের আঁধারে পালাতে সক্ষম হই। পটল ভাই ও বাকীকে তাদের ক্যাম্পে নিয়ে যেয়ে বাকীর উপর শারীরিক নির্যাতন চালানো হয়। এর  কিছুদিন পরে বাকীকে ছেড়ে দেওয়া হয়। তারপর  বঙ্গবন্ধু হত্যার ১৫- ২০ দিন পর আমরা অনেকে মিলে সংঘটিত হয়ে পরবর্তী পদক্ষেপের জন্য ঢাকা চলে যাই। সেখান থেকে তৎকালীন যুবলীগ নেতা খসরু, ছাত্রলীগ নেতা বাকী, নীহার এবং মন্টু প্রতিরোধ গড়ে তুলতে ভারতে চলে যায়। পরবর্তীতে তারা দেশে ফিরে এসে গোবিন্দগঞ্জ ব্রীজের কাছে সেনাবাহিনী ক্যাম্পে আক্রমণ করে। এতে খসরু এবং নীহার নিহত হন। অন্যদিকে ঢাকা যাওয়ার প্রায় এক সপ্তাহ পরে আমি ফান্ড গঠন এবং নিজেরা সংগঠিত হওয়ার জন্য বগুড়াতে চলে আসি।


মুক্তিযোদ্ধা মাসুদার রহমান রহমান হেলাল (ছাত্র ইউনিয়নের তৎকালীন জেলা কমিটির ক্রীড়া সম্পাদক, বর্তমানে সেক্টর কমান্ডারস ফোরাম বগুড়ার সভাপতি) জানান, তৎকালীন চলচিত্র ডিরেক্টর আবুল খায়েরসহ দুজন আমেরিকান তাদের বাড়িতেই অবস্থান করছিল। মহাস্থানগড়ের ওপর একটি ডকুমেন্টারি তৈরির জন্যই তারা বগুড়ায় এসেছিল। মাসুদার রহমান হেলাল বলেন, পনের আগস্ট ভোরে খায়ের সাহেবের মুখ থেকেই আমি প্রথম বঙ্গবন্ধুর হত্যার সংবাদ পাই। তারপর রেডিও অন করে মেজর ডালিমের ঘোষণা শুনি। আচমকা এরকম একটা দুঃসহ খবর শুনে সবাই ঘাবড়ে গিয়েছিলাম। সেদিন রাস্তাঘাটে যান চরাচল স্বাভাবিক ছিল না। কেউ কোনো প্রতিবাদ মিছিল পর্যন্ত করতে পারিনি। সকলের মধ্যে একরকম ভীতি কাজ করছিল। শহরটা একদম থমথমে হয়ে গিয়েছিল। জনজীবন যেনো হঠাৎ করে হোঁচট খেয়ে থমকে দাঁড়াল। কিছুদিন পর থেকে আমরা ছাত্র ইউনিয়ন এর পক্ষ থেকে হাতে লিখে পোস্টার বানিয়ে রাতের বেলায় তা দেয়ালে দেয়ালে লাগিয়েছিলাম। তখন প্রতিষ্ঠানিক সব কার্যক্রম স্বাভাবিক থাকলেও সেনাবাহিনীর ক্যু ও পালটা ক্যু নিয়ে সকলের মাঝে আতঙ্ক ছিল।


সাবেক ছাত্রলীগ নেতা মোস্তাফিজুর রহমান ঘটু (১৯৭৫-এ ২নং ওয়ার্ড ছাত্রলীগের প্রচার সম্পাদক ছিলেন। বর্তমানে আওয়ামী লীগ নেতা ও স্বত্বাধিকারী সার্ভিস প্রিন্টিং প্রেস) বঙ্গবন্ধুর হত্যার খবর রেডিও তে শুনতে পাই। দেশের এত বড় বিপর্যয়ের পর সব কিছু জেনেও আমরা প্রকাশ্যে কোন প্রতিবাদ মিছিল করতে  পারিনি। এই ঘটনা সবার মাঝে ভীতি সঞ্চার করেছিল। তৎকালীন আওয়ামী বিরোধী সংগঠনগুলো আনন্দউচ্ছ্বাস প্রকাশ করে। বঙ্গবন্ধু হত্যার পরে আমরা সকল বাধা থাকা সত্ত্বেও কিছু দিন পর থেকে রাতের বেলায় পাড়া মহল্লায় ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়ে  প্রতিবাদ মিছিল করেছিলাম।


শহরের কলোনীর কৈগাড়ি এলাকার বাসিন্দা ইজিবাইক চালক মোহাম্মদ আলমগীর খন্দকার মুন্ন জানান, পঁচাত্তরে তিনি পঞ্চম শ্রেণির ছাত্র ছিলেন। তিনি নবলেন, পনের আগস্ট বঙ্গবন্ধু হত্যার পর শহরে এমন ভীতিকর অবস্থার সৃষ্টি  হয়েছিল যেনো পুরো শহর একটা মৃত্যুপুরী। সবার মনে এমন আতঙ্ক সৃষ্টি হয় যে, কেউ কিছু বললেই তাকে হত্যা করা হবে। এজন্য প্রকাশ্যে কোনো প্রতিবাদ মিছিলও হয় নি সেদিন। আর রাস্তায় যান চলাচলও তেমন হয় নি বললেই চলে।